ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

পানি সংকটের পথে যে ১১ গুরুত্বপূর্ণ শহর

মাহমুদা মিতুল ইভা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫৯, ২৫ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পানি সংকটের পথে যে ১১ গুরুত্বপূর্ণ শহর

প্রতীকী ছবি

মাহমুদা মিতুল ইভা : যদিও পৃথিবীর ৭০ ভাগই পানি কিন্তু পানযোগ্য পানির পরিমাণ মাত্র ৩ শতাংশ। ৯৯ শতাংশ অলবণাক্ত পানি হিমবাহ এবং বরফক্ষেত্রে পরিণত হয়ে আছে। প্রতিটি মহাদেশেই পানযোগ্য পরিষ্কার পানির যথেষ্ট অভাব রয়েছে।

* কেপ টাউন, দক্ষিণ আফ্রিকা
দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন, আধুনিক বিশ্বে প্রথম বড় কোনো শহর যেটি তীব্র পানিসঙ্কটে পড়েছে। স্বল্পমাত্রার বৃষ্টিপাত আর বাঁধগুলোর পানির লেভেল কম থাকায় শহরটিতে প্রায় পানি না থাকার মতো অবস্থা দাঁড়িয়ে গেছে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে করা এক জরিপ অনুযায়ী, দীর্ঘ তিন মাস ধরে শহরটিতে চরম পানিসঙ্কট থাকার কথা; কিন্তু সেখানে পানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের ফলে পানি স্বল্পতা মোটামুটি কম দেখা যাচ্ছে যা ২০১৯ সালের লক্ষ্যমাত্রায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। শহরটির বাসিন্দাদের প্রতিদিন মাত্র ৫০ লিটার পানি ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ১০ মিনিটের একটি গোসলে ২০ থেকে ৫০ লিটার পানি খরচ হয় এবং শৌচাগারের একটি ফ্ল্যাসে প্রায় ৯ লিটারের মতো পানি খরচ হয়ে থাকে।

* মেক্সিকো সিটি, মেক্সিকো
১৯৫০ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে মেক্সিকোর ভৌগলিক সীমানার তুলনায় সম্পদ বেড়েছে ১০০ গুণ আর জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৭ গুণ। মেক্সিকোর খালগুলো নিশ্চিহ্ন করে এবং মাটির নিচে থাকা জলস্তরের উপর কর ধার্য করে এটি সম্ভব করে তোলা হয়েছে। মেক্সিকো সিটির ৪০ শতাংশ পানি অনেক দূর থেকে জাহাজে বহন করে এনে সরবরাহ করা হয় এবং প্রচুর পরিমাণ পানি পরিবহন সমস্যার কারণে নষ্ট হয় অথবা চুরি হয়ে যায়। ৫ জনের মধ্যে একজন মহানগরের বাসিন্দা প্রতিদিন পানির সরবরাহ পান না। কেউ সপ্তাহে একদিন সরবরাহ পান, কেউ মাসে একদিন বা তারও বেশিদিন পরে পানি সরবরাহ পান। অনেকে ট্রাকে করে পানির সরবরাহ নিয়ে থাকেন।

* জাকার্তা, ইন্দোনেশিয়া
জাকার্তা শহরের প্রায় ৪০ শতাংশ সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে অবস্থান করে এবং প্রায়ই শহরটি পানিতে প্লাবিত হয়ে যায়। শহরটি প্রায়ই বন্যার কবলে পড়ে এবং বৃষ্টিপাত হলেও তা পুরু কংক্রিটের স্তর ভেদ করে মাটিতে পৌঁছাতে পারে না। পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহকৃত পানি অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে জাকার্তার অর্ধেকের বেশি মানুষ নিজেদের প্রয়োজন মতো কূপ তৈরি করে নিতে বাধ্য হয়েছে। অবৈধভাবে অধিক পরিমাণে কূপ তৈরির কারণে পাথর ও মাটি প্রচন্ড পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শহরে বন্যার সৃষ্টি হয়। অবৈধ কূপ খনন এবং বন্যা আটকাতে হলে জাকার্তা শহরে পরিষ্কার, পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহকৃত পানি প্রয়োজন যদিও সরকার থেকে এখনও কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

* কায়রো, মিশর
মিশরের ৯০ শতাংশ পানির সরবরাহ আসে নীলনদ থেকে। কিন্তু সেই সরবরাহ এখন ঝুঁকির সম্মুখীন কেননা ইথিওপিয়া নীলনদের স্রোতের মুখে বাঁধ তৈরি করছে যা ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী ৬০ শতাংশ প্রস্তুত হয়ে গেছে। কায়রোতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে পানির সঠিক সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য যেন শহরটি পানির অভাবে না পড়ে।

* সাও পাওলো, ব্রাজিল
২০১৪ এবং ২০১৫ সালে ব্রাজিলের সাও পাওলো শহর এবং আশপাশের পৌরসভাগুলো চরম পানি ঘাটতির শিকার হয়। পানিমজুদকারী বিভিন্ন দপ্তর থেকে মাত্র ৫ শতাংশ পানি বরাদ্দ দেওয়া হয় যা দিয়ে একটি শহরে মাত্র এক মাস পানি সরবরাহ করা সম্ভব ছিল। মহাবন আমাজানের রেইন ফরেস্ট দিনে দিনে উজাড় হয়ে যাওয়া এবং কর্তৃপক্ষের দুর্বল পরিকল্পনা নিম্ন বৃষ্টিপাতের কারণ হয়ে উঠেছে। সাও পাওলো শহরে একবার প্রচন্ড পানিস্বল্পতা দেখা দেয় যা ২০ দিন স্থায়ী হয়েছিল, সেইবার একটানা একটা বৃষ্টি হওয়ায় শহরটি রক্ষা পায়। শেষমেশ ২০১৬ সালে সেই সমস্যা মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। তবে বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, শহরটি পানি খুব দ্রুত ব্যবহার করছে।

* বেইজিং, চীন
২০১৪ সালে চীনে ৭৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যের একটি কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয় বেইজিং শহরে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ অব্যাহত রাখার জন্য। চীনের বৃষ্টিবহুল দক্ষিণ অঞ্চল থেকে উত্তরাঞ্চল হয়ে বেইজিং শহরে পানি সরবরাহের জন্য এই অত্যাধুনিক পানি-প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এখন রাজধানী শহর বেইজিং-এর ৭০ শতাংশ পানির সরবরাহ হয় চীনের অন্যান্য অঞ্চল থেকে। তবে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং নগরায়নের কারণে প্রাকৃতির সম্পদের ক্ষতি বিবেচনায় পর্যাপ্ত পানি ধরে রাখতে আরো উন্নত সমাধান প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

* চেন্নাই, ভারত
২০১৪ সালে তীব্র খরার ফলে চেন্নাইয়ের ৬টা খাল শুকিয়ে যায় এবং মাটির নিচে থাকা পানিতেও এর যথেষ্ট প্রভাব পড়ে। চেন্নাই শহরে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের বসবাস। এই খরার ফলে তারা প্রচন্ড পানি ঘাটতির শিকার হয়। তারা তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পানির মাত্র অর্ধেক সরবরাহ পেয়েছিল। কিছু এলাকায় পাইপলাইনে সরবরাহকৃত পানি সপ্তাহে সর্বোচ্চ তিন থেকে চার দিন পাওয়া যেত এবং তা মাত্র ১-২ ঘণ্টার জন্য।

* লস অ্যাঞ্জেলেস, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র
২০১৪ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, লস অ্যাঞ্জেলেস আমেরিকার অন্য কোনো শহরের তুলনায় বেশি পানি ঘাটতিজনিত ঝুঁকির মুখে রয়েছে। যদিও লস অ্যাঞ্জেলেসে মাটির নিচে থাকা পানির যথেষ্ট মজুদ আছে এবং নদীসংযোগের মাধ্যমে পানি সরবরাহেরও ভালো ব্যবস্থা রয়েছে, তারপরও বিশেষজ্ঞরা বলেন সেখানে খরাসমস্যা সমাধানের জন্য সঠিক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। লস অ্যাঞ্জেলেসের ৮০ শতাংশ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ না করে সমুদ্রে নিষ্কাশন করে দেওয়া হয় যাতে শহরে কোনোরকম বন্যা সৃষ্টি না হয়। বেড়ে চলা জনসংখ্যা এবং সুদীর্ঘ খরার কথা মাথায় রেখে শহরটিতে পানির সংরক্ষণ এবং নবায়ন কর্মসূচির পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

* ঢাকা, বাংলাদেশ
২০১৬ সালের এক জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকায়, মাটির নিচে থাকা পানির স্তর ২০০ ফুট নেমে গেছে ৫০ বছর আগের তুলনায়। প্রতিবছর এই স্তর ৯ ফুট করে আরো নিচে নেমে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, শহরে অতিরিক্ত পরিমাণে পাম্প ব্যবহারের ফলে শহরের বাইরে থাকা এক বিশাল জনসংখ্যা পর্যাপ্ত পরমাণ পরিষ্কার পানি সরবরাহ পায় না। তবে বিশাল এই শহরটি পানির সংকট থেকে মুক্ত নয়। সুমদ্রের পানি পানযোগ্য পানির স্তরে প্রতিনিয়ত প্রবেশ করার ফলে ঢাকা শহরে পানযোগ্য পানি শেষ হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।

* বেঙ্গালুরু, ভারত
বিগত কয়েক বছরের খরার ফলে ভারতের বেঙ্গালুরু শহরে প্রচন্ড পানির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ২০০০ সালের দিকে ভারতের সিলিকন ভ্যালিতে জনসংখ্যা প্রায় দিগুণ বেড়ে যায় এবং নগর উন্নয়নের নামে শতাধিক খাল ভরাট করে ফেলা হয়। এর ফলে বৃষ্টির পানি মাটি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না, যা পানি ঘাটতিজনিত সমস্যার অন্যতম কারণ। ২০১৬ সালে একজন গবেষক বলেন, পানির অভাবে শহরটি আগামী চার বছরের মধ্যে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। বেঙ্গালুরু শহরে বর্তমানে পানির সমস্যা তীব্র আকার ধারণ না করলেও শহরটি ঝুঁকির মুখে নেই তা কিন্ত বলা যাচ্ছে না। শহরের অর্ধেক জনগণ ট্যাংকে সংরক্ষিত পানির ওপর নির্ভর করে থাকে কেননা পাইপলাইনগুলো অতিরিক্ত শুষ্কতার কারণে অচল হয়ে থাকে।

* মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং আবহাওয়া পরিবর্তনের ব্যাপারগুলো বিবেচনা করে এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, মেলবোর্ন শহরে ২০২৮ সাল নাগাদ বর্তমানের তুলনায় আরো কয়েকগুণ পানি বেশি প্রয়োজন হবে। এই বিপুল পরিমাণ পানি সরবরাহ বেশ কঠিন এক পরিস্থিতির জন্ম দেবে মেলবোর্নে। লবণাক্ত পানি পরিশুদ্ধ করে পান করার জন্য সেখানে নতুন এক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও তা মাত্র ০.১ শতাংশ পানি সরবরাহ বৃদ্ধি করবে যা পানির চাহিদা অনুযায়ী খুবই সামান্য।

তথ্যসূত্র : রিডার্স ডাইজেস্ট

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ মার্চ ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়