ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

পরিবারকে সহযোগিতা করতেই উদ্যোক্তা হন মৌরিন

মিফতাউল জান্নাতী সিনথিয়া   || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২৪, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৭:২৮, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১
পরিবারকে সহযোগিতা করতেই উদ্যোক্তা হন মৌরিন

ফাতেমা তুজ জোহরা মৌরিন। পরিবারের বড় সন্তান। জন্ম কুমিল্লা জেলায়। বর্তমান তিনি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক প্রথম বর্ষে পড়ালেখা করছেন। ঢাকার রামপুরাতে বাবা-মার সঙ্গেই তার বসবাস।

করোনার সময়ে নিজের টিউশন ও বাবার চাকরি হারিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত ছিলেন মৌরিন। পড়ালেখার পাশাপাশি পুরো পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে ই-কমার্স উদ্যোক্তার খাতায় নাম লিখিয়েছেন তিনি। তার ফেসবুক পেজের নাম ‘Dry fruits & Sweets corner’। হাতে বানানো বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন পণ্য নিয়েই মূলত তার ব্যবসার অগ্রযাত্রা। তিনি তার উদ্যোগের গল্প বলেছেন রাইজিংবিডিতে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন পত্রিকার উদ্যোক্তা পাতার সহ-সম্পাদক মিফতাউল জান্নাতি সিনথিয়া।
 
রাইজিংবিডি: কেমন আছেন?

ফাতেমা তুজ জোহরা মৌরিন: জি পড়ালেখা ও ব্যবসা, এসব কাজের মধ্যেও ভালো আছি।

রাইজিংবিডি: আপনার ব্যবসার শুরুর গল্পটা যদি বলতেন।

ফাতেমা তুজ জোহরা মৌরিন: ব্যবসার শুরুটা সত্যিই সহজ ছিল না। উদ্যোক্তা জীবনের শুরুতে আমি কিছুই জানতাম না অনলাইন ব্যবসা সম্পর্কে। পণ্যের সোর্সিং, প্যাকেজিং, কুরিয়ার ও হোম ডেলিভারি নিয়ে কোনো ধারণাই ছিল না। ব্যবসা শুরুর প্রথম দিনই অর্ডার পেয়েছিলাম। গরুর দুধের সন্দেশ ডেলিভারির মাধ্যমে আমার যাত্রা শুরু হয়। আমি জানতাম না কুরিয়ারে কীভাবে কী করে।

রাইজিংবিডি: আপনার পণ্যের তালিকায় কি কি রয়েছে?

ফাতেমা তুজ জোহরা মৌরিন: ড্রাই ফ্রুটস, নারকেলের চিড়া, নারকেলের বরফি, নারকেলের নাড়ু, ৫ রকম সন্দেশ এবং আরো কিছু ড্রাই মিষ্টি আইটেম নিয়ে ব্যবসা করছি।

রাইজিংবিডি: এমন পণ্য নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা কেন ছিল?  

ফাতেমা তুজ জোহরা মৌরিন: খাবার নিয়ে কাজ শুরু করার ২টা কারণ ছিল। প্রথমত, বর্তমানে খাবারে প্রচুর পরিমাণে ভেজাল মিশানো হয়। তাই চিন্তা করলাম মানুষকে ভালো ও ফ্রেশ খাবার খাওয়ানোর। সেই সময়টাতে আমার কাজ করা এই আইটেমগুলো খুব কম পাওয়া যেত। আমার মনে হয়েছিল এই খাবারগুলো বিক্রি হওয়ার একটা সম্ভবনা আছে। তাই খাবার নিয়ে কাজে নেমে পড়লাম।

অপর কারণ হচ্ছে ব্যবসার মূলধন। আমি মূলত করোনার প্রথম দিকেই অনলাইন বিজনেস শুরু করেছি। সেই সময়টাতে আমার কাছে ইনভেস্ট করার মতো কোনো টাকা ছিল না। খাবার নিয়ে কাজ করতে গেলে আমার কোনো মূলধনের প্রয়োজন ছিল না। তখন আমার মাথায় এসেছে আমি যদি অন্য প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করতে চাই, তাহলে আমার স্যাম্পলের প্রয়োজন। আর তার জন্য অবশ্যই টাকা ইনভেস্ট করতে হবে। আর সে মুহূর্তে ইনভেস্ট করার মতো পরিস্থিতি আমার ছিল না।

খাবার নিয়ে শুরু করতে আমার ৪০০-৫০০ টাকা ইনভেস্ট করতে হয়েছে। কিন্তু তাও আমি করেছি অর্ডার পাওয়ার পর। কারণ আমার কাছে ছবি ছিল। সেই সুবাধে নতুন করে তৈরি করে ছবি বিজ্ঞাপন বা ছবি দিতে হয়নি।

রাইজিংবিডি: ব্যবসার শুরুটা কি অনলাইনেই ছিল?

ফাতেমা তুজ জোহরা মৌরিন: ব্যবসার শুরু অনলাইন কেন্দ্রিক। করোনার শুরুতে লকডাউনে ঘরে বসে থাকি। অর্থনৈতিক দিকে পরিবারের একজন সহযোগী ছিলাম। তিনটা টিউশন ছিল, যেগুলো করোনায় বন্ধ হয়ে যায়। তাই হতাশ ছিলাম অনেক। এরপর ফেসবুকে স্ক্রল করতে করতে উইর (উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম) সন্ধান পাই। সেখান থেকেই আমার উদ্যোক্তা জীবন শুরু হয়। আর উই থেকে আমার ব্যবসার হাতেখড়ি। আমার কাজ শুধু উইতে অর্থাৎ অনলাইনে।

রাইজিংবিডি: কাজ করতে গিয়ে কখনো বাধার সম্মুখীন হয়েছেন?  

ফাতেমা তুজ জোহরা মৌরিন: এমনটা শুরুর দিকে অনেক হয়েছি। যেহেতু ব্যবসাটা অনলাইনভিত্তিক, তাই নতুন নতুন মানুষ ফেসবুক লিস্টে আসত। অনেকে অনেক সময় খারাপ কথা বলেছে। খারাপ মন্তব্য করেছে। আবার অনেকে বলতো আর কিছু পেলো না নাড়ু সন্দেশ বিক্রি করে। এমন কথাগুলো প্রথম দিকে আমাকে পেছনে টেনে ধরতো। কিন্তু এখন আমি আর এসব কানে নেই না।

রাইজিংবিডি: আপনার উদ্যোগের সফলতার কথা জানতে চাই।

ফাতেমা তুজ জোহরা মৌরিন: আমি উদ্যোক্তা জীবনে এখনো পরিপূর্ণ সফল হতে পারি নাই। কিন্তু শুরুর দিকে আমি যেমন ছিলাম, আজ তার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। করোনাকালীন সময়ে যখন পরিবারে ফিনান্সিয়াল প্রবলেম হচ্ছিল, তখন আমার ব্যবসা থেকে আমার পরিবারে ফিন্যান্সিয়াল সাপোর্টটা পুরোপুরি দিতে পেরেছি। তখন আব্বুর চাকরি আমার টিউশন কিছুই ছিল না। পরিবারের যাবতীয় খরচ এই উদ্যোগের উপরেই ছিল। তখন আমাদের ঘরের সব মানুষ সারা দিন অর্ডারের কাজ করতো। মানে আমরা কাজগুলো শেষ করতে হিমশিম খেতাম।

আমার এই উদ্যোগের সফলতার কথা আসলে আমার মাথায় সর্ব প্রথম আসে ফেসবুক গ্রুপ উই, রাজিব স্যার এবং নিশা আপুর কথা। আমি উইতে এসে প্রথম রাজীব স্যারের একটি পোস্ট দেখেছিলাম। যেখানে স্যার বলেছিলেন অ্যাক্টিভ থেকে নিজের পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং গড়ে তুলতে পারলে বিক্রির চিন্তা করতে হয় না। সেই কথার উপর ভিত্তি করে আজ আমি এতটা পথ এগিয়ে আসতে পেরেছি।

রাইজিংবিডি: উদ্যোক্তা জীবনে সফলতায় কাদের ভূমিকা ছিল?

ফাতেমা তুজ জোহরা মৌরিন: উদ্যোক্তা জীবনে সফল হতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা আমার পরিবারের। আমার বাবা-মা এবং আমার বিজনেস পার্টনার (বেস্ট ফ্রেন্ড)। তার পাশাপাশি আমার উদ্যোক্তা জীবনে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে উই। কারণ উইতে এসে আমি আমার উদ্যোক্তা জীবন শুরু করতে পেরেছি।  

আমার বিজনেসে আমার আব্বু আর পার্টনার দুজনে প্রোডাক্ট সোর্সিং এবং প্রোডাক্ট কালেক্ট করতে সাহায্য করেছে। আমার আম্মু খাবারগুলো তৈরি করে। আমার পার্টনার (সিয়াম আহমেদ) আমার অনলাইনে একটিভ থাকতে সাহায্য করেছে। খাবার তৈরির ক্ষেত্রে ৯৮ শতাংশ কাজই আম্মু করে। আমার ছোট বোনেরাও অনেক সাহায্য করে। সব কিছু মিলিয়ে আমার পুরো পরিবার আমাকে সাহায্য করেছে।

রাইজিংবিডি: ব্যবসা নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?

ফাতেমা তুজ জোহরা মৌরিন: বর্তমানে আমি উদ্যোক্তা জীবনের যে পজিশনে আছি সেখানে থেকে মনে হচ্ছে আমি এখনো সফলতা অর্জন করতে পারিনি। এখনো প্রতিনিয়ত আমি শিখছি। আমি চাই আমার উদ্যোগকে সফল করতে। নিজেকে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করতে। আমার স্বপ্ন আমার উদ্যোগকে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে গড়ে তোলা।

রাইজিংবিডি: উদ্যোক্তা জীবন শুরু কতদিন ও আয় কেমন?

ফাতেমা তুজ জোহরা মৌরিন: আমার উদ্যোক্তা জীবন শুরু করেছি প্রায় নয় মাসের কাছাকাছি। ৪০০/৫০০ টাকা দিয়ে আমার উদ্যোক্তা জীবন শুরু করেছিলাম।  ৯ মাসের মাথায় এসে আমার মোট বিক্রি প্রায় তিন লাখ টাকা।

রাইজিংবিডি: নতুনদের জন্য কিছু বলুন।

ফাতেমা তুজ জোহরা মৌরিন: নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য বলবো, অবশ্যই সোর্সিং সম্পর্কে পুরো ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করুন। সেই কাজটা করতে গেলে কি কি পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে, তা একবার ভেবে নিন। যেমন- প্রোডাক্ট ডেলিভারি সিস্টেম, কুরিয়ার প্রসেস, প্যাকেজিং, প্রোডাক্ট তৈরি করতে খরচ ও বিক্রির দাম নির্ধারণ করা, এগুলো বুঝে নিতে হবে কাজ শুরুর আগে।

আমি নিজেও এসব না ভেবে কাজ শুরু করেছিলাম। সে জন্য প্রথম দিকে আমাকে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। তাই আমি চাই না নতুন কেউ এই পরিস্থিতিগুলোর শিকার হোক। অনেকে এই পরিস্থিতিতে পড়ে কাজ থেকে ঝরে পড়েন। তাই খেয়াল রাখা দরকার এই কাজগুলোর প্রতি।

রাইজিংবিডি: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

ফাতেমা তুজ জোহরা মৌরিন: ধন্যবাদ রাইজিংবিডি পরিবারকে, আমার উদ্যোগ দেশবাসীর সামনে তুলে ধরার জন্য।

ঢাকা/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়