ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

রমজানে ই-কমার্সে খাবারের চাহিদা

প্রকাশিত: ১৬:৪১, ১২ মে ২০২১  
রমজানে ই-কমার্সে খাবারের চাহিদা

‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’, কথাটিতে আমরা সবাই বিশ্বাসী। স্বাস্থ্য ভালো থাকলে মন ভালো থাকে। আর মন ভালো থাকলে যেকোনো কাজে অনেক আগ্রহ পাওয়া যায়। তাই সুস্বাস্থ্যের জন্য ভালো খাবারের কোনো বিকল্প নেই। আর তা যদি হয় ঘরোয়া পরিবেশের তৈরি খাবার তাহলে নিঃসন্দেহে তা গ্রহণযোগ্য। কেনো না হোমমেড খাবার মানেই সতেজ ও টাটকা খাবার। কারণ অর্ডার আসার পরই কাঁচাবাজার সংগ্রহ করে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশে তৈরি করা হয় হোমমেড খাবার।

চলছে রমজান মাস। অন্যান্য মাসের তুলনায় এই মাসে সবার খাদ্য তালিকায় স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের পরিমাণটাই বেশি থাকে। আর এক্ষেত্রে হোমমেড খাবার নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য। সারাদিন রোজা শেষে সবসময় ইফতারির জন্য রান্না করাটা একটু কঠিন হয়ে যায়। যদি ঘরে হোমমেড ফ্রোজেন (হিমায়িত খাবার যা কাটা বাছা বা কোনো রকম ধোয়া বা ঝামেলা ছাড়াই ফ্রিজ থেকে বের করে ভেজে খাওয়া যায়) খাবার থাকে তাহলে এই কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। ঘরে যদি হোমমেড ফ্রোজেন খাবার থাকে তাহলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যেমন- এটি অনেকদিন ফ্রিজে রেখে সংরক্ষণ করা যায়, খাবার নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে না এবং সংরক্ষিত খাবার প্রয়োজনমতো পরিবেশন করা যায়।

ঘরে বসে ই-কমার্স ব্যবসার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হচ্ছেন অনেক নারী। তার মধ্যে রন্ধন শিল্পকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসাও অন্যতম। করোনাকালীনে যেসব নারীরা অনলাইনে ঘরে তৈরি খাবার নিয়ে ব্যবসায় সফল হয়েছেন, তাদের সঙ্গে কথোপকথনে জানা যায় ই-কমার্সে খাবারের চাহিদা। রমজানকে কেন্দ্র করে জীবনযুদ্ধে সংগ্রামী সেসব নারীদের ঘরে তৈরি খাবারের বেচাবিক্রির আদ্যপান্ত নিয়েই সাজানো হয়েছে প্রতিবেদনটি । 

নিশাত আলম (স্বত্ত্বাধিকারী, রুকাইয়া’স ডাইন)
বর্তমানে ই-কমার্স ও অনলাইনে খাবারের চাহিদা অনেক বেশি। বিগত একবছর ধরে অনলাইনে আমি সবধরনের হোমমেড ফুড নিয়ে ব্যবসা করছি। এবার রোজায় হোটেল  রেস্তোরাগুলি খুব বেশি খোলা না থাকায় অনেকেই অনলাইনে খাবার অর্ডার করছে। বাসায় তৈরি খাবার স্বাস্থ্যসম্মত হওয়ায় ক্রেতাদের চাহিদাও বেড়েছে। এধরনের খাবারের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো পছন্দ মতো টেস্ট ও মেনু কাস্টমাইজ করা। এই রমজানে আমি ডাক্তার ও রোগীসহ অনেককেই খাবার সরবরাহ করেছি। আমাদের পেজে সাস্থ্যসম্মত রুটি-পরাটা, ফ্রোজেন ইফতার ও সাহরি আইটেমও ছিল। এছাড়াও ঈদে থাকছে ডের্জাট আইটেমসহ নানারকম আয়োজন।

ফারহানা ইয়াসমিন রুমি (স্বত্ত্বাধিকারী, ফারহানা ফুড হাউজ)
করোনাকালীনে পারিবারিক দিক থেকে কিছুটা হতাশায় ছিলাম। ভেবেছিলাম সেলাই কাজ দিয়ে কিছু একটা করবো। কিন্তু সেটা খুব সুবিধা করতে পারছিলাম না। তারপর ভাবলাম ঘরে তৈরি খাবার নিয়ে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করি। যদিও পরিবার থেকে সবাই বাঁধা দিয়েছিল খাবার নিয়ে কাজ করতে। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। ফেসবুক পেজের মাধ্যমে একদিন একটা খাবার আইটেম তৈরি করে পরিচিত অনেকের কাছে খাবারটা নিয়ে গেলাম। সবাই বেশ ভালোই প্রশংসা করেছিল। সেই থেকে ঘর সংসার সামলিয়ে  বাড়তি সময়টুকু কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি।   

আমি হোমমেড আচার, পিঠা ও ফুড আইটেমগুলোতে ক্রেতাদের থেকে ভালো সারা পেয়েছি। বাড়ির তৈরি খাবার স্বাস্থ্যকর, এই ব্যপারটা সবাই ভালো সাপোর্ট করেছে। রমজানের ইফতারি, পর্দা বিরিয়ানিসহ সবধরনের খাবারের চাহিদা মোটামুটি ভালো ছিল। 

কামরুন্নেছা রোকসানা (স্বত্ত্বাধিকারী, রোকসানা’স ডাইন)  
বর্তমান ই-কমার্সের সুবাদে আমাদের জীবন অনেকটা সহজ হয়েছে।  খুব সহজেই আমরা ঘরে বসেই পছন্দমত হোমমেড খাবার অর্ডার করতে পারছি। এরই ধারাবাহিকতায় আমার উদ্যোগ ‘রোকসানা'স ডাইন’ থেকে এই রমজানে বেশ কিছু অনলাইন অর্ডার আসে। গুণগত মান ঠিক থাকার জন্য ফ্রোজেন খাবার যেমন- ডিম চপ, চিকেন কাটলেট, চিকেন আলুরচপ, চিকেন পটেটো বল, চিকেন বল এবং চিকেন ভেজিটেবল রোলসহ অন্যান্য খাবার। এছাড়াও ইফতারি উপকরণ হিসেবে পেঁয়াজু, ছোলা, বেগুনি, চিকেন আলুরচপ অর্ডার আসে। এর পাশাপাশি মেইন ডিশ হিসেবে রাতের খাবারও অর্ডার পেয়েছি। পরিশেষে ধন্যবাদ জানাই রাইজিংবিডিকে যাদের সাহায্যে আজ আমি নিজের উদ্যোক্তা জীবন সম্পর্কে কিছু বলার সুযোগ পেয়েছি। সবার সুস্থ্যতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

রুবাইদা রিয়াত রাখী (স্বত্ত্বাধিকারী, ভর্তা বাহার ও ফুড ক্যাটারিং)
গত বছরগুলোর তুলনায় এই রমজানে অনলাইনে খাবারের চাহিদা বেশিই ছিল বলে আমি মনে করি। সারাদিন রোজা রেখে খাবার তৈরির ঝামেলা এড়াতে অনেকেই অনলাইনে অর্ডারকৃত হোমমেড খাবারের উপর নির্ভর করেছেন। ঘরে তৈরি স্বাস্হ্যকর খাবার এবং একটু গরম বেশি থাকাতে সবার চাহিদার কথা মাথায় রেখেই খাবার তৈরি করছি। ইফতারে রেগুলার খাবারে যার যার পছন্দ অনুযায়ী ডাল ভাত অর্থ্যাৎ ভর্তা বাহার ও দেশি খাবার থেকে শুরু করে ছোলা, বেগুনি, পেয়াজু, ডিম ও আলুর চপ, কাবাবের মতো সকল আইটেম রাখা ছিল আমার পেজের মেনুতে। রমজানে আমার বেশ ভালো অর্ডার এসেছে। অন্য সময়ের মতো রেগুলার খাবারগুলোরও অনেক চাহিদা ছিল গ্রাহকদের।

শেফ তানজিনা আফরোজ নীশো (স্বত্ত্বাধিকারী, তানজিনা’স কুকারি অ্যান্ড কেকারি)
অনলাইনে রমজান মাসে হোমমেড খাবার বলতে সর্বপ্রথম ক্রেতার লিস্টে থাকে ফ্রোজেন ফুড। রমজান মাসে আমরা সবাই ইফতারিতে ভাজা-পোঁড়া খেয়ে থাকি। ফ্রোজেন ফুডগুলো ইফতারির আয়োজনকে অনেক সহজ করে দেয়। আর বাচ্চারা ইফতারিতে যে ভাজা পোঁড়া যেমন- পেয়াজু, বেগুনি, আলুরচপ এগুলোর চেয়ে ফ্রোজেন চিকেন ললিপপ, চিকেনরোল, চিকেন বল , চিজ বল, স্ট্রিপ চিকেন এগুলো বেশি পছন্দ করে। তাই রমজানের শুরুতেই ফ্রোজেন ফুডের চাহিদাটা বেশি দেখা গেছে। আর একটা খাবারের নাম না বললেই নয়, তা হলো তেহারি। একনাগারে কয়েকদিন ভাজা-পোঁড়া খাবার পর সাধারণত সরিষার তেলের তেহারিটার চাহিদা দেখা যায় প্রচুর।

পুরো রমজান মাস জুড়েই দইবড়ার চাহিদা ছিল প্রচুর। সারাদিন রোজা রাখার পর সবারই একটু টক ঝাল মিস্টি খাবার খেতে ইচ্ছা হয়, তাই দইবড়া পছন্দের শীর্ষে ছিল। এছাড়াও হালিম, জিলাপি ও বুন্দিয়াও ইফতারিতে সবার পছন্দের লিস্টে থাকে। যদিও এই খাবারগুলো দোকানে পাওয়া যায় বা গিয়েছে, কিন্তু যারা হোমমেড খাবার খেয়ে অভ্যস্ত তারা বাইরেরটা না খেয়ে অনলাইনেই কিনেছে। আর রোজার শেষ ১০দিন সবচেয়ে বেশি যা বিক্রি হয় তা হলো হোমমেড ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা সেমাই। তাই অনলাইনে হোমমেড লাচ্ছা সেমাইয়ের চাহিদা এখন সবচেয়ে বেশি। কারণ ক্রেতা এখন স্বাস্থ্যকর খাবার বলতে হোমমেড খাবারের উপরই আস্থা রাখে।

শারমিন সুলতানা (স্বত্ত্বাধিকারী, ঢাকাইয়া খাবার)
আমার উদ্যোক্তা জীবন শুরু ২০২০ সালের রমজান মাসে। ঘরে তৈরি খাবারের চাহিদা সবসময় জনপ্রিয় হলেও করোনার জন্য ঘরে তৈরি খাবারের ব্যাপক চাহিদা লক্ষ্য করেছি। সবাই এখন খুব সাস্থ্য সচেতন। তাই আমার খাবারে আমি যথেষ্ট হাইজিন মেইনটেইন করি। আমার খাবারের বিশেষত্ব আমি কোন রকম বাসি খাবার দেই না এবং মাংসও স্টক করা থাকে না। খাবার ডেলিভারি দেওয়ার এক বা দুদিন আগে বাজার করি। 

এই রমজানে ইফতারের জন্য ঘরে তৈরি খাবারের ব্যাপক সারা পেয়েছি। সবচেয়ে বেশি চাহিদা ছিল ফ্রোজেন আইটেম এবং আমার সিগনেচার পণ্য বা ডিশ মাটন কোরমা। আমার পেজ থেকে ইফতারে একদিনে প্রায় ৭০ জনের জন্য শাহী মোরগ পোলাও এবং ঢাকাইয়া মাটন পাক্কি বিরিয়ানি রান্না করি। সবচেয়ে ভালো লেগেছে ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে ডাক্তারদের জন্য ইফতারের অর্ডার পেয়েছিলাম। নিজে গিয়ে ডেলিভারি দিয়ে আসি যাতে স্বাস্থ্যমান নিয়ে কোন ঝুঁকি না থাকে। 

করোনায় অসুস্থ পরিবারের জন্যও ঘরে তৈরি খাবারকে এখন সবাই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। সারাদিন রোজা থেকে সবাই ফ্রেশ খাবারটাই চায়। আর এক্ষেত্রে ঘরে তৈরি খাবারের কোন বিকল্প নেই। আমরা যারা ঘরে তৈরি খাবার নিয়ে কাজ করছি, আমাদের সবার কাছেই ক্রেতাদের একটা আস্থা থাকে। ক্রেতাদের এই আস্থার জায়গা ধরে রাখা আমাদের দায়িত্ব। খাবার শুধু রান্না করে দিলেই হবে না, খাবারের গুনগতমান যাতে সঠিকভাবে বজায় থাকে তাই রান্না করার সময় যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

অনলাইন ক্রেতারা ঘরের খাবার সবার নিশ্চিত মনে খেতে পারে। কেনো না এখানে কোন বাসি বা পোঁড়া তেল ব্যবহার করা হয় না। আমরা যদি খাবারের গুনগত মান বজায় রেখে ক্রেতাকে বেস্ট সার্ভিস দিতে পারি তাহলে ঘরে তৈরি খাবারের জনপ্রিয়তা আরো বাড়বে বলে আমি মনে করি। প্রয়োজন শুধু সততার সঙ্গে কাজ করে এগিয়ে যাওয়া।

ঢাকা\সিনথিয়া

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়