ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

বাবা আমার আদর্শ, পথ প্রদর্শক

কেএমএ হাসনাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৩, ২০ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
বাবা আমার আদর্শ, পথ প্রদর্শক

আমি যখন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র তখন আমরা বাবা আমাদের ছেড়ে পরপারে পাড়ি দিয়েছেন। সময়টা খুব সম্ভবত ১৯৬৩ কিংবা ১৯৬৪ সাল হবে। জীবনের উপর অতি মাত্রায় অসচেতন ছিলেন। ঠিক আর দশজন রাজনৈতিক কর্মীর মতোই। হ্যাঁ, আমার বাবা সক্রীয় রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। ভারতীয় কংগ্রেসের কট্টর সমর্থক ছিলেন। সেই সুবাদে জীবনের একটি বড় সময় কেটেছে কলকাতায়।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পরও অনেক দিন আসা-যাওয়া ছিল। ১৯৫৬ সালে তিনি স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। জোতদার পিতার একমাত্র সন্তান ছিলেন আমার বাবা। অনেকটা প্রাচুর্যের মধ্যেই মানুষ হয়েছেন। কিন্তু অর্থ-সম্পদের প্রতি ছিলেন উদাসীন। আমার দাদা মারা যাওয়ার পর তার রেখে যাওয়া সব সম্পদ বেহাত হয়ে যায়। এ নিয়ে আমার বাবার কোনো ক্ষোভ ছিল না। নিকটাত্মীয়রা সব ভোগ করছিলেন। যার যতটুকুতে ভোগদখল ছিল সে সেটুকু মেরে দেন। ফলে মৃত্যুর সময় বাবা অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মারা যান। রেখে যান আমাদের মা, দু’ভাই আর পাঁচ বোনকে।

খুব অল্প বয়সে আমরা বাবাকে হারিয়েছি। ফলে তার স্মৃতিচারণ করা কঠিন। অনেকটা বড় হওয়ার পর আমার মা এবং নিকটজনদের কাছ থেকে কিছুটা শুনেছি। সেই খণ্ডস্মৃতি ‘বাবা দিবস’ উপলক্ষে আমার বাবাকে উৎসর্গ করছি।

দেশের প্রখ্যাত চিকিৎসক গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা.জাফরউল্লাহ চৌধুরীর বাবা হামদু মিয়া চৌধুরী ছিলেন মির্জাপুর থানার বড় দারোগা (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা)। সেই সুবাদে তার মা আমার দেখা একজন মহিয়সী নারী। তিনি ছিলেন আমার মার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। মহিয়সী বলছি এই কারণে তিনি ছিলেন স্বর্ণগর্ভা। তার সবগুলো সন্তানই প্রতিষ্ঠিত। সবার ছোট ছেলে মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল্লা চৌধুরী আমার ছোট বেলার বন্ধু। যোগাযোগটা নিয়মিত ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করার সময় রাজনৈতিক কারণে যখনই কোনো সমস্যায় পড়তাম সোজা আশ্রয় নিতাম বকশীবাজারের উমেশ দত্ত রোডের বাড়িতে। একবার সবাই ড্র্ইং রুমে আড্ডা দিচ্ছি তখন খালাম্মা ছোট বেলায় কে কেমন দুষ্টু ছিলাম বলছিলেন। সবার কথা বলা শেষ, খালাম্মা থেমে যান। এমন সময় সবার ছোট বোন মিলি চৌধুরী (নামকরা চিত্রশিল্পী, জাপানের একটি বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করেছেন) বললো, মা সবার কথা বললে কিসমত ভাইয়ের কথা বললে না। উনি কি ছোট বেলায় খুব ভালো ছিলেন?

খালাম্মা মৃদু হেসে বললেন, ওর কথা শুনবি? যে কয়জনের কথা এতক্ষণ বললাম তার মধ্যে কিসমত ছিল সবচেয়ে দুষ্টু। ও কেমন দুষ্টু ছিল শুনবি, ওর যন্ত্রণায় ওর বাবা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে ঘর থেকে বের হতে পারতেন না। পায়জামার উপরে লুঙ্গি পরে ঘাড়ে গামছা নিয়ে গোসল করার কথা বলে বের হতে হতো। না হলে পেছনে পেছনে দৌড়ে যেতো। এতটা দুষ্টু ছিল।

এই ঘটনা আমার মার কাছে জিজ্ঞেস করলে তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছিলেন। এর সঙ্গে তিনি যোগ করে বলেন, একবার উল্লাপাড়ার একটি ব্রীজের ঠিকাদারি কাজ পান তোমার বাবা। অনেক দিন কাজ দেখতে যেতে পারেননি। সেদিন যাওয়ার সময় তুমি তার পিছু নিয়েছিলে। কোনোভাবেই রেখে যেতে পারছিলেন না। কেঁদে কেঁদে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লে তিনি রওয়ানা হন। কাজ শেষ করে দুদিন পর যখন বাসে করে অন্যত্র যাচ্ছিলেন তখন দেখেন একেবারে তোমার মতো একজন কাঁদতে কাঁদতে রাস্তা দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বাস থেকে নেমে গিয়ে ওই ছেলের পেছনে দৌড়ে গিয়ে ধরেন। দেখেন তুমি না। পরে ছেলেটিকে অনেক কিছু কিনে দিয়ে তার বাবার হাতে তুলে দেন।

আগেই বলেছি আমার বাবা একজন রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। তার রাজনৈতিক কর্মকান্ড ছিল কলকাতাকেন্দ্রীক। থাকতেন কলকাতার শ্যামবাজার। শ্যাম বাবুর ছোট ভাই মহারাজ আমার বাবাকে খুবই স্নেহ করতেন।

১৯৪৭ সালে আমার বড় ভাইয়ের জন্ম। তার জন্মকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ দিন কলকাতা যাওয়া হয়নি। দেশ ভাগের কয়েকদিন আগে আমার বাবা কলকাতা যান। সোজা গিয়ে উঠেন তার আশ্রয়স্থলে। মহারাজ দেখতে ঠিক মহারাজের মতই ছিলেন। আমার বাবা যখন সেই বাড়িতে প্রবেশ করেন তখন দেখেন, যে বাড়ি লোকে-লোকারণ্য থাকে সেই বাড়ি একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেছে। আমার বাবাকে দেখে বাড়ির পুরোনো কাজের লোক গোপাল দৌড়ে এসে মহারাজের বিবরণ দেন।

বিবরণটা এ রকম, শ্যামবাজারেই একটি আশ্রম ছিল। সেই আশ্রমে একজন সাধুবাবা ছিলেন। সব সময় নানা তদবির নিয়ে আসা লোকের ভিড় লেগেই থাকত। একদিন সেই সাধুবাবা মহারাজের হাত দেখে বলেন আপনার আয়ু বেশিদিন নাই। বড়জোর আর মাত্র এক মাস বাঁচবেন। অপঘাতে আপনার মৃত্যু হবে। পরিবারের সবাই সাধুবাবার কথা বিশ্বাস করে। তাকে কোথাও বের হতে দিত না। এর মধ্যে মহারাজ অপঘাতে মৃত্যুর চিন্তায় বিশাল বপু আর লম্বা এবং সুদর্শন মানুষটা একেবারে খাটের সঙ্গে পিঠ লেগে যাওয়ার অবস্থা। আমার বাবা যখন মহারাজের কাছে যান তখন মহারাজ বলেন, মাস্টার তুমি এসেছ। আমি যে আর বাঁচবো না। আম মাত্র ৭ দিন পরেই আমার মৃত্যু হবে।

এ কথার পর আমার বাবা কিছু না বলে উঠে যান। বাড়ির বাইরেই ছিল কেন্দা গাছ (কাঁটাযুক্ত)। সেখান থেকে একটি মোটা ডাল কেটে সেটা পেছনে লুকিয়ে সাধুবাবার আখড়ায় উপস্থিত হন। তখন সাধুবাবা ভক্ত পরিবেষ্টিত হয়ে কাউকে রাজা বানাচ্ছেন, কাউকে ফকির। নিঃসন্তান মহিলাদের সন্তানের জন্য ব্যবস্থা দিচ্ছেন। কেউ এসেছেন সন্তানের ভালো রেজাল্টের জন্য তদবির নিয়ে। দুহাতে উজাড় করে যে যা পারছেন সাধুবাবার চরণযুগলে সমর্পণ করছেন।

ওই এলাকায় আমার বাবা খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। বিশেষ করে কলকাতায় দাঙ্গার সময় তার ভূমিকার জন্য সবাই খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখতো। অনেক দিন পর তাকে দেখে এলাকার লোকজন কুশল বিনিময় করছিলেন। কিন্তু আমার বাবা নিঃশ্চুপ, কারো কথার কোনো উত্তর দিচ্ছিলেন না। শুধু কখন মহিলা দর্শনার্থীরা চলে যাবেন তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। একসময় সবাই চলেও গেলেন। একটু ফাঁকা হতেই আমার বাবা সাধুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। হাতের কাঁটাযুক্ত ডালের সজোর এবং ক্রমাগত আঘাতে সাধুর পিঠ রক্তাক্ত। অনেকেই তাকে বিরত করার চেষ্টা করে এক সময় সাধুকে উদ্ধার করে সরিয়ে নিতে সক্ষম হন।

ওই সাধু এলাকায় অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন। তার উপর একজন মুসলমানের এহেন আক্রমণ অনেকেই মেনে নিতে না পেরে তারা আমার বাবার উপর চড়াও হওয়ার চেষ্টা করে অন্যদের বাধার মুখে নিবৃত হন। সাধুকে কেন মারা হলো? জানতে চাইলে বাবা বলেন, এই সাধু কতজনকে কত কিছু বানান। মহারাজ দাদাকে বলা হয়েছে তিনি একমাস পরে মারা যাবেন। এই চিন্তায় তিনি শয্যা নিয়েছেন। আপনারা কি তা জানেন? সে যদি হাত দেখে এত কিছুই বলতে পারেন। তা হলে কেন আজ এখানে এসেছেন? ঘর থেকে বের হওয়ার আগে যদি নিজের হাত দেখে আসতেন তা হলে তো জানতে পারতেন, আজ তিনি আমার হাতে মার খাবেন। পরে স্থানীয়রা ওই সাধুকে এলাকা ছাড়া করেন। পরে মহারাজ বিস্তারিত জানতে পারেন। এবং ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেন। এরপরও তিনি ১০ বছর বেঁছে ছিলেন।

আমার বাবা একজন অসাম্প্রদায়িক এবং মুক্ত চিন্তার সচেতন মানুষ ছিলেন। তার অনেক কথা আমার মার মুখ থেকে শুনেছি। আর একটি ঘটনা। একসময় আমাদের মির্জাপুর সদয় কৃঞ্চ হাইস্কুলের খুব সুনাম ছিল। এই স্কুলে পিএইচডি ডিগ্রীধারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন। দেশের অনেক খ্যাতিমান শিক্ষক এই স্কুলে শিক্ষাদান করতেন। সেই সুবাদে বহুদূর থেকে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের এখানে পড়াতে পাঠাতেন। দূরের ছাত্রদের জন্য লজিং ব্যবস্থা ছিল। আমার বাবা যখন এলাকায় থাকতেন তখন তিনি কোন বাড়ির কোন ছাত্র কি করছে তার খোঁজ নিতে রাতে বের হতেন। একদিন রাতে দেখলেন একগলি দিয়ে কয়েকজন কম বয়সের ছেলে অনাগোনা করছে। কাছে গিয়ে ‘কইতরি’ নামের এক মহিলার সঙ্গে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখতে পান। আর যায় কোথায় হাতের কেন্দার ডাল দিয়ে বেদম পিটুনি দেন।    

পরের দিন বিকেলে থানার এক অফিসার এসে বড় দারোগা দেখা করতে বলেছেন বলে জানান। তার সঙ্গে আমার বাবা থানায় গিয়ে তাকে ডাকার কারণ জিজ্ঞেস করলে বড় দারোগা বলেন, কাল রাতে আপনি এদের মেরেছেন? আমার বাবা বলেন, আমি ওই তিনজনকে মেরেছি। আমার বাবাকে দেখে ছাত্র তিনজন বলেন উনি আমাদের অভিভাবক, আমরা অন্যায় করেছি অভিভাবক হিসেবে তিনি আমাদের মেরেছেন। উনার বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগ নাই।

তখন বড় দারোগা আমার আব্বাকে বলেন, মাস্টার সাহেব তিন ছাত্রকে মেরেছেন। ওরা বলছে ওদের কোনো অভিযোগ নেই। ঠিক আছে, তবে এই নষ্টা মহিলাকে কেন মারলেন? মহিলা আপনার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এখন তো আমার কিছু করার নেই। আমার বাবা এর জবাবে বলেন, দারোগা সাহেব আপনি কি ওকে যে মেরেছি তার দাগ দেখেছেন। বড় দারোগা বলেন, না দেখিনি। তখন আমার বাবা বলেন, ছাত্র তিনজনের দাগ আর ওই মহিলার দাগ একটু পরীক্ষা করে দেখেন, এক কিনা? এই মহিলা গত পাঁচদিন আগে মার খেয়েছে। সেই দাগ দেখিয়ে আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তখন মহিলার দাগ পরীক্ষা করে দেখা যায় অনেক আগের ক্ষত চিহ্ন। দারোগা আমার বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে বাসায় চলে যেতে বলেন। মিথ্যা মামলার জন্য মহিলাকে মহুকুমায় (তখনও টাঙ্গাইল জেলা হয়নি) চালান করে দেন।

অনেকদিন পরে জেনেছি, ওই ছাত্রদের মধ্যে একজন ডাক্তার, একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং একজন নামকরা শিক্ষক হয়েছিলেন। তারা অপকটে স্বীকার করতেন, আমার বাবার জন্যই তাদের জীবনের মোড় ঘুড়ে গিয়েছিল।

আবার বাবার কাছে তার সব সন্তানের মধ্যে আমাকে একটু বেশিই আদর করতেন বলে আমার মার কাছে শুনেছি। ছোট সময় দুষ্টুমি করতাম প্রচুর। তবে পড়ালেখাটাও ঠিকমত করতাম। আর আমার মধ্যে নাকি অনেক মানবিক গুণ ছিল। দুষ্টুমির জন্য মায়ের হাতে অনেক মার খেয়েছি। আমার বাবা আমাকে একবারই একটা থাপ্পড় দিয়েছিলেন। খাওয়ার সময় ভাত ফেলে খাওয়ার কারণে। থাপ্পড় খেয়ে আমি আমার বাবার মুখের দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ চেয়ে ছিলাম। পরে আমার বাবা রাতে শোওয়ার সময় বুকে জড়িয়ে বলেছিলেন, বাবা তোমাকে মারলাম কেন জানো? আমি চুপ। বাবা বললেন, কোনো সময় ভাত ফেলে খাবে না। আমাদের চারপাশে অসংখ্য মানুষ না খেয়ে থাকে। আর আমরা যারা এত কষ্ট করি শুধু দুমুঠো ভাতের জন্য। এত খারাপ কাজ আর কিছু হয় না। কখনো খাবার ফেলে খাবে না। যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু নেবে। প্রয়োজনে বারবার নেবে। আমি এখনো বাবার সেই উপদেশটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করি।

বাবা বলতেন, সব সময় মানুষের পাশে থাকবে, নিরন্ন মানুষের মুখ সামান্য অন্ন তুলে দিয়ে যে তৃপ্তি পাবে তা অন্য কোন কাজে পাবে না। কর্ম জীবনে সততা আর নিষ্ঠার কোন বিকল্প নাই। কারো উপকার করতে না পারলেও তুমি কারো ক্ষতির কারণ হবে না। এই কয়টা কথা মৃত্যুর আগে তিনি বলে গিয়েছিলেন। পারি না, তবে সব সময় চেষ্টা করি। কারণ আমার জীবনাদর্শ আমার বাবা, আমার পথ প্রদর্শক প্রকৃত শিক্ষক এবং পরমপ্রিয় বন্ধু আমার বাবা।

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়