ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ই-কমার্স : প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা

সালাউদ্দিন আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:২২, ৫ এপ্রিল ২০২১  
ই-কমার্স : প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা

একটি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক,
আনিস সাহেব কাজ করেন দেশের নামকরা একটি কোম্পানিতে। মিরপুরে ভাড়া বাড়িতে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে তার সুখের সংসার। তার সহধর্মিনী শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন একটি বেসরকারী স্কুলে। পরিবারে দুজন উপার্জনকারী ব্যক্তি থাকায়, সংসার সামলাতে মাস শেষে তাদের তেমন হিমশিম খেতে হয় না। সৃষ্টিকর্তার দয়ায় বেশ ভালভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল।

হঠাৎ করে বৈশ্বিক মহামারি করোনা শুরু হওয়ায় সকলের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। বাংলাদেশও এই মহামারির কবল থেকে রেহাই পেলো না। সাধারণ ছুটি তথা লকডাউনের ঘোষণা আসে দেশব্যাপী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে কলকারখানা, অফিস, আদালত বন্ধ হয়ে গেলো। শুরু হলো এক অনিশ্চিত পথ চলা। স্বাভাবিক কার্যক্রম না থাকায় লোকসানের কারণে অনেক বেসরকারী ও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেল। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান নিজেদের ব্যয় কমাতে কর্মী ছাটাই শুরু করে দিলো। দুর্ভাগ্যক্রমে আনিস সাহেবেও সেই তালিকায় চলে এলো। চাকরি হারিয়ে অনেকটাই বিমর্ষ হয়ে পড়েন তিনি। এদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তার স্ত্রীর আয়ের পথও অনেকটা বন্ধ।  শিক্ষার্থী পড়িয়ে যেটুকু চলছিল তাও ধীরে ধীরে কমে এলো। জীবন কীভাবে পার হবে ভেবে পাচ্ছিলেন না। সঞ্চয় যতটুকু ছিল তা দিয়েই সংসার চলতে থাকলো। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। বিকল্প উপায়ে কিভাবে আয়ের পথ তৈরি করা যায় উভয়ই ভাবতে থাকলেন।

ফেসবুক চালাতেন দুজনই। বেশ কিছু ব্যবসায়িক এবং ই-কমার্স গ্রুপে যুক্ত থাকার কারণে অনলাইনে বেচাকানার বিষয়টা জানা ছিল আগে থেকেই। স্বাভাবিক সময়গুলোতে অবসরে আনিস সাহেব ফেসবুকের গ্রুপগুলোতে ঘুরে ঘুরে দেখতেন, ধারণা নিতেন। লকডাউনের অবসরে বিষয়টা যেন আরও পাকাপোক্ত হলো। অর্থমন্দার দুশ্চিন্তা থেকে বের হতে অনলাইনের কাজের ধরণ এবং খুঁটিনাটি বিষয়গুলো বুঝার চেষ্টা করা শুরু করলেন। অনেকেই সফলতা পাচ্ছেন দেখতে পেয়ে, স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করলেন বিষয়টা নিয়ে। এদিকে উনার স্ত্রীও এটি নিয়ে ভাবছিলেন। কীভাবে শেয়ার করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। স্বামীর কথায় ভরসা পেয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন, জানালেন তিনি নিজেও এই বিষয়টি নিয়ে ভেবেছেন। একে অপরের সঙ্গে আলোচনা এবং পরামর্শ করার পর বেশ উৎসাহ বোধ করছিলেন দুজন, আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলেন অনেকদিন পর। সিদ্ধান্তে পৌছালেন তারাও ফেসবুকে পেজ ও গ্রুপ খুলে কাপড় বিক্রি করবেন।

পণ্যের সোর্সিং হিসেবে বেছে নিলেন বঙ্গবাজার, ইসলামপুরসহ পাইকারি মার্কেটগুলোকে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরাসরি ঘুরে দেখতে থাকলেন জায়গাগুলো, যতটুকু সম্ভব খোঁজ নিলেন, পণ্যের মান ও দাম সম্পর্কে আইডিয়া নিলেন, ইন্টারনেটেও বেশ ঘাঁটাঘাঁটি করলেন। তারপর উদ্যোগী হয়ে কাজে নেমে পড়লেন। প্রথম প্রথম  গ্রুপগুলোতে সেল পোস্ট দেওয়া শুরু করলেন। পেজের মাধ্যমে তেমন একটা বিক্রি না হওয়ায়, শুরু করলেন পোস্ট বুস্টিং এবং আনিস সাহেবের স্ত্রী ফেসবুক পেইজ থেকে লাইভ।

ধীরে ধীরে পরিচিতি বাড়তে থাকলো ও প্রতিদিন ভাল পরিমানে পণ্য বিক্রয় হচ্ছিলো। তারা নিয়মিত পেজ ও পোস্ট বুস্ট করতেন, লাইভ প্রচারণা চালিয়ে পণ্য বিক্রয় করতেন। তবে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় কী কী বিষয় রাখা প্রয়োজন কিংবা এর ভবিষ্যৎ কি হবে সেগুলো নিয়ে তেমন একটা ভাবলেন না। লকডাউন উঠে গেলে পরিস্থিতি যখন অনেকটাই স্বাভাবিক হওয়া শুরু করলো, আনিস সাহেব নতুন চাকরি শুরু করলেন। পূর্ণসময় দেওয়া অনেকটাই কঠিন হয়ে গেলো তার জন্য, তার স্ত্রী যতটুকু সম্ভব একা চেষ্টা চালালেন। কতটুকুইবা পুরোপুরি সামাল দেয়া যায়। এদিকে তিনিও শিক্ষার্থীদের পড়ানোতে ধীরে ধীরে মনোযোগী হয়ে উঠলেন তাই লাইভের প্রচারনাও কমে যায়। সারাদিন কাজ শেষে ক্লান্তি থাকায় পেইজে এবং গ্রুপে সময় দেয়া হয়ে ওঠে না। নতুন কন্টেন্টের অভাবে বুস্টিং করলেও তেমন বিক্রয় হয় না আগের মত৷ অবশেষে আনিস সাহেবের ব্যবসা থেকে মন উঠে যায় ও স্ত্রীকে জানিয়ে দেন ব্যবসাটি বন্ধ করে দিতে।

এখন ফেরত আসা যাক বাস্তবতায়। গল্পের আনিস সাহেব এবং তার স্ত্রীর মত এমন হাজারো মানুষ রয়েছেন যারা কোভিড-১৯ এর লকডাউনের সময়টাতে ই-কমার্সে এসেছিলেন৷ ফেসবুকে একটি পেইজ খুলে বুস্ট করে কিংবা লাইভ প্রচারনা চালিয়ে সাময়িক সময়ের সফলতাও পেয়েছেন। তবে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান, দক্ষতা এবং দূরদর্শিতার না থাকায় তারা বেশিদূর এগোতে পারেনি। তাই একটা সময়ে এসে জীবনের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফেরত যাওয়ায় কিংবা আশানুরূপ বিক্রয় না হওয়ায় অনিহা তৈরি হওয়ায়, বন্ধ হয়ে গেছে অনেকের ই-কমার্স যাত্রা।

২০২০ সালে এই ইন্ডাস্ট্রির প্রচার এবং প্রসার হয়েছে সব চাইতে বেশি। শহরের মানুষ তো বটেই গ্রামের মানুষের কাছেও এখন ই-কমার্সের ছোঁয়া পৌছাতে শুরু করেছে৷ অনলাইনে কেনাবেচা যে এত সহজ এবং বিশ্বাসযোগ্য সে ব্যাপারে সকলের মাঝে বিশ্বস্ততা আসতে শুরু হয়েছে। যে কারণে দেশের অর্থনীতিতে ই-কমার্স বেশ ভালো অবস্থানে যেতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে।২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি, ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজারে প্রবেশ করবে বলে আশা করা যায়৷ তবে শুধু মাত্র শখের বসে, পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে কিংবা অনেকটা হুজুগের বসে যারা উদ্যোক্তা হয়েছেন, তারা ইন্ডাস্ট্রির জন্য কতটা ঝুকিপূর্ণ এমন প্রশ্ন বেশ বড় চিন্তার খোঁড়াক হয়ে আমার মনে উঁকি দিচ্ছে। বাংলাদেশের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী সঠিক পরিকল্পনা, উপযুক্ত দিক-নির্দেশনা, প্রণোদনা এবং সেই মাফিক কার্যকরি উদ্যোগ, যার টেকসই উন্নয়নের প্রভাব পড়বে প্রতিটি স্তরে এবং ফলাফল হবে দৃশ্যমান। তাই সকলকে একজোট হয়ে কাজ করার আহবান জানাচ্ছি।

ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রিকে সমৃদ্ধ করতে সবথেকে বড় প্রয়োজন হলো জ্ঞান, মেধা, অধ্যবসায় ও পরিশ্রম। এখানে পুঁজি কম হলেও চলে। প্রযুক্তিগত দক্ষতার পাশাপাশি ব্যবসায়িক ধারণা থাকা অনেক বেশি জরুরি। নয়ত কোন ভাবেই ভালো করা সম্ভব নয়৷ জেনেবুঝে যদি এ লাইনে আসা যায় তবে এ সেক্টরে ভালো কিছু করা সম্ভব। হুজুগে চিন্তাভাবনা কখনই দীর্ঘমেয়াদে সফলতা বয়ে আনতে পারে না, বিশেষ করে ই-কমার্স সেক্টরেতো না-ই। সাময়িক লাভের মুখ দেখলেও টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয় কোন ভাবেই। যেটা পরিশেষে সামগ্রিকভাবে সকল উদ্যোক্তাদের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়াবে। এমতাবস্থায়, দেশের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি কতটা এগিয়ে যাবে প্রশ্নটা রয়েই যায়।

ঢাকা/সিনথিয়া/সাব্বির

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়