ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

সরকারি কম্পিউটার ইন্সট্রাক্টর থেকে উদ্যোক্তা কান্তা

মিফতাউল জান্নাতী সিনথিয়া   || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৬, ২১ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৭:২৭, ২১ জানুয়ারি ২০২১
সরকারি কম্পিউটার ইন্সট্রাক্টর থেকে উদ্যোক্তা কান্তা

কান্তা চক্রবর্ত্তী, পরিবারের বড় সন্তান। গ্রামের বাড়ি বগুড়া জেলার আদমদিঘী উপজেলার চাঁপাপুর ইউনিয়নে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সরকারি মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজ, বগুড়া থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স মাস্টার্স শেষ করেন তিনি। বর্তমানে বগুড়া মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের কার্যালয়ে কম্পিউটার ইন্সট্রাক্টর পদে কর্মরত আছেন কান্তা।

কান্তা চক্রবর্ত্তী সরকারি পেশায় থাকলেও পাশাপাশি দুইটি উদ্যোগ নিয়ে অনলাইনে ব্যবসাও করছেন। উদ্যোক্তা জীবনে কাজ করছেন খাবার ও হাতে তৈরি গহনা নিয়ে। খাবার নিয়ে ফেসবুক পেজ Klaze Food এবং হাতে তৈরি গহনা নিয়ে Klaze। তিনি তার উদ্যোগের গল্প বলেছেন রাইজিংবিডিতে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন পত্রিকার উদ্যোক্তা পাতার সহ-সম্পাদক মিফতাউল জান্নাতি সিনথিয়া।

রাইজিংবিডি: ব্যবসার শুরুর দিকের গল্পটা যদি বলতেন।

কান্তা চক্রবর্ত্তী: শুরুটা আসলেই সহজ ছিল না। সেই ২০১৫ সালে অনার্স শেষ বর্ষে পড়ার সময়ে কয়েকজন বন্ধু মিলে রেডিমেড কুর্তি ও মেয়েদের বিভিন্ন পোশাক নিয়ে উদ্যোগ শুরু করি। কিন্তু টিমটা ভেঙে যাওয়ার কারণে আমাদের উদ্যোগটা ব্যর্থ হয়।  যেহেতু বিজনেসের তেমন কিছুই জানতাম না। একটা উদ্যোগ কী করে শুরু করতে হয় আর কী করেই বা সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়, সেটা ছিল প্রায় অজানা। এছাড়া পারিপার্শ্বিক প্রতিবন্ধকতা তো ছিলই। অনেকেই অনেক কথা বলতো, আর আমরাও আসলে তখন সেসব নিয়ে ভাবতাম। তাই সবমিলিয়ে ২০১৬ সালে আমি ও আমার পার্টনার খাবার নিয়ে কাজ শুরু করে সেখানেও ব্যর্থ হই। 

তারপর বর্তমান উদ্যোগ শুরুর আগে মাঝে আরো অনেক কাজ করেছি। তবে ২০১৯ সাল থেকে পুরোদমে উদ্যোক্তা জীবন শুরু হয়েছে। এখন আর কারো কথায় কান না দিয়ে, বাঁধাগুলো অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছি।

রাইজিংবিডি: কি কি পণ্য নিয়ে কাজ করছেন?

কান্তা চক্রবর্ত্তী: বর্তমানে কাজ করছি খাবারের মধ্যে মূলত ডেজার্ট আইটেম নিয়ে। যেমন সন্দেশ, লাড্ডু, রসকদম। সেই সঙ্গে রয়েছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খাবার ছাতু।

হাতে তৈরি গহনার মধ্যে রয়েছে কাঠের ও মেটালের তৈরি গলার মালা, কানের দুল, চুড়ি, হিজাব পিন, পায়েল, খোঁপার কাটা, নাকের নথ ইত্যাদি। আর এর সঙ্গে রয়েছে কাস্টমাইজড কাঠের তৈরি চাবির রিং।
 
রাইজিংবিডি: কীভাবে এমন পণ্য নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত ছিল?   

কান্তা চক্রবর্ত্তী: শুরুতে অনেকবার ভিন্ন ভিন্ন পণ্য নিয়ে কাজ করেছি। নিজের ভালো লাগার পণ্য খুঁজে পেতে ও সেটা নিয়ে কাজ শুরু করতে একটু সময় লেগেছে। একটা সময় মেয়েদের পোশাক রিসেলিংও করেছি। কিন্তু আমি কখনোই চাইনি এমন কোনো কাজ করতে, যেখানে আমার নিজের হাতের কোনো স্পর্শ থাকবে না। যেখানে আমার মানসিক প্রশান্তি থাকবে না। নিজে অত্যন্ত খাবার পছন্দ করি মূলত মিষ্টি জাতীয় খাবার। আর সেই ভালো লাগা থেকেই মিষ্টি জাতীয় খাবার নিয়ে কাজ করছি।

দেশীয় পণ্যের প্রতি ভালো লাগা ও ভালোবাসা ছিল আগে থেকেই। সেখান থেকে আমার দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ শুরু। আর হাতে তৈরি দেশি গহনাগুলো আমার নজর কেড়েছিল। কোনোরকম হাতে খড়ি না থাকার পরেও নিজে নিজে চেষ্টা করি। ইউটিউবের স্মরণাপন্ন হয়ে এই কাজ শিখে উদ্যোগ শুরু করেছি। এক্ষেত্রে একজন সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষ হয়েও ঢাকার মুক্তা নামের একজন আপু যথেষ্ঠ সাহায্য করেছেন আমাকে।

রাইজিংবিডি: ব্যবসার শুরুটা কি অনলাইনেই ছিল?

কান্তা চক্রবর্ত্তী: না, ব্যবসার শুরুটা পুরোপুরি অনলাইন কেন্দ্রিক ছিল না। শুরুর দিকের ক্রেতা ছিল আমার আশেপাশের মানুষ। মূলত আমার অফিসের প্রশিক্ষণার্থীরা তাদের পরিচিত জনেরা। তবে ধীরে ধীরে আমার উদ্যোগ পুরোপুরি অনলাইন কেন্দ্রিক হয়ে ওঠে।

রাইজিংবিডি: একজন নারী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে কখনো সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন?

কান্তা চক্রবর্ত্তী: একদম শুরুতে সমস্যায় পড়েছি। যখন ২০১৫ সালে শুরু করি, তখন অনেকেই খুব বাজে কথা বলতো। অনেকের বাঁকা দৃষ্টি দেখতে হয়েছে। পড়াশোনা করে উদ্যোক্তা হয়ে উঠছি এটাও অনেকে ভালো চোখে দেখত না। পরিবারের লোকজন চাইত ভালো চাকরির জন্যই যেন পড়াশোনা করি। তবে এর থেকেও বেশি বিব্রতকর পরিস্থিতি ছিল বাইরে গিয়ে সোর্স খোঁজা। নিজের উদ্যোগের কাজ নিজে করার ক্ষেত্রে সমস্যাও ছিল ব্যাপক। তবে এখন আর কোনো কিছুকেই পাত্তা দেই না।

রাইজিংবিডি: নতুনদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

কান্তা চক্রবর্ত্তী: নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য পরামর্শ থাকবে আগে নিজের পছন্দের ফিল্ড বাছাই করুন। কোন পণ্য বা সার্ভিস আপনার ভালো লাগে। আপনি আসলে কোন কাজটা করতে পছন্দ করেন। অন্যদের দেখে পণ্য বাছাই নয়। বরং নিজের জানার পরিধি ও ভালোবাসার জায়গা থেকে পণ্য বাছাই করুন। তারপর নিজের টেকনিক্যাল নলেজ বাড়ান। এখন অনেক বেশি সহজ যেকোনো বিষয়ে নিজের জ্ঞানের পরিধি বাড়ানো।

দেশীয় পণ্য ও ই-কমার্সের জন্য ফেসবুক ভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম উই (উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম) রয়েছে। যেখানে লাখ লাখ পোস্ট রয়েছে। ১১ লাখ সদস্যের এই পরিবারে সময় দিয়েই ই-কমার্সের খুঁটিনাটি জেনে নেওয়া সম্ভব।

এছাড়া টেকনিক্যাল নলেজ বাড়ানোর জন্য ফেসবুক গ্রুপ ডিএসবি (ডিজিটাল স্কিলস ফর বাংলাদেশ) অনেক বড় ভূমিকা পালন করছে। তাই নতুন উদ্যোক্তাদের উচিত নিজেদের সময় ব্যয় করে শেখা। আমি নিজেও এই গ্রুপ দুইটি থেকে অনেক কিছু শিখেছি। পণ্যের ফটোগ্রাফি, দাম নির্ধারণ, পণ্যের প্রচার প্রচারণার মাধ্যম, নিজের উদ্যোগ এবং কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের উপায়, ডিজিটাল মার্কেটিংসহ আরো অনেক খুঁটিনাটি বিষয়। আর এই বিষয়গুলো একজন নতুন উদ্যোক্তার জানা উচিৎ।

রাইজিংবিডি: উদ্যোক্তা জীবনে সফলতার ভূমিকায় কারা ছিল?

কান্তা চক্রবর্ত্তী: উদ্যোক্তা জীবনে সফল হওয়ার পেছনে আমার পার্টনার বড় ভূমিকা পালন করেছে সেই শুরু থেকে। আমার পরিবারের সবাই অফিসের স্যারসহ আমার শিক্ষাজীবনের শিক্ষকরা সবাই সবসময় আমাকে মানসিকভাবে সাপোর্ট করেছেন। তবে এ কথা বলা বাহুল্য বাঁকা কথা বলা মানুষগুলোর ভূমিকাও কিন্তু কম নয়। আর বেশি ভূমিকা পালন করেছেন আমার মেন্টর সার্চ ইংলিশের ফাউন্ডার শ্রদ্ধেয় রাজীব আহমেদ স্যার। স্যারের প্রতিটি পোস্ট থেকে আমি অনুপ্রেরণা পেয়েছি। পরামর্শ পেয়েছি, যা আমাকে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে সহযোগিতা করেছে। আমি হতাশা থেকেও বেরিয়ে আসতে পেরেছি।

রাইজিংবিডি: আপনার উদ্যোগের সফলতার কথা জানতে চাই।

কান্তা চক্রবর্ত্তী: সফলতার সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেকরকম। সফলতা বিচারের মাপকাঠিও আলাদা। আমার উদ্যোক্তা জীবনে প্রাপ্তির সংখ্যা অনেক বেশি। গত এক বছরে আমি আমার উদ্যোগের মাধ্যমে মিডিয়াতে গিয়েছি, উইতে পণ্য বিক্রিতে লাখপতির তালিকায় নাম লেখিয়েছি। অসংখ্য নতুন ক্রেতার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। ৩০টিরও বেশি জেলায় আমার পণ্য পৌঁছে গেছে। একইসঙ্গে বর্তমানে আমি কয়েকজনকে নিয়ে আমার উদ্যোগের কাজ করছি। আমার টিম মেম্বার বাড়ছে। এগুলো সবই আমার প্রাপ্তি।

এছাড়াও আমার উদ্যোগকে নিয়ে এক্টিভ থেকে উই এবং ডিজিটাল স্কিলস ফর বাংলাদেশ গ্রুপে মডারেটর হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছি।

রাইজিংবিডি: ব্যবসা নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী? 

কান্তা চক্রবর্ত্তী: আমি আমার উদ্যোগকে নিয়ে শুধু নিজের এলাকায় থাকতে চাই না। দেশের মধ্যে ও দেশের বাইরে নিয়ে যেতে চাই। আমার উদ্যোগের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের নিয়ে কাজ করতে চাই। নিজের পাশাপাশি আরও কিছু মানুষকে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।

রাইজিংবিডি: উদ্যোক্তা জীবনে পদার্পণের সময় কত?  

কান্তা চক্রবর্ত্তী: উদ্যোক্তা জীবনের শুরু ২০১৫ তে হলেও পুরোপুরি ২০১৯ সাল থেকে। সেই হিসেবে উদ্যোক্তা জীবনের শুরু প্রায় দেড় বছর।

রাইজিংবিডি: সময় দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

কান্তা চক্রবর্ত্তী: আমার গল্প পাঠকদের সামনে তুলে ধরার জন্য রাইজিংবিডিকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।

ঢাকা/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়