ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

কুকুর দেখাল চাঁদের পথ

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২০, ৩ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কুকুর দেখাল চাঁদের পথ

একটি কুকুরের দেখানো পথেই মানুষ জয় করতে পেরেছে চাঁদ। যেতে পেরেছে চাঁদ মামার বাড়ি। শুধু তাই নয়, শিখেছিল মামার বাড়ি থেকে ফিরে আসার উপায়।

৩ নভেম্বর ১৯৫৭। রাশিয়া বিপ্লবের ৪০তম বার্ষিকী পালিত হবে। মূলত স্পুটনিক-১ এর সফল অভিযানের পর রুশ নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ আরেকটি মহাকাশ অভিযান প্রেরণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। সে অনুযায়ী মাত্র চার সপ্তাহ আগে পরিকল্পনা করা হয় মহাকাশে জীবন্ত কোন প্রাণি পাঠানোর। ফলে নভেম্বর সময়সীমার মধ্যে শেষ করার জন্য অপেক্ষাকৃত সাধারণ ও নিম্নমানের একটি নকশা বানাতে হয়েছিল। যেহেতু জীবন্ত একজন যাত্রীকে পাঠাতে হবে, সেহেতু এর সঙ্গে সৌর বিকিরণ এবং মহাজাগতিক রশ্মি পরিমাপের ব্যবস্থা সংযুক্ত করতে হয়েছিল। এতো কিছুর পরেও বলিদানে নির্ধারণ করা হয় ‘লাইকা’ নামের একটি বেওয়ারিশ মাদী কুকুরকে।

তবে মহাকাশে কুকুর পাঠানোর কথা ১৯৪৮ সাল থেকেই সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন। এর পেছনে কারণ ছিল রুশ বিজ্ঞানী পাবলভ কুকুর নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছিলেন। কুকুরের শারীরতত্ত্ব সম্পর্কে তাদের ভালো ধারণা ছিল।  পাবলভ কুকুরের হজম শক্তি থেকে শুরু করে স্নায়ুতন্ত্রের ক্রিয়াকর্ম সম্পর্কেও গবেষণা করেছিলেন। তিনি এজন্য নোবেল পুরষ্কার পান।

মহাকাশ কি মানুষের জন্য নিরাপদ? মহাকাশে ঝুঁকিমুক্ত ভ্রমণ মানুষের পক্ষে সম্ভব কি? এ ধরনের নানান প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর খুঁজতেই বলিদান দিতে হয়েছিল লাইকাকে। ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে সোভিয়েত মহাকাশ কর্মসূচির মেডিকেল ইউনিটের প্রধান রুশ বিজ্ঞানী প্রফেসর ভ্লাদিমির ইয়াদভস্কির ছেলে ভিক্টর ইয়াদভস্কি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমার বয়স যখন ৯ বছর, তখন বাবা একবার লাইকাকে গবেষণাগার থেকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। লাইকা ছিল খুবই শান্ত স্বভাবের কুকুর। আদুরে চেহারা ছিল। তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া সহজ ছিল। তার বুদ্ধিমত্তা নিয়ে সবাই খুব মুগ্ধ ছিল। তার চোখের রঙ ছিল কালো। চোখ দুটো যেন কথা বলতো।’

সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা তখন তাদের কাজের জন্য খুব সচেতনভাবে সাধারণ বেওয়ারিশ কুকুরকে বেছে নিয়েছিলেন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘এসব কুকুরের কোন ঠিকানা ছিল না, মনিব ছিল না। বেওয়ারিশ হিসাবে টিকে থাকতে হতো বলে তাদের বেঁচে থাকার ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত বেশি ছিল এবং ঐ কুকুরগুলোর চাহিদা ছিল অপেক্ষাকৃত কম। ফলে তাদেরকেই গবেষকরা অধিকতর উপযুক্ত মনে করেছিলেন।’ কিন্তু সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থার একটি গোপন দলিল থেকে জানা যায়,  রাস্তা থেকে তুলে আনার পরই শান্ত স্বভাবের লাইকার জীবনে নেমে আসে দুর্যোগ। মুক্ত লাইকাকে পরাধীনতার শিকল পরিয়ে দিনের পর দিন নিষ্ঠুরভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় মহাকাশে পাঠানোর জন্য। যেহেতু স্পুটনিক-২ একটি ছোট আকৃতির স্পেসক্রাফট, তাই লাইকাকে একটি ছোট খাঁচার মধ্যে ২০ দিন আটকে রাখা হয় যাতে সে স্পেসক্রাফটের ছোট্ট কেবিনে আবদ্ধ থাকতে পারে। এমনই নির্মম সব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে লাইকাকে তৈরি করা হয়েছিল মহাকাশ অভিযানে পাঠানোর জন্য। যা আপাতদৃষ্টিতে প্রশিক্ষণ মনে হলেও আসলে তা অসহায় লাইকার জন্য টর্চারের মতো ছিল।

তখনও সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা জানতেন না যে; কীভাবে মহাকাশ যান পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে হয়। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও লাইকাকে মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল। ১৯৫৭ সালের ৩ নভেম্বর, স্পুটনিক-২ এ চড়ে কাজাখস্থানের বাইকনুর কসমোড্রোম থেকে লাইকা যাত্রা শুরু করে। সে সময় সবাই জানতো লাইকাকে বাঁচিয়ে ফেরত আনা সম্ভব হবে না। বিজ্ঞানীরা অবশ্য এদিকটায় খুব একটা গুরুত্ব দেননি। একটি অক্সিজেনের ট্যাংক, একটি কার্বন-ডাই-অক্সাইড অবজারভার আর লাইকাকে ঠান্ডা রাখার জন্য একটি ফ্যান ছিলো সেই মহাকাশ যানে। আর ছিলো কিছু খাবার, মোটামুটি সাতদিন চলার মতো। লাইকাকে মহাকাশ যানে ওঠানোর আগে এক বিজ্ঞানী তার নাকে চুমু খান এবং শেষ বারের মতো বিদায় জানান।

পৃথিবীর কক্ষপথে চারবার প্রদক্ষিণ করা পর্যন্ত তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। পাঁচ ঘণ্টা পর সমস্যা শুরু। টেকনিশিয়ানদের সামান্য একটা ভুলের কারণে মহাকাশ যানের একটি অংশের রকেট অনেকক্ষণ আটকে ছিল। ফলে লাইকার কেবিনের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে। তাপের কারণে লাইকার হার্টবিট  ১০৩ থেকে বেড়ে ২৪০-এ পৌঁছে যায়। প্রচন্ড গরমে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা সময় লাইকাকে তার জীবনের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। গরমে লাইকার শরীরে লাগানো সেন্সর নষ্ট হয়ে যায়, হার্টবিট মাপার যন্ত্রটি বন্ধ হয়ে যায়। এবং শেষ পর্যন্ত লাইকা মহাকাশেই মারা যায়। মৃত লাইকা নিয়ে আরও ১৬৫ দিন যানটি মহাকাশে ছিল। ১৪ই এপ্রিল ১৯৫৮ সালে, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করতে গিয়ে লাইকার মৃতদেহের সাথে মহাকাশ যানটিও পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

সে সময় ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’-এর খবরে সোভিয়েট মাহকাশ সংস্থার বরাতে বলা হয়, লাইকা ছয় দিনের মতো বেঁচে ছিল। পরে অক্সিজেন ফুরিয়ে যাওয়ায় দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই তাকে কৃত্রিমভাবে মেরে ফেলা হয়। অনেকদিন পর, ২০০২ সালের গোপন নথি থেকে জানা যায়, লাইকা আসলে প্রচন্ড তাপে পুড়ে মারা গিয়েছিল। উৎক্ষেপণের সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার মধ্যেই তার চেম্বারের তাপমাত্রা অত্যাধিক বেড়ে যাওয়ায় এই অবস্থা হয়। লাইকার বলিদানের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা কীভাবে মহাকাশে পরিভ্রমণ করে জীবন্ত প্রাণি ফিরিয়ে আনা যায় তার উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ফলে গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা মোট ৫৭টি কুকুর মহাকাশে পাঠিয়েছেন। এদের মধ্যে কয়েকটি কুকুর একাধিকবার মহাকাশ ভ্রমণ করেছে। লাইকা ছাড়া বাকী কুকুরদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল। সেই পথ দেখিয়ে গিয়েছিল লাইকা।

তার দেখানো পথেই ১২ এপ্রিল ১৯৬১ সালে রাশিয়া মহাকাশে প্রথম মানুষ পাঠায়।

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়