ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

আঁধার ঘেরা সকাল

এম. উমর ফারুক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩৫, ২৫ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আঁধার ঘেরা সকাল

এম. উমর ফারুক: বিদ্যুৎ নেই। রুমের সবগুলো জানালা বন্ধ। থাই গ্লাসের জানালায় বাহিরের আলোয় কিছুটা আবছা দেখা যায়। রুমে ফ্যান নেই। ভ্যাপসা গরম। একফোঁটা আলো বাতাস কিছুই নেই।গরমে গা দরদর করে ঘামছে। আতঙ্ক আর গরমে শার্ট ঘামে ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে গেছে নজরুলের। জন্মের পর বাবা-মা নাম নিয়ে ভাবনায় পড়েছিল। তার মা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা পড়েই ভক্ত হন। তাই কবিকে স্মরণ করে ছেলের নাম রেখেছিলেন নজরুল ইসলাম। কিন্তু ভাগ্যে কী নিমর্ম পরিহাস। পাড়ার লোকজন তাকে কানকাটা নজরুল বলে ডাকে। ছোটবেলায় কাগজ টোকাতে গিয়ে বস্তির লোকমানের সাথে দ্বন্দ্ব হয়। এক পর্যায়ে ব্লেড দিয়ে লোকমানের কান কেটে দেয়। এ জন্য নজরুলকে জেলও খাটতে হয় কয়েক মাস। এরপরেই হয়ে ওঠে কানকাটা নজরুল।বাবা ছিল কাগজ বিক্রেতা।শহরের অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে পুরাতন কাগজ কিনেন এবং বিক্রী করেন। মা বাসা বাড়িতে ছুটা বুয়ার কাজ করত। মহাখালীর সাততলা বস্তিতে নজরুলের জন্ম।জন্মেও পর থেকে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারেনি সে। অভাব অনটন আর কস্টেও সঙ্গে যুদ্ধ করেই বড় হয়েছে।

প্রত্যেকদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই নজরুলকে কাগজ টোকাতে পাঠাতো ওর বাবা। অভুক্ত পেটে চোখ ডলতে ডলতে উস্কোখুস্কো চুল, নোংরা ছেঁড়া গেঞ্জি-লুঙ্গি পরা অবস্থাতেই বের হয়ে যেত বস্তা কাঁধে নিয়ে। কোথায় খাবে সকালের খাবার ঠিক জানা নেই। আদৌ খাওয়া জুটবে কিনা তাও জানে না। বাসায় ওর বাবাকে প্রত্যেকদিন কমপক্ষে ৩০ টাকা দিতে হয় কাগজ বিক্রি করে। না হলে বাসার ভাত বন্ধ। প্রচুর মারধরও করে ওর বাবা ওকে। যেদিন টাকা বেশি রোজগার করতে পারত না সেদিন ভয়ে বাসায় আসতো না। চেয়ে চিন্তে কিছু খেয়ে নিয়ে ফুটপাতে, রাস্তার ডিভাইডারের ওপর কিংবা ওভার ব্রিজের ওপর ঘুমিয়ে থাকতো। ভোরে উঠে পথে পলিথিন, বোতল, রিক্সার স্পোক, কাগজ, লোহা-লক্কর এই সব হাবি জাবি খুঁজতে হয়। নজরুলের বন্ধুরাও এই কাজে যায়। সবাই আলাদা আলাদা টোকায়। কখোনো কখোনো পাল্লা দিয়ে দুই তিনজন এক সাথে টোকায়। সবার একটা সাধারণ দুশমন ছিলো সেটা হলো সব পাড়ার কুকুরগুলো। কোনো এলাকার কুকুরই ওদের দেখতে পারতো না। দেখলেই ধাওয়া দিত। আবার লোকজনদের হাতে প্রত্যেক দিনই মারধোর খেত, গালমন্দ শুনত।

একদিন এক বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই কোত্থেকে এক লোক হঠাৎ এসে ওর হাত শক্ত করে ধরে বললো, পাইছি তোমারে চান্দু। ওই কুত্তার ছাও কাইল এইহান থিকা পানির পাইপগুলা চুরি কইরা কই বেচ্ছস ক? বলতে বলতেই হাতে লম্বা একটা কাঠের তক্তা এগিয়ে দেয় কে যেন। চ্যাপ্টা তক্তা দিয়ে মারতে লাগলো আর বলতে লাগলো- জানতাম তুই লোভে পইরা আইজও আসবি। কই বিক্রি করছস পাইপ গুলা ক? হারামাজাদা ক?

নজরুল চিৎকার করে বলে- ছার আমি নেই নাই ছার। আমি বেচি নাই ছার। আল্লার কসম ছার আমি চুরি করি না। আইজই প্রথম আপানেগো বাসায় আইছিলাম বোতল টোকাইতে। নজরুলের আকুতি মিনতিতে হয়তো আকাশ কেদেছে। হয়তো পাথর কেদেছে। তবুও ছাড়েনি। নির্দয়ভাবে মেরেছে নজরুলকে। সারা শরীর চওড়া চওড়া দাগে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলো সেদিন। একদিন প্রচন্ড ক্ষুধায় ঝটপট করছে নজরুল। পকেটে টাকা নেই খাবার কিনে খাবে। কয়েকদিন ধরে অসুস্থ্য থাকায় কাগজ টোকাতে পারেনি। ক্ষুধার যন্ত্রণায় অস্থিও হয়ে মহাখালীর ওয়ারলেস গেটের পাশে এক হোটেলের সামনে খাবারের জন্য ঘুরঘুর করছিলো। এই দেখে হোটেল মালিক ওর দিকে গরম চা মেরেছিল। মাথার কিছু অংশ পুড়ে গিয়েছিলো সেবার। মাথার সেই অংশে এখনও চুল ওঠে না। আরেকদিন ওর চেয়ে বয়সে বড় এক টোকাই বস্তা সহ ওর মালপত্র কেড়ে রেখে দেয়। সেই নিয়ে ওর সাথে মারমারি লাগে। মারের বেশির ভাগটি ওর ভাগেই জুটেছিলো। এরকম মারধোর ওর কপালে কত জুটেছিলো তার হিসেব নেই।

হঠাৎ অন্ধকার ঘরটাতে আলো জ্বলে উঠল। সিলিং অনেক ওপরে। মৃদু একটা আলো। সবকিছু আবছা দেখা যাচ্ছে। সাত দিন কেটে গেছে ওই বদ্ধ করে। আলো জ্বলার সাথে সাথে ভয়ে ওর বুকটা ধক্‌ করে উঠলো। আবার একপ্রস্থ মারপিট হয়ে যাবে হয়তো ওর ওপরে। ঘরের পশ্চিম কোণে একটা মজবুত লোহার গেট। আরেক কোণায় একটা টেবিল। দুটি চেয়ার রাখা টেবিলটার এপার ওপার। চেয়ারের সাথে হাত পা বাঁধা নজরুলের। প্রথম কদিন নজরুল শক্ত থাকার চেষ্টা করলেও এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। আর সব বলেও দিয়েছে ও যা জানে। কিন্তু ওরা আরো জানতে চায়। তাই দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে চলেছে। পশ্চিম দিকের দরজাটা খুলে গেলো। পুলিশের পোষাক পরা জনা পাঁচেক লোক ঢুকলো। টেবিলের উল্টোদিকে মুখোমুখি চেয়ারে এক নতুন অফিসার বসলো। এতদিন এ অফিসারকে নজরুল কখনো দেখেনি। অফিসারটি বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো- কি নজরুল সাহেব? কি খবর? এখন শরীরটা কেমন বোধ করছেন?

ছার পানি খামু একটু পানি খাওয়ান। মৃদু শুকনো কণ্ঠে কথাটা বলেই একবার ঢোক গেলার মতো করলো নজরুল।

অফিসারটি ইশারা করতেই এক জওয়ান পানি আনতে চলে গেলো। আর কিছু খাবেন নজরুল সাহেব? অফিসারটি প্রশ্ন করল। ছার গরম সিঙ্গারা খাইতে মন চায়। লগে এককাপ দুধ চা। অফিসার ইশারা করতেই ঘরের এককোণায় গিয়ে ওদের মধ্যে একজন মোবাইলে গরম সিঙ্গারা আর চায়ের কথা বলে দিলো। নজরুল সাহেব আপনি তো লোকটা খুব কাজের। অফিসারটি এক নিঃশ্বাসে বলে যেতে লাগলো। এত কিছু পেটে নিয়ে ঘুরেন আগে বললেই তো গত সাতদিনের মারধোর গুলো করা লাগতো না। আপনি যে তথ্য গুলো দিয়েছেন সব যাচাই বাছাই করেছি আমরা। সবই সত্যি। এর মধ্যে আপনার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পাঁচ হাজার বোতল ফেনসিডিল, দশটি আগ্নেয়াস্ত্রসহ খিলগাঁও থেকে চাকু মিজান নামে একজন, যাত্রাবাড়ী থেকে ইরা নামে এক ইয়াবা সম্রাজ্ঞীকে বিশ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট সহ গ্রেপ্তার করেছি। এছাড়াও বগুড়া শহর থেকে কালা আলম, রফিকও জব্বার নামে অস্ত্রসহ তিন তালিকা ভুক্ত সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করেছি। সবই তো ঠিক আছে কিন্তু...

কিন্তু কী ছার?

নজরুল সাহেব একটা হিসেব তো মেলাতে পারছিনা না। একজন এমপি তার এলাকার এক কমিশনারকে খুন করিয়েছে এই তথ্য তো আমরা মানতে পারছি না। ছার এই নজরুল মিথ্যা কথা কয় না। খারাপ কাজ করতে পারি কিন্তু আমি যে

প্রমাণ গুলার কথা কইলাম, আপনেরা মিলাইয়া দেখেন, প্রমাণ পাইবেন। কমিশনার আক্কাস ভাইরে এমপি আতাউর খুন করাইছে। কেন খুন করাইছে ? অফিসার জিজ্ঞেস করলো।

এলাকায় চান্দাবাজির টাকা নিয়া গন্ডোগোলের সুত্রপাত। তাছাড়া আগামী সংসদ নির্বাচনে কমিশনার আক্কাস এমপি হওয়ার আগ্রহ দেখাইছে। এলাকায় আক্কাসের পক্ষে লোকজন গণসংযোগ চালানো শুরু করে দেয়। দিন দিন আক্কাস ভাইয়ের শক্তি বাড়তে ছিলো। এলাকার রাস্তা ঘাটের কাজ-কাম, প্লট দখল, বস্তি দখল নিয়া দুইজনের মধ্যে বনিবনা হইতাছিলো না। যার কারনে এমপি সাহেব তাকে খুন করান।

সবই জানেন দেখছি। শোনেন এইবার সত্যি কথা বলি। এম.পি. সাহেব আসছিলো ক্যাম্পে। এসে আমার সাথে কোটি টাকার চুক্তি করে গেছেন। যাতে এই খুনে তাকে জড়ানো না হয়। আপনার গ্রেপ্তারের কথা শুনেই এসেছিলো। বুঝেতেই পারছেন আপনার ওপর নাখোশ তিনি। উনার ডান হাত ছিলেন আপনি এক সময়। পরে আক্কাসের হয়ে কাজ করা আপনার জন্য ভালো সিদ্ধান্ত হয় নাই। এরই মধ্যে চা, সিঙ্গারা, পানি চলে এলো। হাত পা খুলে দেয়া হলো অফিসারের ইশারায়। নজরুল খুব মনোযোগ দিয়ে চুপচাপ শিঙ্গারা-চা খেতে লাগলো। আর কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? করলে বলেন আমি আপনার জন্য আনিয়ে দেবো। নজরুলের চুপচাপ থাকা দেখে অফিসারটি এবার ভরসা দেয়া কণ্ঠে বললো, আপনি বলেন যা খেতে চান বলেন। সাতদিন এতো মারধোর করলো আপনাকে এটা ঠিক হয় নাই। আমি থাকলে মারতে দিতাম না। বলেন কি খাবেন?

ছার তেহারি খাইতে ইচ্ছা করে খুব। বলেই নজরুল চুপ হয়ে গেলো। এই সাত দিন যেন তার কাছে সাত বছরের মতো মনে হয়েছে। মনে হয় কত বছর খোলা হাওয়া খায় না। ছকমলের দোকানের চা, সাইফুলের সিঙ্গারা, ময়না হোটেলের তেহারি খায় না। খাওয়া দাওয়া হতেই হাত পা বেঁধে অন্ধকার ঘরে রেখে চলে যায়। আবার সেই অন্ধকার রুমে একা নজরুল। ছোটো বেলার কত কথা মনে হতে লাগলো তার হিসাব নেই। টোকাই থেকে টেম্পোর হেলপার হওয়া, তারপর নেশা করা, খারাপ বন্ধুদের সাথে মেশা, সন্ত্রাসী লাইনে যোগ দেয়া, প্রথম খুনের দিন, প্রেমে পরার পরে মেয়েটিকে নিয়ে ঘুরতে যাবার প্রথম দিন। আরো কত কি?

টেম্পোতে যখন হেল্পারি করতো তখন চলন্ত টেম্পোতে উঠতে গিয়ে পা ভেঙে যায়। দেড় মাস বিছানায় পড়েছিলো। তখন ওর বাবার অকথ্য গালগালি শুনতে হতো প্রতিদিন। বাবা বলতো হারামজাদা মরলেও তো পারতি। তোরে কে এমন

বসাইয়াই বসাইয়া ভাত খাওয়াইবো। পঙ্গু সাইজা ঘরে পড়ে আছো? আইজই কামে যাবি কুত্তার বাচ্চা। ঘরে তোর খানা নাই আইজ থিকা। সেই যে পরের দিন ঘর থেকে রাগ করে নজরুল বের হলো আর কোনো দিন সে ঘরে ঢোকে নাই। মাঝে মাঝে মায়ের সাথে দেখা করতে যেতো। মাকে এটা ওটা কিনে দিতো। মাসে মাসে হাত খরচ দিতো। বাবার সাথে কোনোদিন

কথা বলতো না। একদিন রোড এক্সিডেন্টে বাবাও মারা গেলো। মাকে নিজের কাছে নিয়ে এসে রাখলো। ছেলে কোথায় যায় কি করে মা ঠিকমতো জানতে বুঝতে পারতো না। প্রশ্ন করলেও উত্তর পেতো না। নজরুলের বয়স তখন বাইশ তেইশ

হবে। এলাকায় সন্ত্রাসী হিসেবে সবে নাম ডাক শুরু হয়েছে। দলে মিটিং-মিছিলের আগে, কোন মারামারিতে আগে, কোপাকুপিতে রামদা হাতে সবার আগে। এসব কারনে এম. পি. সাহেবের মনও জয় করে নিয়েছিলো সে। নজরুলের সাহসীকতা নিয়ে গর্ববোধ করতো এমপি। এমন বীর ছেলে নাকি লাখে একটা পাওয়া দায়। যে কোনো কাজে নজরুল সবার আগে। জীবনের প্রথম খুন এম.পি. সাহেবের জন্যই। যে ব্যবসায়ীকে খুন করে।তার সাথে এমপি সাহেবের দ্বন্ধ ছিল। এমপি হওয়ার পর ওই ব্যাবসায়িকে কোটি টাকার কাজ পাইয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কমিশনের টাকা এমপিকে দেয়নি। উল্টো

এমপিকে দূর্নীতি মামলা দেওয়ার হুমকী দেয়। এজন্যই ক্ষেপে যান এমপি। সিদ্ধান্ত নেন খুন করার। আর ওই সময়ে সব চেয়ে বিশ্বস্ত হলো নজরুল। তাই হাতে একটা সদ্য আমদানি করা নাইন এম.এম. দিয়ে বললো যা ফুটা কইরা দে। ব্যাকআপ আমি দিমু।

সেই শুরু। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কথা আর কাজের মধ্যে মিল থাকায় অপরাধ জগতে খুব অল্প সময়ে অনেকের মন জয় করে নেয়। একাধিক খুনসহ কয়েকটি মামলার আসামী হয় কানকাটা নজরুল। একদিন রাস্তা দিয়ে হাটতে থাকে নজরুল।পথে চিৎকার চেচামেচি শব্দ কানে আসে। এগিয়ে যায় সামনে। দেখে অনেক লোক জটলা বেধে আছে। আর একটি মেয়ের ওরনা ধরে টানছে এক যুবক। মেয়েটি চিৎকার করছে, কেউ তাকে উদ্ধার করছে না। পেছন থেকে গিয়ে মাথায় লাথি মারে নজরুল। যুবকটি পালিয়ে যায়। অসুস্থ্য হয়ে পড়ে মেয়েটি। নজরুল মেয়েটিকে নিয়ে পাশের হাসপাতালে ভর্তি করায়। দুদিন পর মেয়েটি পুরো সুস্থ্য হয়। এ দুদিন নজরুল মেয়েটি সাথে হাসপাতালে ছিল। চিকিৎসার যাবতীয় খরচ বহনসহ সেবাও করেছে। গার্মেন্টেসে চাকুরী করতো মেয়েটি । এক সময় ওই মেয়ের সাথে প্রেম হয় নজরুলের। মা একায় বাসায় থাকে। তাই তাকে সঙ্গ দেয়ার কথা ভেবে ওই মেয়েটিকে কয়েক মাস পর বিয়ে করে নজরুল। দু’ বছর পরেই ঘরে এক কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করে। সুখেই কাটল তার পরের দুই বছর। কিন্তু পুলিশ হঠাৎই সব এলোমেলো করে দিলো। এরই মধ্যে একবার এসে কয়েকজন নজরুলকে ময়না হেটেলের তেহারি খাইয়ে চলে গেলো। ওদেরকে প্রশ্ন করেও উত্তর পেলো না- কবে ওকে কোর্টে চালান করা হবে। রাত একটার দিকে হঠাৎ দরজা খুলে গেলো। দশ এগারো জন পুলিশ এসে নজরুলের হাত পা-এর বাঁধন খুলে দিল। এরপর হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে টেনে আনলো রুমের বাইরে। দরজার চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে ডান পা বাইরে দিতেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। দরজার ডান পাশে নিম গাছের ডালে বসে কাক কা কা করে চিৎকার করছে। বাম পা আর সামনে দিতে ইচ্ছে করছে না।

গেটের সামনে গাড়ি দাড়িয়ে আছে। ড্রাইভার গাড়িতে বসেই আছে। জোর করে ওই গাড়িতে তুললো। নজরুল সবাইকে বার বার জিজ্ঞেস করলো- ছার আমারে কই লইয়া যাইতাছেন? ছার আমারে মাইরালাইবেন? একজন বলে ওঠে চোপ হারামজাদা আর একটা কথা বললে তোর মাথার খুপরি উড়িয়ে দেবো। ভয়ে-আতঙ্কে কাঠ হয়ে থাকে নজরুল। সবাই উঠে বসে গাড়িতে । চলতে থাকে গাড়ি। নির্জন রাস্তা। ঘুমিয়ে গেছে রাজধানী। পথে দু চার জন টোকাই শুয়ে আছে। ওদের দিকে তাকিয়ে দু’ চোখ দিয়ে অশ্রু ছেড়ে দেয় নজরুল। দু’গাল চুয়ে চুয়ে অশ্রু ফোটা পড়ে পায়ের নখে। কিন্তু কারো মুখে কোন কথা নেই। সবাই চুপ করে বসে আছে। হঠাৎ থেমে যায় গাড়ি যাত্রাবাড়ীর এলাকায় এক পরিত্যক্ত বিল্ডিংয়ের পাশে।আশে পাশে কোন বাড়িঘর নেই। সিটি কর্পোরেশন বড় বড় ডাস্টবিন পাশে। গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নামে অফিসাররা। এরপর নজরুলকে নামিয়ে নেয়। পরিত্যাক্ত বিল্ডিংয়ের ভেঙ্গে পড়া ইটের উপরে দাড় করায় নজরুলকে। যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে হাউমাউ করে নজরুল বলে ওঠে ছার আমারে মাইরেন না। ছার আমার একটা তিন বছরের মাইয়্যা আছে। বাসায় বউ আছে। আমারে মাইরেন না ছার। নজরুলের বাঁচার আকুতি বাতাসে মিলিয়ে যায়। এক সময় নিস্তেজ হয়ে পড়ে নজরুল। পড়ে থাকে নিথর দেহ। খবর পায় স্থানীয় থানা পুলিশ। নজরুলের লাশ ঢাকা মেডিকেলের ফরেনসিকে রাখা হয়। পরদিন কিছু কিছু টিভি চ্যানেলে বরাবরের মতো ছোট একটা সংবাদ প্রচারিত হলো। টিভিতে সংবাদ দেখে ঢাকা মেডিকেলে ছুটে যায় নজরুলের বউ। তিন বছরের কন্যা সন্তানকে বুকে নিয়ে লাশ ঘরের সামনে কাঁদতে থাকে সে। মাঝে মধ্যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সকাল পেরিয়ে দুপুর, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা আসে। তার জীবনে নেমে আসে অমাবস্যার আঁধার।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ আগস্ট ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়