ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

নাড়ির টানে স্থানীয় পণ্যের উদ্যোক্তা পপি 

সালাউদ্দিন আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৩৩, ১৩ মার্চ ২০২১  
নাড়ির টানে স্থানীয় পণ্যের উদ্যোক্তা পপি 

রোখসানা আক্তার পপি, জন্মস্থান গাইবান্ধা হলেও বাবার আর্মিতে চাকরির সুবাদে বেড়ে ওঠা দেশের বিভিন্ন জেলাতে। দুই ভাইয়ের একমাত্র বোন পপি। একেবারেই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তিনি। নানা চড়াই-উৎরাই দেখে বড় হলেও খুব যত্নে মানুষ হন তিনি।

ছোটবেলা থেকেই পড়তে খুব ভালোবাসতেন পপি। বাবা-মা যেখানে সন্তানদের পড়ার কথা বলতে বলতে অতিষ্ঠ হতেন, সেখানে উল্টো পপির বাবা-মা বলতেন এখন ঘুমাও। আবার কালকে পড়। বাবা-মা পরিবারের সবার খুব ইচ্ছা ছিল পপিকে ডাক্তারি লাইনে পড়ানোর। কিন্তু মেডিক্যালে চান্স পাওয়া হলো না। যেটা ছিল পড়ালেখা জীবনে তার প্রথম ব্যর্থতা। পরবর্তী সময়ে ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়  থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স শেষ করেন পপি। 

এরপর ২০১৫ সালে টাঙ্গাইলে বিয়ে হয় তার। বর্তমানে বসবাস করছেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার কাহালগা গ্রামে। সারাজীবন শহরে বেড়ে ওঠা মেয়ে তিনি। বাবা ও শ্বশুড় বাড়ি শহরে হলেও স্বামীর চাকরির সুবাদে গ্রামে থাকা তার। 

এত কিছুর মাঝেও উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন রোখসানা আক্তার পপি। তার উদ্যোগের নাম ‘ইপ্পি শপিং’। অনলাইনে ফেসবুককে কাজে লাগিয়েই টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী পোশাক নিয়েই ব্যবসা করছেন পপি। তিনি তার উদ্যোক্তা জীবনের গল্প বলেছেন রাইজিংবিডিতে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন রাইজিংবিডির প্রদায়ক ও বিডিম্যানগ্রোভ ডটকমের স্বত্বাধিকারী সালাউদ্দিন আহমেদ।

রাইজিংবিডি: ব্যবসার শুরুর গল্পটা জানতে চাই।

রোখসানা আক্তার পপি: শুরুর গল্পটা যদি বলি মোটামুটি হুট করেই একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া। আসলে ২০১৬ থেকে ২০১৯ আমার জন্য খুব কঠিন একটা সময় ছিল। যে অনুভূতিটা শুধুই আমার নিজের। এই সময়ের মাঝে ২২ মাসের ব্যবধানে দুই সন্তানের মা হই আমি। কিন্তু সময়টা এত কঠিন ছিল যে নিজেকে মাঝে মাঝেই পাগল মনে হতো। এভাবে চলতে চলতে হতাশায় নিমজ্জিত হতে লাগলাম।

এরপর মোটামুটি হুট করেই আমি ও আমার ফ্রেন্ড ইভা অনলাইনে কিছু একটা শুরুর কথা ভাবতে থাকলাম। কোনো চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই কাজের শুরু করেছিলাম। এরপর আমার উদ্যোগকে আমি সিরিয়াসলি নিতে শুরু করি ফেসবুক গ্রুপ উইতে (উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম) এসে। সেই থেকে শুরু। উই থেকে হাইটেক পার্কের ট্রেইনিং পেয়েছি, কোর্সেরার ১০টি কোর্স আন্তর্জাতিক মানের ট্রেইনিং করেছি, যা আমার উদ্যোক্তা জীবনের জন্য খুব বেশি ফলপ্রসূ হচ্ছে।

রাইজিংবিডি: কোন ধরনের পণ্য নিয়ে কাজ করছেন? 

রোখসানা আক্তার পপি: আমি কাজ করছি আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী পণ্য টাঙ্গাইলের শাড়ি, থ্রিপিস নিয়ে। এছাড়াও আমার পেজে রয়েছে হাতের কাজের থ্রিপিস, কুর্তি এবং শাড়ি।

রাইজিংবিডি: টাঙ্গাইল শাড়ির মতো পণ্য নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা কেন ছিল?

রোখসানা আক্তার পপি: আমার শ্বশুর বাড়ি ছিল টাঙ্গাইলে। শুরু থেকেই আমার মনে হয়েছে যে, এমন কিছু পণ্য নিয়ে ব্যবসা করবো, যা আমি সহজেই উৎপাদন কেন্দ্র থেকে সংগ্রহ করতে পারি। তাই টাঙ্গাইলের শাড়ি ও থ্রিপিস নিয়ে যাত্রা শুরু করি। তাছাড়া টাঙ্গাইলের শাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের নারীর টান ও ঐতিহ্যের ছোঁয়া।

শুরুতে আমার ইচ্ছে ছিল থ্রিপিস নিয়ে কাজ করার। কেননা এই পণ্যটা নিয়মিত সবার প্রয়োজন হয়। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের টাঙ্গাইল শাড়ি যোগ হয়েছে আমার উদ্যোগে। যেমন- টাঙ্গাইলের সুতি, হাফসিল্ক জামদানি, মাসলাইস কটন, কটকি, সিল্ক ও হাফসিল্কের অন্য অনেক শাড়ি।

এমনকি তাঁতের থ্রিপিস বলতে মানুষ আগে যা বুঝতো সুতি নরমাল কিছু থ্রিপিস। ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। ইদানিং এসেছে অনেক ডিজাইনের থ্রিপিসও। কাজ করতে গিয়েই আমি বের করে এনেছি টাঙ্গাইলের সুতি, মাসলাইস সুতি, কটকি, জামদানি হাফসিল্ক ও সফট সিল্ক জামদানি থ্রিপিস। এছাড়াও টাঙ্গাইলে এক ধরনের মসলিন জামদানি থ্রিপিসও হয় এবং সেটাও আমার কাজ করতে করতেই চেনা।

এসবের পাশাপাশি আমার খুব ইচ্ছা ছিল গ্রামীণ নারীদের নিয়ে কাজ করবো। তাই হাতের কাজের পোশাক নিয়েও কাজ শুরু করি। আমার নিজের পছন্দ থেকেই এই পণ্যগুলো আমার উদ্যোগের অংশ।

রাইজিংবিডি: ব্যবসার শুরুর মাধ্যম কোন উপায়ে ছিল? 

রোখসানা আক্তার পপি: আমার বিজনেস পুরোপুরিভাবে অনলাইনেই ছিল।

রাইজিংবিডি: ব্যবসা নিয়ে ভবিষ্যতে কতদূর যেতে চান এবং পরিকল্পনা কী?

রোখসানা আক্তার পপি: আমি যখন স্বপ্ন দেখিনি যে আমি উদ্যোক্তা হবো, তখনও আমার স্বপ্ন ছিল অসহায় ও এতিম বাচ্চাদের জন্য কিছু করার। এখন আমার উদ্যোগ হয়েছে। আমি স্বপ্ন দেখি কিছু পরিবারের মুখে যেন আমার হাত ধরে স্বচ্ছলতা আসে। তেমন একটা কর্মসংস্থানের জায়গা তৈরি করার ইচ্ছা আছে। কাজ শুরু করেছি, এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। আমার ইপ্পি শপিংকে একটা জায়গা দিতে চাই। যেখানে সারাদেশ ও দেশের বাইরে একে এক নামে চিনবে। সবসময় পণ্যের মান ভালোটা দিয়ে আমি ক্রেতাদের সেবা করে যেতে চাই।  

রাইজিংবিডি: আপনার উদ্যোগের সফলতার কথা জানতে চাই।

রোখসানা আক্তার পপি: আমার উদ্যোগ সফল কতটুকু তা বলতে পারবেন আমার ক্রেতারা। তাদের আস্থার জায়গাটা নিতে পারলেই আমার জন্য স্বস্তি। তবে অল্প সময়ে ব্যবসায় পেয়েছি অনেক রিপিট ক্রেতা। অনেকের ভরসার জায়গা হতে পেরেছি এটা খুব শান্তি দেয়৷  আমি সবসময়ই ভাবি বিজনেস মানেই সৎ পেশা। এই জায়গাটাকে ফোকাস করাই আমার উদ্দেশ্য। আমার উদ্যোগের সফলতা যা সবই ক্রেতাদের সন্তুষ্টি। বহুপথ এভাবে পাড়ি দেওয়ার বাকি এখনো। দুই সন্তান নিয়ে অনেক কিছু সামলানো খুব কঠিন হলেও কখনো আমি হতাশ হই না। একদিন প্রমাণ করতে পারবো সন্তান বা সংসার কাজের বাঁধা নয় বরং শক্তি। 

রাইজিংবিডি: উদ্যোক্তা জীবনে সফল হতে কাদের ভূমিকা বেশি ছিল? 

রোখসানা আক্তার পপি: সফল হতে যা বোঝায় সেই জায়গাটায় এখনো পৌঁছাতে পারিনি আমি। অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়ার ইচ্ছা আমার। তবে নিজের স্বপ্নকে নির্ধারণ করে ফেলেছি। কিছু করতে হলে কি কি প্রয়োজন, কতটা ডেডিকেশন প্রয়োজন, নিয়মিত লেগে থাকা প্রয়োজন সব রাজীব আহমেদ স্যারের কাছ থেকেই শিখতে পেরেছি।

উই গ্রুপ উদ্যোক্তা বানানোর সেরা প্ল্যাটফর্ম। নিশা আপু আমাদের পাশে শক্ত একটা খুটি রেখেছেন উই গ্রুপকে। যার জন্য আমরা উদ্যোক্তারা সুন্দরভাবে শক্ত সামর্থ্য নিয়ে দাঁড়িয়েছি। কৃতজ্ঞ সবসময় উই গ্রুপ ও নিশা আপুর প্রতি। অবশ্যই আমার স্বামীর কথা বলবো যার সাপোর্ট ছাড়া অনেক কিছুই সম্ভব হতো না। এমনকি আমার মা, আমার ভাই দুটো, বন্ধু মতো বোন ইভা, এরা খুবই সাপোর্টিভ। আমার পুরো পরিবার আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে।

রাইজিংবিডি: একজন নারী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে কখনো সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন?

রোখসানা আক্তার পপি: অসংখ্যবার বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি। কেননা আমাদের সমাজের মেয়েদের সবথেকে বড় বাধাই হলো সামাজিক এবং পারিবারিক বাধা। আমি পরিবার থেকে খুবই ভালো সাপোর্ট পেয়েছি। কিন্তু সমাজে পেয়েছি অনেক ধরনের বাধা। প্রথম বাধাই ছিল এসব কী? এত পড়ালেখা করে শেষমেশ অনলাইনে ব্যবসা? স্বামীর এত ভালো চাকরি, এরপরও এত টাকার দরকার? মেয়ে মানুষ হয়ে এত কিছুর কী দরকার? এমন অনেক মানসিক বাধা পেয়েছি।

এখন আপাতত মফস্বল এলাকায় থাকার জন্য পণ্য ডেলিভারিটা খুব বেশি সমস্যা। কেননা উপজেলা পর্যায়ে ক্যাশ অন ডেলিভারি হয় না। সেক্ষেত্রে অনেক ধরনের সমস্যারই সৃষ্টি হয় মাঝে মাঝেই। তবে সব সামলে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। 

রাইজিংবিডি: উদ্যোক্তা জীবনের শুরু কতদিন ধরে এবং রেভিনিউ কেমন? 

রোখসানা আক্তার পপি: ১০ মাসের বেশি উদ্যোক্তা জীবন আমার। শুরু করেছিলাম ২০,০০০ টাকা দিয়ে। সেখানে এখন আমি উইতেই বিক্রি করেছি ২ লাখের কাছাকাছি। এছাড়াও আমার বিজনেস পেজে তো বিক্রি আছেই। বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছি ক্রেতাদের থেকে।

রাইজিংবিডি: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

রোখসানা আক্তার পপি: আমার উদ্যোগের গল্প প্রকাশের জন্য অনেক ধন্যবাদ রাইজিংবিডিকে।

ঢাকা/সিনথিয়া/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়