ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

ডাক অনুকরণ করে ধোকা দেয় পাতা বুলবুলি

শামীম আলী চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২৫, ১০ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ডাক অনুকরণ করে ধোকা দেয় পাতা বুলবুলি

শামীম আলী চৌধুরী: ছুটি বা অবসর সময় পেলেই ছুটে যাই বনে। রাজধানী ঢাকার খুব দূরে নয়। ফলে হবিগঞ্জ জেলার সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান আমার খুব প্রিয় একটি জায়গা।  হবিগঞ্জের রাতের বাস ধরে খুব ভোরে পৌঁছানো যায় সেখানে। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসের শেষের দিকে রওনা হলাম সাতছড়ির উদ্দেশ্যে। খুব ভোরে নেমে পড়লাম জগদীশপুর মোড়ে। ভোরের আলো ফোটার পর একটি সিএনজি নিয়ে রওনা হলাম সাতছড়ির দিকে। ভোর সাড়ে ছ’টার দিকে বনের প্রবেশ মুখে নামতে হলো। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে রওনা দিলাম বনের ভিতর ওয়াচ টাওয়ারের উদ্দেশ্যে।

১০০ ফুট উঁচু টাওয়ারে ওঠার পর শুরু হলো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। বৃষ্টির পানিতে সবুজের সজীবতা বেড়ে গেছে। গাছের সবুজ পাতাগুলি যেন তাদের যৌবন ফিরে পেলো। এ এক নয়নাভিরাম দৃশ্য! কোনো অবস্থাতেই চোখ বন্ধ করতে পারছিলাম না। সবুজের রূপে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম প্রকৃতির মাঝে। আধা ঘণ্টা পর বৃষ্টি থামলো। বৃষ্টি থামার সঙ্গে সঙ্গে বনের হরেক প্রজাতির পাখির কিচির-মিচির শব্দে মুখরিত হয়ে উঠলে পুরো বন। ডালে বসে ভিজে যাওয়া পাখিরা তাদের ঠোঁট দিয়ে চিরুনীর মত আঁচড়ে পালকগুলো রোদে শুকিয়ে নিচ্ছে। প্রকৃতির অলঙ্কার বনের পাখির এই অপরূপ দৃশ্য নিজ চোখে অবলোকন করার শান্তি যেন ভিন্নতর। এদের কার্যকলাপ দেখার সময় চোখের সামনে গাছে এসে বসলো একটি সবুজ রঙের পাখি। যে পাখিটি আগে কখনো দেখিনি। নাম ‘পাতা বুলবুলি’।

 

এরা Chloropsis পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ১৮- ২০ সে.মি. দৈর্ঘ্যরে ২৮ থেকে ৩০ গ্রাম ওজনের ছোট আকারের একটি বৃক্ষচারী পাখি। ৭টি উপপ্রজাতির মধ্যে বাংলাদেশে Chloropsis aurifrons প্রজাতির পাখিটি পাওয়া যায়। পূর্ণবয়স্ক ‘পাতা বুলবুলির’ দেহের উপরি ভাগ ও নিচের অংশ সবুজ। মুখ ও গলা থেকে থুতনি পর্যন্ত কালো বর্ণের। গলার উপরি অংশ বেগুনী-নীল। ঘাড়ের পাশ ও বুকের উপরি অংশে কালো রঙের, বাইরে হলদে-সোনালী রঙের একটা বেড় আছে। কপাল সোনালী-কমলা বর্ণের। এদের কাঁধে উজ্জ্বল নীল বর্ণের পট্টি দেখা যায়। ঠোঁট বাঁকানো ও কালো। চোখ কালো-বাদামী। সবকিছু মিলিয়ে পাখিটিকে অপরূপ সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। খালি চোখে দেখলে মনে হবে এ যেন চিত্রশিল্পীর তুলির আঁচড়ে রঙ করা একটি ছবি।

পাতা বুলবুলি পাতাঝরা বন, বৃক্ষবহুল বাগান অপ্রধান বন ও চিরসবুজ বনে বিচরণ করে। সচরাচর জোড়ায় জোড়ায় এক বৃক্ষ থেকে অন্য বৃক্ষের ডালে বসে। মাঝে মাঝে ছোট দলেও থাকে। এরা লোকালয়ে খুব একটা আসে না। গাছের ঘন পাতায় ও উচুঁ ঝোপ-ঝাড়ে এরা খাবার খুঁজে বেড়ায়। এদের খাদ্য তালিকায় পোকা-মাকড়, ফুলের রস বা মধু, রসালো ফল ও পাকড় ফল রয়েছে। নিজেরাই নিজেদের খাবার খুঁজে খায়। অন্য কারো খাবারে হানা দেয় না। মোটামুটি শান্ত স্বভাবের পাখি। এরা সিংহরাজের মত অন্য পাখির ডাক অনুকরণ করতে পারে।

 

জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত এদের প্রজনন সময়। প্রজননের সময় বনের ভিতরে ছোট গাছ বা ডালে ঘাস, পাতা ও মাকড়সার জাল দিয়ে বাটির মতো করে নিজেরাই বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় মেয়ে পাখিটি ২-৩টি ডিম পাড়ে। পুরুষ ও মেয়েপাখি উভয়েই ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। বাচ্চাদের লালন-পালন বা যত্নাদি দুজনে মিলে করে থাকে। এরা বাংলাদেশে বিপদমুক্ত আবাসিক পাখি। সব বনে বা চিরসবুজ বনে পাওয়া যায়। সিলেট, রাঙামাটি, কাপ্তাই, চট্টগ্রামের বন ছাড়াও ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, মিয়ানমার ও ভিয়েতনামসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এদের বিচরণ রয়েছে।

বাংলা নাম: পাতা বুলবুলি

ইংরেজি নাম: Golden-fronted Leafbird

বৈজ্ঞানিক নাম: Chloropsis aurifrons

লেখক ছবিগুলো সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে তুলেছেন

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ জুলাই ২০১৯/হাসনাত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়