সিডরের এক যুগ
সেদিন প্রতিটি কবরে রাখা হয়েছে একাধিক লাশ
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সকালের সূর্য ওঠে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। দিন বাড়তেই দমকা হাওয়া বাড়তে থাকে। দুপুর নাগাদ উপকূলের জনপদে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবে এত বড় কিছু হয়ে যেতে বসেছে তা ভাবতে পারেননি অধিকাংশ মানুষ। তারা ভেবেছিলেন, এমন ঝড় তো প্রতিবছরই আসে, এতে এমন কি হবে? মহাবিপদ সংকেতের কথা শুনে কেউ কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে গেলেও অধিকাংশ রয়ে যান নিজ ঘরেই।
সন্ধ্যার পরেই শুরু হয় বৃষ্টির সঙ্গে দমকা হাওয়া। রাত দশটার দিকে ফণা তোলা সাপের মত আঘাত হানলো সুপার সাইক্লোন সিডর। মাত্র ১০ মিনিট স্থায়ী হয় জলোচ্ছ্বাসটি। আর এতেই মারা যান উপকূলের কয়েক হাজার মানুষ। চারদিক পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। এতে মধ্য ও পশ্চিম উপকূল পরিণত হয় লণ্ডভণ্ড এক জনপদে।
ঘণ্টাদুয়েক পরেই পরিবেশ শান্ত হয়ে এল। নেমে যেতে লাগলো জলোচ্ছ্বাসে উঠে আসা পানি। সেই রাতে পানির তোড়ে ভেসে যায় হাজারো মানুষ। নিখোঁজদের অধিকাংশ ছিল বৃদ্ধ, নারী ও শিশু। রাতভর মানুষ খুঁজতে থাকে হারানো স্বজনকে। সকাল অবধি চলে খুঁজে ফেরা মানুষের হাহাকার। জ্যান্ত না হোক মৃত স্বজনের লাশ তো অন্তত খুঁজে পেতে হবে। এভাবে কেটে যেতে লাগলো সিডর পরবর্তী দুটো দিন। নদীতে ভাসতে দেখা যায় লাশের পর লাশ। কিছু লাশের পরিচয় মেলে তো কিছু মেলে না। এত লাশ কবর দেয়ার জায়গা পর্যন্ত ছিল না। তাই এক কবরে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে একাধিক মানুষের মৃতদেহ।
এমন ঘটেছিল বরগুনা সদর উপজেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা নলটোনায়। সেখানে সিডরের সময় ২০ ফুটের মতো পানি বৃদ্ধি পেয়েছিল। ঘূর্ণিঝড়ের পরের দিনটিতে সেখানে অর্ধ শতাধিক মানুষের লাশ পাওয়া যায়। উপকূলীয় অঞ্চলে পানি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, স্থায়ী হয়নি সিডরের পানিও। তবে তখনও এই এলাকাটি হাঁটু পানির নিচে হাবুডুবু খাচ্ছিল। লাশ দাফনের জন্য কোন জায়গা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। যার ফলে লাশগুলো নিয়ে আসা হয় বরগুনা-নিশানবাড়িয়া সড়কের পাশে পশ্চিম গর্জনবুনিয়া গ্রামে। দাফনের একটু কাপড় জোটেনি অনেকের ভাগ্যে। সেদিন এখানে ৩৩ জনকে ১৯ টি কবরে মাটি চাপা দেয়া হয়। জায়গার অভাবে ৫টি কবরে ৩ জন করে ১৫ জন, ৪ টি কবরে ২ জন করে ৮ জন ও ১০ টি কবরে ১ জন করে ১০ জনের লাশ দাফন করা হয়। বারো বছর পরে গর্জনবুনিয়া এলাকার মানুষের চোখে আজও বেঁচে আছে সেদিনের স্মৃতি। কবরগুলোকে একটু উঁচু করে রাখা হয়েছে। বরগুনা প্রেসক্লাবের সহযোগিতায় স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা সংগ্রাম ইট দিয়ে কবরস্থানটি ঘিরে দিয়েছে।
সিডরের সাক্ষী হয়ে আজও আছে সেই কবরগুলো। প্রতি বছর সিডরের দিন ফিরে এলে আত্মীয় স্বজন এখানে আসেন কবর জিয়ারত করতে। তখন কান্না চেপে রাখতে পারেন না আগত কেউ। পরিবারের মানুষ কিংবা পরম স্নেহের কেউ পৃথিবী ছেড়ে গেলে কেমন কষ্ট তা এই পৃথিবীকে বোঝাতে পারেন না স্বজন হারানো মানুষগুলো। তবে তারা চান, আর যেন এমন করে মানুষকে মরতে না হয় নির্মম প্রকৃতির রোষানলে।
ঢাকা/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন