ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

২০২১ হবে দেশি পণ্যে ই-কমার্সের বছর

সালাউদ্দীন আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৩৮, ১১ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ২০:১৯, ১১ জানুয়ারি ২০২১
২০২১ হবে দেশি পণ্যে ই-কমার্সের বছর

দশটা দোকান ঘুরে, একশটা পণ্য দেখে, দামাদামি করে একটা বা দুটো পণ্য কেনা বাঙালি নাকি ইন্টারনেটের মাধ্যমে পণ্য কিনবে? এটা তো কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ই-কমার্সের সহজ-সরল পরিসংখ্যান আসলে এমনই।

উন্নত দেশগুলো যখন ই-কমার্সকে সহজভাবে নিয়ে পথচলা শুরু করেছে, আমরা তখনো ইন্টারনেটকে শুধু বিনোদনের মাধ্যম হিসেবেই জেনেছি। এইতো কদিন আগেও ই-কমার্স বাংলাদেশের মানুষের কাছে হাসিঠাট্টার ব্যাপারই ছিল। তবে অবস্থা ধীরে ধীরে বদলে গেছে। বেশকিছু পরিসংখ্যান তারই প্রমাণ দেয়। 

একটি তথ্যমতে, ২০১১-২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশে ই-কমার্সের প্রসার বাড়ছে। বর্তমানে বই থেকে শুরু করে জামাকাপড়, খাবার, শৌখিনসামগ্রী ইত্যাদি ই-কমার্সের মাধ্যমে বেচাকেনা হচ্ছে।

তবে বাংলাদেশে ই-কমার্স খাত গতি পেতে শুরু করে ২০১৩ সাল থেকে। সে বছর দুটি ঘটনা ঘটেছিল। প্রথমত, ক্রেডিট কার্ড দিয়ে আন্তর্জাতিক কেনাকাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। একই বছর দেশের মোবাইল অপারেটরগুলো দ্রুতগতির তৃতীয় প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবা (থ্রিজি) চালু করে।

মূলত বাংলাদেশে ই-কমার্সের শুরুটা অনেকটা উঠানামার মধ্যে শুরু হয়। এরপর প্রসার লাভ করতে থাকে ইন্টারনেট সেবার মানোন্নয়ন ও লেনদেন ব্যবস্থায় স্বাচ্ছন্দ্য আসার পর থেকে।

সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশের ই-কমার্সের বাজার দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। যা বেড়ে ২ হাজার ৭৭ মিলিয়ন ডলার হবে। আর আগামী ২০২৩ সালে বাজারের আকার হবে ৩ হাজার ৭৭ মিলিয়ন ডলারের।

আঙ্কটাড (বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংক্রান্ত জাতিসংঘ সম্মেলন) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে বিশ্বব্যাপী ই-কমার্সের বিক্রি বেড়েছে ১৩ শতাংশ। এই হিসাবের মধ্যে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত থাকলেও দেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তাদের সংগঠন ই-ক্যাব (ই- কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) বলছে ভিন্ন কথা। তারা বলছে, বাংলাদেশে এই বিক্রির পরিমাণ আরও বেশি। আঙ্কটাডের দেওয়া তথ্যের প্রায় দ্বিগুণ বা ২৫ শতাংশ।

প্রসঙ্গত, ১-৫ এপ্রিল বৈশ্বিকভাবে ই-কমার্স সপ্তাহ পালন করা হয়। বাংলাদেশে পালিত হয় ৭-১৪ এপ্রিল। আর ই-কমার্স দিবস পালন করা হয় ৭ এপ্রিল। এ তো গেলো বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত ও পরিসংখ্যান। তবে গত ২০২০ সালে বাংলাদেশে ই-কমার্সের প্রসারের একটা বাস্তব চিত্র আমরা দেখেছি। লকডাউনে যখন সবকিছু স্থবির, তখনও মানুষের চাহিদাগুলো বরাবরের মতোই ছিল। তাই ভরসা ছিলো ই-কমার্সের মাধ্যমে কেনাকাটা করা। বিরূপ পরিস্থিতির কারণে মানুষ কেনাকাটাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।  

গত একটা বছর অনলাইনে কেনাকাটা বুঝিয়ে দিয়েছে ই-কমার্স মানেই প্রতারণা নয়। বরং ই-কমার্স মানে স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য। ই-কমার্সের প্রসারের কল্যাণে বন্ধ হয়ে যাওয়া তাঁত ফিরে পেয়েছে নতুন জীবন। হাসি ফুটেছে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের মুখে। শত দুরাবস্থায়ও কত কত সংসার যে চলেছে ই-কমার্সের মাধ্যমে পণ্য/সেবা বিক্রির মাধ্যমে, তার হিসেব নেই। গত বছরের পরিস্থিতিতে ই-কমার্সের ভিতটা যেন মজবুত হয়েছে। এবার ২০২১ সালে সেই ভিতের উপর নতুন নতুন ইতিহাস রচনা হওয়ার অপেক্ষা।

বাংলাদেশে ই-কমার্সের সম্ভাবনা নিয়ে কী বলছেন এ বিভাগের ব্যবসায়ীরা, চলুন জেনে আসা যাক কিছু মূল্যবান মতামত-

ই-ক্যাবের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সভাপতি রাজিব আহমেদ দেশীয় পণ্য নিয়ে ই-কমার্সের সম্ভাবনা সম্পর্কে বলেন, ‘২০২১ সালে দেশি পণ্যের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির বাজারের আকার বা মার্কেট সাইজ অনেক গুণ বাড়বে, সন্দেহ নেই। হয়তো আমরা এ বছরের শেষের দিকে বিলিয়ন ডলার ইন্ডাস্ট্রির কথা বলবো। সেইসঙ্গে প্রতিটি ইউনিয়ন তো বটেই। বেশিরভাগ গ্রামে অন্তত ১ জন হলেও দেশি পণ্যের ই-কমার্স উদ্যোক্তা দেখতে পাবো বলে আশা করি। তাছাড়া অনেক প্রবাসীর অর্ডারও আসবে। অনলাইনের মাধ্যমে দেশি পণ্য রপ্তানি হয়ে বিভিন্ন দেশে যাওয়ার প্রস্তুতি পুরোদমে শুরু হয়ে যাবে।’

কাকলী’স এটিয়ারের স্বত্বাধিকারী কাকলী রাসেল তালুকদার বলেন, ‘‘২০২১ সালে দেশী পণ্যের ই-কমার্সের সম্ভাবনা ব্যাপক। কারণ, অনলাইনের মাধ্যমে ব্যবসা করার এই উদ্যোগ আমাদের দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা ফেলবে। এতে মাথাপিছু আয় আরো বৃদ্ধি পাবে।

এখানে আমি উল্লেখ করতে চাই, উদ্যোক্তারা ফেসবুকে খুব ভালো করছে। বিশেষ করে পোশাক, গহনা, খাবার এসব দিকে অনেক দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। তাছাড়া ঐতিহ্যবাহী পণ্য, কুটির শিল্পে তৈরি পণ্য এসবকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতেও তাদের ভূমিকা প্রশংসার দাবি রাখবে।’’

দেশীয় পণ্য নিয়ে ই-কমার্স সেক্টরে সম্ভাবনা নিয়ে আরিয়া’স কালেকশনের স্বত্বাধিকারী নিগার ফাতেমা বলেন, ‘‘ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রিতে দেশীয় পণ্যের সম্ভাবনা আরো বাড়বে ২০২১ সালে। ২০২০ সালে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশীয় পণ্যের সুফল সম্ভাবনার শক্ত ভিত তৈরি করেছে। নিজের দেশের পণ্য নিয়ে উদ্যোক্তারা যখন কাজ করবে, তখন দেশে ও বিশ্বের সব দেশের মানুষের পরিসেবা  প্রদান করতে পারবে। 

ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশীয় পণ্যের চর্চা আরো বৃদ্ধি হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের নারীরা ঘরে বসে নিজ উদ্যোগে কাজ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। যার মাধ্যমে অনেক নারী ও পুরুষের কর্মস্থান বৃদ্ধি পাবে। ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে দেশীয় পণ্যের ক্রেতা ও বিক্রেতা সংখ্যা বাড়বে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিপুল পরিমাণ ভূমিকা রাখতে পারবে দেশীয় পণ্যের উদ্যোক্তারা।’’

পরিধান শৈলী’র স্বত্বাধিকারী রাকিমুন বিনতে মারুফ জয়া বলেন, ‘২০২০ সালে অভাবনীয় গতিতে দেশি পণ্যের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির ভিত তৈরি হয়েছে। ই-কমার্সে দেশি পণ্যের বিক্রি ও দাপট দুটোই বেড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালে ই-কমার্সে দেশি পণ্যের প্রচার ও প্রসার আরো বৃদ্ধি পাবে। ই-কমার্সে দেশি পণ্যের বিক্রি ও চাহিদা পূর্বের তুলনায় এবছর আরো বৃদ্ধি পাবে। তার পাশাপাশি দেশি পণ্যের উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বাড়বে। দেশি পণ্যের সঙ্গে জড়িত সব কর্মী ও কারিগর এর সুফল ভোগ করবে। কারণ ই-কমার্সে দেশি পণ্যের বিক্রি এখন আর অসম্ভব ব্যাপার নয়। বরং ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রিতে এখন দেশি পণ্যেরই সুদিন।’

রুপ’স হ্যাভেন-এর স্বত্বাধিকারী মেহজাবীন রাখী বলেন, ‘‘দেশি পণ্যের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির ভিত গঠন শেষ। এখন সময় এটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। ২০১৯ এর শেষ থেকে ২০২০ এর শেষ, অর্থাৎ গত এক বছরে এই ইন্ডাস্ট্রি এত বড় হয়েছে, যা আমরা এক বছর আগেও ভাবতে পারিনি। আমি মনে করি, ইন্ডাস্ট্রির এই অবস্থানের পেছনে ই-ক্যাবের সাবেক সভাপতি রাজিব আহমেদ স্যারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমরা প্রায় অনেকেই অবগত তাঁর অবদানের বিষয়ে। পাশাপাশি বর্তমানে দেশি পণ্যের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে সেরা প্ল্যাটফর্ম উই’র  (উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম) অবদান উল্লেখযোগ্য। 

উই গত এক বছরে রাজিব আহমেদের নেতৃত্বে দেশিপণ্যের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির জন্য কাজ করেছে। এর ফলস্বরূপ গ্রুপটিতে প্রায় ২২ লাখের বেশি কন্টেন্ট বা পোস্ট জমা পড়েছে, যার প্রতিটি দেশি পণ্য নিয়ে। দেশি পণ্যের উদ্যোক্তাদের কষ্ট, পরিশ্রম ও চেষ্টা সমানভাবে ভূমিকা রেখেছে এই ইন্ডাস্ট্রিতে।’’

ই-কমার্সের বর্তমান প্রেক্ষাপট যদি বিবেচনা করতে যাই, তাহলে বলতে হয়, এখন প্রায় সবার হাতে হাতেই স্মার্টফোন।  তাই ইন্টারনেট ভিত্তিক ব্যবসার সমস্ত কিছু সবার কাছে পৌঁছানোর প্রক্রিয়াটা আগের থেকে তুলনামূলক সহজ। যে বাঙালির কাছে এক সময় ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাস্তবে না দেখে কেনাকাটা করাটা হাস্যকর ছিল, সেই বাঙালিই এখন চাল, ডাল থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় নানারকম পণ্যসামগ্রী, পোশাক, জুতা, গহনা, ব্যাগ, গৃহস্থালি জিনিসপত্রসহ প্রায় সবকিছুই ইন্টারনেটের মাধ্যমেই কেনাকাটা করছে। এতে করে সময়ের সাশ্রয় যেমন হচ্ছে, তেমনি উঠে আসছে নানারকম পণ্য। 

 ২০২৩ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ই-কমার্সের বাজার তিন বিলিয়ন ডলার ছাড়ানোর তথ্য দিয়েছে জার্মান ভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এ থেকেই বোঝা যায়, ২০২৩ সালের ঐ পরিসংখ্যানকে সত্যি করার প্রক্রিয়া শুরু হবে এই একুশের বছরেই অর্থাৎ ২০২১ সালে।

২০২০ সালে ই-কমার্স সেক্টরে যে নবজোয়ার এসেছে, তার সুবাতাস বইতে থাকবে ২০২১ সালে, যা বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও অভিজ্ঞদের মূল্যবান মতামত দ্বারা সহজেই অনুমান করা যায়।

লেখক: স্বত্বাধিকারী, বিডিম্যামগ্রোভ.কম।

ঢাকা/সিনথিয়া/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়