ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ইলিশের আচার নিয়ে নাদিয়ার উদ্যোগ

মিফতাউল জান্নাতি সিনথিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:২৭, ১০ এপ্রিল ২০২১  
ইলিশের আচার নিয়ে নাদিয়ার উদ্যোগ

নাদিয়া রওশন; পেশায় একজন উদ্যোক্তা, কাজ করছেন ই-কমার্স সেক্টরে। তার ফেসবুক পেজের নাম ‘Anu`s Dine-অনুর রান্নাঘর’। রাইজিংবিডির সঙ্গে আলাপে বলেছেন তার ব্যক্তিগত জীবন ও ব্যবসার নানান গল্প ও অভিজ্ঞতা। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন রাইজিংবিডির উদ্যোক্তা এবং ই-কমার্স পাতার কো-অর্ডিনেটর মিফতাউল জান্নাতি সিনথিয়া।

রাইজিংবিডি : আপনাকে স্বাগতম এবং শুভেচ্ছা।  কেমন আছেন?
নাদিয়া :
অনেক ধন্যবাদ।  জি, আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি।

রাইজিংবিডি : আচ্ছা, আপনিতো ই-কমার্স সেক্টরে কাজ করছেন। আপনার কাজের জগৎ সম্পর্কে জানতে চাই। তবে প্রথমেই আপনার ব্যক্তিজীবন নিয়ে জানতে চাচ্ছি।
নাদিয়া :
আমার জন্ম এবং বেঁড়ে ওঠা চাঁদপুরে। আমার পিতা-মাতা দুজনেই মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষক।  দুই ভাইবোনের মধ্যে আমি ছোট। শিক্ষাজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যায় স্নাতক এবং ওয়াইল্ড লাইফ বায়োলজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেছি। তবে সিজিপিএ ভাল থাকলেও চাকরির প্রতি কখনও আকর্ষণ বোধ হয়নি। পরিবারের সদস্যরা আমাকে বলতেন চাকরির পরীক্ষাগুলোতে অংশগ্রহণ করার জন্য, তবে আমি তেমন আগ্রহবোধ করতাম না। ততদিনে আমার বিয়ে হয়ে যায়, আল্লাহর রহমতে কন্যা সন্তানের মা হয়েছি। পরিবারের সদস্যদের ক্রমাগত আবদারের কারণে অনেকটা অনিচ্ছাকৃতভাবেই বিসিএস এবং কলেজ নিবন্ধন পরীক্ষা দেই।  শিশু সন্তান নিয়ে বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়া সহজ ছিল না, তাই বিসিএসে হয়নি। তবে কলেজ নিবন্ধন পরীক্ষায় নিজ উপজেলায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলাম। কিন্তু সিট খালি না থাকায় আমার আর চাকরি করা হয়ে ওঠেনি। হয়তো মন থেকে চাইনি বলেই চাকরির পেছনে আর সেভাবে ছোটাও হয়নি।

রাইজিংবিডি : আপনার ব্যবসায়ের শুরুটা নিশ্চয়ই সহজ ছিল না। শুরুর গল্পটা যদি বলতেন?
নাদিয়া :
ছোট থাকতে দেখতাম বাবা প্রতিদিনই স্কুল থেকে ফেরার সময় ‘জনকণ্ঠ’ পত্রিকা নিয়ে আসতেন। সেসময়ের পত্রিকার নারী ফিচারগুলো পড়েই হয়তোবা নিজে কিছু করার স্বপ্ন দেখতাম। অবসর সময়গুলোতে নিজের ড্রেস ডিজাইন করে সেলাই করতাম। তখন থেকেই বুটিক হাউজ করার প্রতি ঝোঁক কাজ করত। চাকরিতে না ঢুকলেও, মন চাইতো কিছু একটা করি, সময়টাকে কাজে লাগাই। কিন্তু ঘরে বাচ্চা রেখে, বুটিক হাউজ করার স্বপ্ন সফল করা সে মূহূর্তে সম্ভব ছিল না। তাই কেক বানানোর কাজ শিখে একটি স্কুলে বেশ কিছুদিন কেক ডেলিভারি দিয়েছি।

রাইজিংবিডি : এরপর?
নাদিয়া :
এর মধ্যেই জানতে পারি আমি দ্বিতীয়বারের মতো মা হতে চলেছি। কিছু কমপ্লিকেশনের কারণে পুরোদমে বেড রেস্ট নিতে হয়, তাই কেক নিয়ে কাজ আর হয়নি। দ্বিতীয় সন্তান হওয়ার পর থেকে শুরু হয় অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। একদিকে কাজকর্ম কিছু হচ্ছিলো না, অন্যদিকে বাচ্চাদের সামলে নিজের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও আর পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, যেন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। ভিন্ন কিছুতে নিজেকে ব্যস্ত রাখার তাগিদ বোধ করছিলাম। তাই মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় বিজনেসের চিন্তা মাথায় এলো। খাবারের আইটেম নিয়ে শুরু করে দিলাম।

রাইজিংবিডি : কী কী পণ্য নিয়ে কাজ করছেন আপনি?
নাদিয়া :
আমি বর্তমানে কাজ করছি নানা ধরনের আচার, পিঠা, মধু ও ঘি নিয়ে।

রাইজিংবিডি : ঠিক কোন ধরনের চিন্তা ভাবনা থেকে এমন পণ্য নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা আসলো?
নাদিয়া :
প্রথমত, হুট করে বাড়ির বাইরে যাওয়ার পথ সহজ ছিল না, আমার শ্বশুরবাড়ি থেকেও একরকম বিধিনিষেধ ছিল। তবে বাড়ির বউ অনলাইনে বিজনেস করবে, বিষয়টি সবাইকে বুঝিয়ে মতামত নিয়ে কাজে নামতে হোঁচট না খেলেও কিছু ব্যাপার আমাকে সামলে নিতে হয়েছে। আচার বানানোর নেশা ছিল আমার। আম ও জলপাইয়ের সিজনে আচার বানিয়ে সবাইকে খাইয়ে বেড়াতাম। তাছাড়া আমার মেঝ ভাসুরের অফলাইনে মধু নিয়ে ব্যবসা ছিল। আর অন্যদিকে বড় ভাসুর বাড়ির লোকেদের খাওয়ার জন্য খুলনা থেকে ঘি নিয়ে আসতেন। তাছাড়া যেহেতু ইলিশের শহর চাঁদপুরে আছি, ইলিশ নিয়ে কাজ করা আমার জন্য বেশ সহজ। এসব বিষয়গুলো ভেবেই পণ্যগুলো নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা তৈরি করি।

রাইজিংবিডি : কাজ করতে গিয়ে কখনো বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন?
নাদিয়া :
আমার ফেসবুক পেজের যাত্রা শুরু ২০১৬ সালে। তখন থেকেই টুকটাক লেখা পোস্ট করতাম, তাই পরিচিত অনেকে আমার পেজ সম্পর্কে জানতো। তবে আমি পুরোদমে কাজ শুরু করি ২০১৯ সালের অক্টোবর মাস থেকে। কাজ করতে গিয়ে সত্যিকার অর্থে তেমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। বরং বন্ধুমহল থেকে শুরু করে পরিচিত আত্মীয় স্বজনদের যে সাপোর্ট পেয়েছি তা আমার আত্মবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। তাছাড়া কাজ শুরুর কিছুদিন পর খুঁজে পাই ‘উই (উইমেন এন্ড ইকমার্স ফোরাম)’ গ্রুপকে, যা আমার উদ্যোক্তা জীবনের গল্পটিই বদলে দেয়।

রাইজিংবিডি : আপনার ব্যবসায়িক সফলতার কথা যদি বলতেন...
নাদিয়া :
আমার উদ্যোক্তা জীবনের শুরু প্রায় সতেরো মাস। পাঁচ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করেছিলাম। এই সতেরো মাসে প্রায় আড়াই লক্ষ টাকার আচার ও ইলিশ মাছ বিক্রি করেছি নিজের পেজ ও ‘উই’ গ্রুপের মাধ্যমে।
এই দীর্ঘ সময়ে ‘উই’ থেকে বিজনেসের খুঁটিনাটি অনেক কিছুই শিখেছি, জেনেছি এবং কাজে লাগিয়েছি। উই থেকে লাখপতি হয়েছি। ফোরামটির সঙ্গে থেকে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। চাঁদপুরে উইয়ের প্রতিনিধি হিসেবে জেলা প্রধান নির্বাচিত হয়েছি। বর্তমানে ফোরামটির ফেসবুক গ্রুপের মডারেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ শুরু না করলে হয়তো এই সম্মান কখনো পেতাম না। উইয়ের প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশা আপুর প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জানাই, এতো সুন্দর একটি প্লাটফর্ম তৈরি করার জন্য। আর কৃতজ্ঞতা জানাই রাজীব আহমেদ স্যারকে যার কাছ থেকে পেয়েছি বহু মূল্যবান তথ্য, দিকনির্দেশনা, এবং উৎসাহ।

রাইজিংবিডি : ব্যবসা নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
নাদিয়া :
অনেক ধরনের পণ্য নিয়ে কাজ করলেও, বর্তমানে বেশি মনোযোগ দিচ্ছি ইলিশ মাছের তৈরি আচারের উপর। এটি আমার ব্যবসায়ের সিগনেচার পণ্য। চাঁদপুরের তাজা ইলিশের স্বাদ সব এলাকার মানুষ পান না। তাই ইলিশের আচার হিসেবে আমার সিগনেচার পণ্যকে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দিতে চাই। তাছাড়া ইলিশের আচার দেশের বাইরেও রপ্তানির স্বপ্ন দেখি। নিজ ব্যবসায়ের পাশাপাশি আমার জেলা এবং জেলার উদ্যোক্তাদের তুলে ধরার চেষ্টা করছি।  ‘উই’ যেভাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে সম্মানিত করেছে, আমি চেষ্টা করবো সকল দায়িত্ব পালন করার। বাকি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে এটি আমার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজে দিবে।

রাইজিংবিডি : নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে আপনার কী কী পরামর্শ থাকবে?
নাদিয়া :
উদ্যোক্তা হওয়া কঠিন কিছু নয়, তবে টিকে থাকাটাই কঠিন কাজ। তাই কাজে নামার আগে জেনেবুঝে নামতে হবে, এ বিষয়ে পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই। অনেক সময় হতাশা চলে আসতে পারে। তবে সফল হতে হলে ধৈর্য ধরে কাজে লেগে থাকতে হবে। তাছাড়া উদ্যোক্তাদের নতুন কিছু গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকতে হবে। পরিশেষে বলব; অনুকরণ নয়, চারপাশ সবকিছু অনুসরণ করে নিজের পথ নিজেকেই সাজিয়ে নিতে হবে।

রাইজিংবিডি : আপনাকে ধন্যবাদ এবং শুভ কামনা রইলো।
নাদিয়া :
আপনাকেও অশেষ ধন্যবাদ।

ঢাকা/সাব্বির

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়