ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

অর্ধশতাব্দী শহরের মাটির নিচে জ্বলছে শয়তানের আগুন

শাহিদুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৬, ১৭ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অর্ধশতাব্দী শহরের মাটির নিচে জ্বলছে শয়তানের আগুন

পৃথিবী রহস্যময়। এখানে অনেক কিছুই ঘটে যার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাই বলে বিষয়টি মিথ্যে হয়ে যায় না। আবার অনেক কিছুই রয়েছে যার ব্যাখ্যা আছে, কিন্তু মানুষ তা এড়িয়ে যেতে পারে না। এই রহস্যময়তায় মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যদি বলা হয়, একটি শহর; যেখানে মাটির নিচে অর্ধশতাব্দী ধরে আগুন জ্বলছে, নেভানো যাচ্ছে না- আপনি কতটুকু চমকে উঠবেন? বিলিভ ইট অর নট- ঘটনাটি সত্য। এই আগুনকে বলা হচ্ছে শয়তানের আগুন! যে আগুনে পুড়ে শহরটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বাসিন্দারা পালিয়েছেন বহু আগে। তারপরও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। পর্যটক ছুটছেন সেই আগুনে পোড়া শহর দেখতে।

সেন্ট্রালিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্বের অঙ্গরাজ্য পেন্সিলভেনিয়ার কলম্বিয়া কাউন্টির ছোট্ট এক শহর। কয়লা খনি এবং খনিগুলোকে কেন্দ্র করে বিকশিত ব্যবসা-ব্যাণিজ্যের কারণে একসময় এই শহরটি ছিল য্ক্তুরাষ্ট্রের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। তবে অর্ধশতক আগে শহর কর্তৃপক্ষের এক অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে আজ সবকিছুই ইতিহাস। এখন সেন্ট্রালিয়া মানেই মাটির নিচে জ্বলন্ত আগুনের কারণে পরিত্যাক্ত এক ভুতুড়ে শহর।

সেন্ট্রালিয়া শহরের গোড়া পত্তন ঘটে ষোল শতকের মাঝামাঝি ঔপনিবেশিক শক্তির হাত ধরে। তারা স্থানীয় উপজাতির কাছ থেকে পাঁচশ পাউন্ডের বিনিময়ে জমি কিনে নেন। তারাই মূল ভূ-খণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য রিডিং রোড নির্মাণ করেন। বর্তমানে সেই রাস্তাই সেন্ট্রালিয়ার প্রধান সড়ক, যা ‘রুট-৬১’ নামে পরিচিত। ষোল শতকে সেন্ট্রালিয়া শহরের যাত্রা শুরু হলেও বিকাশ হয় মূলত উনিশ শতকের মাঝামাঝি। ১৮৫৪ সালে শহরে রেলপথ নির্মিত হয় যা ছোট্ট এই জনপদকে মূল জনপদের সঙ্গে আরও নিবিড় যোগাযোগের সুযোগ করে দেয়। এরপর উনিশ শতকের শেষের দিকে কয়লা খনিগুলো আবিষ্কৃত হতে থাকে। যা সেন্ট্রালিয়াকে দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পরিণত করে।  

ঔপনিবেশিকদের হাতে গোড়া পত্তনের সময় সেন্ট্রালিয়ার কোন নির্দিষ্ট নাম ছিল না। ১৮৩২ সালে জনাথন ফাউস্ট নামে এক ব্যক্তি শহরে একটি সরাইখানা চালু করেন। তখন সেন্ট্রালিয়া রোরিং টাউনশিপ কাউন্টির অন্তর্ভূক্ত ছিল। তিনি সেন্ট্রালিয়ার প্রথম নাম দেন- বুলস হেড। সরাইখানাটি এই নামেই ছিল। এর  বছরদশেক পর বুলস হেড কিনে নেয় লোকাস্ট মাউন্টেন কোল এন্ড আইরন কোম্পানি। এই কোম্পানির খনি প্রকৌশলী অ্যালেক্সান্ডার রে সেখানে পরিকল্পিতভাবে একটি শহর গড়ে তোলার চিন্তা করেন। তিনি বুলস হেড পাল্টে শহরের নাম দেন- সেন্টার ভাইল। তবে ১৮৬৫ সালে এই নামের উপর ইউএস পোস্টাল সার্ভিসের  নিষেধাজ্ঞা আসে। কারণ তারা এই নামে একটি পোস্টাল কোড অন্য শহরে আগে থেকেই বরাদ্দ দিয়েছেন। ফলে আবারও নাম বদলে ১৮৬৫ সালে শহরের নতুন নামকরণ করা হয় সেন্ট্রালিয়া।

সেন্ট্রালিয়ার প্রথমদিকের বাসিন্দারা অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত থাকলেও ১৮৫৬ সালে কয়লা খনি আবিষ্কৃত হওয়ার পর মানুষের আয়ের মূল উৎসে পরিণত হয় শহরের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ওই খনিগুলো। সেই সঙ্গে কাঠের বদলে শহরের সম্পূর্ণ জ্বালানির যোগানও শুরু হয় খনি থেকে উত্তোলিত কয়লা থেকে। এককথায় ছোট্ট এই শহরের সব কর্মকাণ্ড হয়ে পড়ে কয়লাকেন্দ্রিক। ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে বাসিন্দাদের সংখ্যা। হাতে গোনা কয়েকজন লোক থেকে ১৮৯০ সালে শহরের জনসংখ্যা এক লাফে প্রায় তিন হাজারে পৌঁছে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত হয় এই শহর।

কিন্তু যেখানে অর্থ আছে সেখানে স্বার্থের সংঘাত থাকবে না তা কি হয়?  সেন্ট্রালিয়াতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ১৮৬০ সালে মলি মাগুইরস নামে একটি গুপ্ত সংঘের আবির্ভাব হয় সেন্ট্রালিয়ায়। মূলত আয়ারল্যান্ডভিত্তিক এই সংঘটি খনি শ্রমিকদের মালিকের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে। ঐতিহাসিক ডারলি বি জনসনের মতে, সে সময় শহরে ঘটে যাওয়া আলোচিত সব হত্যার সঙ্গে এই দলের সদস্যরা জড়িত ছিল। অভিযোগ রয়েছে, দলের সদস্যরা  শহরের প্রতিষ্ঠাতা অ্যালেক্সেন্ডার রে এবং সেন্ট্রালিয়ার প্রথম যাজক ডেনিয়েল ইগনাইটাস ম্যাকডারমটকেও খুন করে। পরবর্তী সময়ে ১৮৭৭ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুপ্ত সংঘের বেশ কিছু নেতাকে ধরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়ার পর সেই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।

এরপর প্রায় এক শতাব্দী সুন্দরভাবে চলতে থাকে সেন্ট্রালিয়ার জীবনধারা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব পড়লেও সেন্ট্রালিয়ার উপর খুব বেশি পড়েনি। কিন্তু ভীষণ ঝড়ের পূর্বে প্রকৃতি যেমন শান্ত রূপ ধারণ করে তেমনি প্রায় এক শতাব্দী শান্ত থাকার পর সেন্ট্রালিয়ার আকাশে দুর্যোগের মেঘ জমে ১৯৬২ সালের মে মাসে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সেন্ট্রালিয়া সম্পদশালী হলেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নেহায়েতই গরিব। শহরের বাসিন্দাদের  আবর্জনা ফেলার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা ছিল না। তারা পরিত্যাক্ত কয়লা খনিকে ময়লার ভাগাড় হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। এছাড়া যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেলার কারণে শহরব্যাপী তীব্র গন্ধ এবং ইঁদুরের উৎপাত শুরু হয়। ফলে শহর কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় আসন্ন মেমোরিয়াল ডে ( যুক্তরাষ্ট্রের নিহত সেনা সদস্যদের স্মরণে মে মাসের শেষ সোমবার) উপলক্ষে শহর পরিষ্কার করা হবে।

সেই লক্ষ্যে শহর কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় সব ময়লা-আবর্জনা আগুনে পুড়িয়ে ফেলবে। ঐতিহাসিক ডেভিড ডি কক এই পদক্ষেপকে সেন্ট্রালিয়ার মতো খনিজ শহরের জন্য একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনিসহ একাধিক গবেষক মনে করেন, পরিচ্ছন্নতার এই উদ্যোগ থেকেই আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে। কারণ পুড়তে থাকা আবর্জনা বাতাসে উড়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রথমদিকে আগুন লাগার খবরে শহর কর্তৃপক্ষ ও বাসিন্দারা খুব বেশি আতঙ্কিত হয়নি। তারা বেশ কয়েকবার প্রচেষ্টা চালায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। ছড়িয়ে পড়া জ্বলন্ত আবর্জনার স্পর্শে আগুন পরিত্যক্ত খনি থেকে এর সঙ্গে যুক্ত কয়লা বোঝাই খনিতেও ছড়িয়ে পড়ে। আর সেখান থেকেই সেন্ট্রালিয়া পরিণত হতে শুরু করে জ্বলতে থাকা জীবন্ত এক অগ্নিকুণ্ডে।  

আগুন নেভানোর উপায় না দেখে খনির মালিকরা খনি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। আগুনের শিখা শহরের নিচের কয়লা খনির অন্যান্য শাখাতেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। মাটির নিচে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে। যা শহরের আবহাওয়া উত্তপ্ত করে তোলে। এছাড়া পুড়তে থাকা কয়লার ধোঁয়ায় অতিরিক্ত কার্বন মনোক্সাইড নিঃসরণের ফলে বাড়ির মাটির নিচের ঘরগুলোর ছিদ্রপথে বিষাক্ত গ্যাস প্রবেশ করতে শুরু করে। বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবে শহরের বাসিন্দারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। পোড়া মাটির উত্তাপে শহরের রাস্তা-ঘাট ফেটে যায়। কোথাও কোথাও গভীর ফাটলের সৃষ্টি হয়। বাড়িগুলো হেলে পড়তে থাকে। আগুনের কারণে সৃষ্ট এই বিপদে শহরের বাসিন্দাদের কেউ কেউ শহর ত্যাগ করতে থাকে। আবার অনেকে আশায় বুক বেঁধে থেকে যায়। তবে দিনে দিনে পরিস্থিতি জটিল হতে শুরু করে। একপর্যায়ে ১৯৯২ সালে মার্কিন কংগ্রেস পেন্সিলভেনিয়ার অন্যত্র শহরবাসীদের স্থানান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করে। বেশিরভাগ শহরবাসী এ প্রস্তাবে রাজি হলেও সাতজন মানুষ সেখান থেকে চলে যেতে অস্বীকৃতি জানান।

ওই বছরই বন্ধ করে দেওয়া হয় শহরের প্রধান সড়ক রুট-৬১। বাতিল করা হয় ডাক বিভাগ থেকে সেন্ট্রালিয়ার জন্য বরাদ্দ পোস্ট কোড। সেন্ট্রালিয়াকে বাঁচানোর চেষ্টা গত অর্ধশতকে বহুবার করা হলেও ভয়াবহ এই আগুন নেভানোর কোনো কিনারা করা যায়নি। কারণ শহরের চারপাশে শিরা-উপশিরার মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য কয়লা খনি। কয়লা বোঝাই এই সুড়ঙ্গগুলোর কোনটিতে যে আগুন এখনো জ্বলছে তা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। তাই সেন্ট্রালিয়া শহর আজও জ্বলছে। পরিবেশ সংরক্ষণ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী- এ আগুন আরও এক শতাব্দী জ্বলার আশঙ্কা রয়েছে।

সেন্ট্রালিয়া তার অধিবাসীদের কাছে দুঃখের কারণ হলেও বর্তমানে পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়। শহরের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা কিছু ঘরবাড়ি, গির্জা আর বন্ধ করে করে দেয়া সড়ক রুট-৬১ দর্শনার্থীদের আকর্ষণের অন্যতম কারণ। বর্তমানে এই রাস্তায় আঁকা হয় অদ্ভুত সুন্দর সব আল্পনা, সে কারণে এই রাস্তার নামই হয়ে গেছে- গ্রাফিতি রোড বা আল্পনা সড়ক।

বাঙালি নারীর যেমন বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। সেন্ট্রালিয়াও যেন বাঙালি নারীর প্রতিচ্ছবি। অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে পরিত্যক্ত এই শহরটি তার বুকের গভীরে ধারণ করে আছে জ্বলন্ত এক অগ্নিকুণ্ড। ধিকি ধিকি জ্বলছে আর তার দীর্ঘশ্বাস কালো ধোঁয়া হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়