ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

প্রেমেন্দ্র মিত্রকে নিয়ে শিবরামের রসিকতা

অরণ্যক তপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১২, ২৯ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রেমেন্দ্র মিত্রকে নিয়ে শিবরামের রসিকতা

বাংলা সাহিত্যে শিবরাম চক্রবর্তী আর প্রেমেন্দ্র মিত্রের বন্ধুত্ব সম্পর্কে জানেন না এমন পাঠক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। রসিক পাঠক দুজনের বন্ধুত্ব সম্পর্কে অবগত। প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পুতুল ও প্রতিমা’ উৎসর্গ করেন শিবরামকে। দ্বিতীয় সংস্করণের একটা কপি পেয়ে শিবরাম দেখলেন বইটা তাঁকেই উৎসর্গ করা। গদগদ হয়ে শিবরাম প্রেমেন্দ্রকে বললেন, ‘বইটা আমাকেই উৎসর্গ করেছ দেখছি!’

‘সেকি তুমি জানতে না!’ প্রেমেন্দ্র বিস্মিত কণ্ঠে বললেন।

‘না!’, শিবরাম ততোধিক বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চাইলেন, ‘দ্বিতীয় সংস্করণটা আমাকেই উৎসর্গ করেছ দেখলাম। কিন্তু প্রথম সংস্করণটা কাকে উৎসর্গ করলে শুনি?’

এমন উদ্ভট প্রশ্নে প্রেমেন্দ্র পুনরায় বিস্মিত না হয়ে পারলেন না। তিনি বললেন, ‘এটাও সম্ভব নাকি- প্রথম সংস্করণ একজনকে আর দ্বিতীয় সংস্করণ আরেকজনকে উৎসর্গ করব? প্রথম সংস্করণ তো তোমাকে দিয়েছিলাম। উল্টে দেখোনি?’

শিবরাম কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে বললেন, ‘হুম, মনে পড়েছে। সে আর দেখার কী আছে! তোমার লেখা তো মাসিকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পড়ে ফেলি। তার উপর সব একাধিকবার পড়া। তাই আর কৌতূহল হয়নি বইটা খুলে দেখবার। শিবরাম আরো বললেন, ‘হাতে পেয়ে বইটার মলাট দেখে খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু এর থেকে বেশি খুশি হবার সৌভাগ্য আমার হয়নি। ভাবলাম প্রেমেন্দ্রের বই যেহেতু হাতে হাতে চলছে, কাটতি ভালো। এই দুর্দিনে তাহলে বইটার সদ্ব্যবহার করি’।

‘তা কী করলে বইটা?’ জানতে চাইলেন প্রেমেন্দ্র।

শিবরামের উত্তর, ‘সঙ্গে সঙ্গে এমসি সরকারে গিয়ে বেচে দিয়ে এসেছি।’

বুঝুন তাহলে, কতটা অকপট বন্ধুত্ব হলে এরকম মজা করা যায় বন্ধুর সঙ্গে। তবে বন্ধুত্বের ব্যাপারে শিবরামের ধারণা ছিল- স্কুল কলেজের গণ্ডী পার হবার পর আর বন্ধুত্ব হওয়া সম্ভব না। কিন্তু প্রেমেন্দ্রের ব্যাপারে তার এই ধারণা ছিল পুরোপুরি উল্টো। শিবরাম বলতেন, ‘বন্ধুত্ব যা হবার তা স্কুল কলেজের গণ্ডী পার হওয়ার আগেই হয়। এরপর যা হয় তা এনিমি বা নন-এনিমি। এই নন-এনিমিদেরকেই আমরা বন্ধু বলে বিবেচনা করি। কিন্তু প্রেমেন্দ্রর ব্যাপার আলাদা। প্রেমেনের মত বন্ধু দ্বিতীয়টা আর হয় না।’

বন্ধু প্রেমেন্দ্রের সঙ্গে রসিকতা করতে শিবরাম মনে হয় সামান্যতম ছাড়ও দিতেন না। একবার রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়া-দাওয়া করছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, হেমেন্দ্রকুমার রায়, কাজী নজরুল ইসলাম এবং স্বয়ং শিবরাম চক্রবর্তী। স্নেহের বশবর্তী হয়ে প্রেমেন্দ্রকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বসলেন হেমেন্দ্রকুমার। শিবরামও ছাড়বার পাত্র নন। এ নিয়ে সাথে সাথে তিনি পদ্য লিখে ফেললেন:

‘গল্প না বৎস, না কল্পনা চিত্র

হেমেন্দ্র চুম্বিত প্রেমেন্দ্র মিত্র।’

এবার আসি দুই বন্ধুর পরিচয়ের সূচনা লগ্নে। এখানেও রসিকতার কমতি ছিল না। শিবরাম চক্রবর্তীর বাতিক ছিল সিনেমা দেখার। সিনেমা না-দেখলে যেন তার পেটের ভাত হজম হতো না। একদিন সিনেমা দেখতে গিয়েই আচমকা পরিচয় হয় প্রেমেন্দ্র মিত্রের সাথে। (তার আগে অবশ্য একবার শিবরাম চিঠি লিখেছিলেন প্রেমেন্দ্রকে, তাঁর লেখা উপন্যাস ‘পাঁক’ এর প্রতি মুগ্ধতাবশত। এই মুগ্ধতা আর আলাপের সূত্র ধরেই দু’টো অপরিচিত মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে)। পরিচয়ের কিছু পরেই তাদের গল্প এমন জমল যে সিনেমা দেখা উঠল লাটে। তাদের গালগপ্পে আশেপাশের দর্শকরাও রীতিমত বিরক্ত। শিবরাম একে একে দিতে লাগলেন বিশ্বভ্রমণের ফিরিস্তি। হলের গদিতে বসে বসেই ঘুরে বেড়াতে লাগলেন এদেশ-সেদেশ। এমনকি দুই বন্ধু কোন কোন দেশে ঘুরতে যাবেন হলে বসেই তৈরি করতে শুরু করে দিলেন তার লিস্ট। এক পর্যায়ে উৎসুক প্রেমেন্দ্র জানতে চাইলেন, ‘কিন্তু দু’জনে এত দেশ ঘুরে বেড়ানোর টাকা পাব কোথায়?’

উৎফুল্ল শিবরাম বললেন, ‘ভেবেছ কি ভায়া! বিশ্বভ্রমণের কথা এমনি এমনি বলছি? লাখ টাকার মামলা দিয়ে এসেছি যে। এই জিতে গেলাম বলে। ওই টাকাটা হাতে পেলেই দুই বন্ধু মিলে বেড়িয়ে পরব বিশ্বভ্রমণে।’

গুল বা ঢপ নয়, পৈতৃক সম্পত্তির দাবিতে সত্যি সত্যিই লাখ টাকার মামলা করে এসেছিলেন শিবরাম। কিন্তু মজার ব্যাপার, এরকম মামলা করা একমাত্র শিবরামের পক্ষেই সাজে। যাকে তার ভক্তকুলেরা বলেন ‘শিবরামীয় মামলা’। মামলার উকিল ব্যারিস্টার কেউ নেই, শিবরাম একাই সব। যাকে বলে একাই একশ। আর সেই মামলার সাক্ষী কে? হ্যাঁ, যার বিরুদ্ধে মামলা, স্বয়ং তিনিই এই মামলার সাক্ষী। শিবরামের এতটাই আস্থা আর বিশ্বাস সাক্ষীর উপর। ফলে যা হবার হলো তা-ই। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সাক্ষী কাম প্রতিপক্ষ বলল, ‘ মাই লর্ড, এই শিবরামবাবুর সমস্ত অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট এবং ভিত্তিহীন।’ ব্যস, সাক্ষীর এক কথাতেই কেল্লা ফতে! কেস ডিসমিস!

আরেকটা ঘটনা, তখন প্রেমেন্দ্র বেশ অভাবের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। এক কাজের জন্য এসেছেন ঢাকায়। হঠাৎ শিবরামের চিঠি পেলেন হাতে। তাতে লেখা, ‘শীঘ্রই কলকাতা আসো, তোমার চাকরি হয়ে গেছে’। বিস্মিত প্রেমেন্দ্র কিছুই ভেবে পেলেন না। তিনি তো কোনো চাকরির ইন্টারভিউ দেননি। তাহলে চাকরি হলো কীভাবে? কলকাতকা ফিরে সেই অফিসের ঠিকানায় গেলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। সেখানে গিয়ে তাঁর বিস্ময় দ্বিগুণ হওয়ার পালা। অফিসার তাকে বললেন, ‘আরে মশাই, এতো বেছেবুছে লোক নিলাম। অথচ যাকে নিলাম সেই বলছে- আমি তো চাকরি করবো না। চাকরি করবে আমার বন্ধু প্রেমেন্দ্র!’

অথচ শিবরামের যে তখন অভাব ছিল না তা নয়। বরং জীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি অভাব অনটনের মধ্যে দিয়েই কাটিয়েছেন। এমনকি জীবনের ষাট বছর কাটিয়ে দিয়েছেন একটি বাড়িতেই। অর্থ কড়ির প্রতিও তার ছিল না মোহ। কিন্তু প্রেমেন্দ্রের অর্থকষ্ট শিবরামকে ভাবাত, পীড়া দিত। এজন্যই বন্ধুর হয়ে চাকরির পরীক্ষা দিয়েছেন। বুঝুন তাহলে, বন্ধুকে কতটা ভালোবাসতেন শিবরাম। এরকম বন্ধুত্বের সম্পর্ক কোনো ব্যাখ্যা দিয়ে দাঁড় করানো যায়?

দুই বন্ধুর মধ্যে ভালোবাসার যেমন কমতি ছিল না, তেমন কমতি ছিল না রসিকতার। হয়তো তীব্র ভালোবাসার টান থাকলেই এমন রসিকতা করা সাজে। প্রেমেন্দ্রের ‘পাতালে পাঁচ বছর’ বইটি যখন প্রকাশিত হয়, তার কিছু পরেই প্রকাশিত হয় শিবরামের ‘পাতালে বছর পাঁচেক’ গল্পটি। গল্পে তিনি লিখেছেন: ‘তখনই বারণ করেছিলাম গোরাকে সঙ্গে নিতে। ছোট ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে কোনো বড় কাজে যাওয়া আমি পছন্দ করিনে। আর ঐ অপয়া বইখানা। প্রেমেন মিত্তিরের ‘পাতালে পাঁচ বছর’! যখনই ওটা ওর বগলে দেখেছি, তখনই জানি যে, বেশ গোলে পড়তে হবে...’ নিখাঁদ অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব না হলে কী আর প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো সাহিত্যিকের সাহিত্য নিয়ে এমন ঠাট্টা করা যেত?

তাদের ঠাট্টার আরেকটি নমুনা পেশ করছি। শিবরাম প্রায়শই প্রেমেন্দ্রকে তাগাদা দিতেন সিনেমার জন্য গল্প লিখতে। কিন্তু প্রেমেন্দ্র বারবার এড়িয়ে যেতেন। শিবরামের পীড়াপীড়িতে প্রেমেন্দ্র একদিন স্টুডিওতে গেলেন একজনের সঙ্গে দেখা করতে। যার কাছে গেলেন, তিনি বললেন, ‘আপনার গল্পটা পড়েছি। কিন্তু একটা জায়গায় বুঝতে পারিনি। ওই যে দার্জিলিং-এ পার্টিতে গিয়ে একটা মেয়ে সবাইকে চ্যালেঞ্জ করে বিবস্ত্র হয়ে গেল...।’ এটুকু শুনতে না শুনতেই প্রেমেন্দ্র মিত্র আকাশ থেকে পড়লেন এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। এরপর তিনি বললেন, ‘আমি তো ছাই কোনো সিনেমার গল্পই লিখিনি। তার উপরে আবার এগুলো!’ পরবর্তী সময়ে প্রেমেন্দ্র জানতে পারলেন ‘প্রেমেন্দ্র লিখেছেন’ এই মর্মে শিবরাম এই গল্পটা জমা দিয়ে গেছেন লোকটার কাছে। এরপর যখন শিবরামের সাথে দেখা হলো প্রেমেন্দ্র তখন প্রচণ্ড রেগে গেলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে শিবরাম বললেন, ‘তুমি নিজে লেখা পাঠাবে না বলেই তো আমি তোমার নামে একটা গল্প লিখে পাঠিয়ে দিয়েছি। তাছাড়া সিনেমাতে কি না হয়? পরে তুমি এগুলো বদলে নিতে পারতে।’

প্রেমেন্দ্র মিত্র শিবরাম সম্পর্কে লিখে গেছেন: ‘খোদ শিবরামকে বোধ হয় আমার মতো কেউ চেনে না, এ আমার এক অহঙ্কার।’ জীবদ্দশায় কখনো কাউকে গালমন্দ করেননি, নিন্দা করেননি। কাউকে নিন্দা করতে শুনলেও এড়িয়ে যেতেন অথবা শুনতে চাইতেন না বলে থামিয়ে দিতেন। এমনকি কেউ যদি কখনো এসে শিবরামকে বলতো, অমুকে আপনার সম্পর্কে খারাপ কথা বলেছে। শিবরাম বিশ্বাস করতেন না। বলতেন, ‘হতেই পারে না, আপনি ভুল শুনেছেন’। এরপর সেই ব্যক্তির হাত ধরে নিয়ে যেতেন মিষ্টি খাওয়াতে। নিজেকে সাহিত্যিক হিসাবে পরিচয় দিতেও তিনি সংকোচবোধ করতেন। ভালো লেখকদের কাতারে সবার আগে নাম নিতেন বন্ধু প্রেমেনের। বলতেন, ‘প্রেমেন, অচিন্ত্য, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ এরা হলেন সাহিত্যিক। কত ভালো ভালো লেখেন! তাদের পাশে আমি!’ আর নিজেকে পরিচয় দিতেন ‘সার্কাসের ক্লাউন’ হিসাবে। ভালোবাসা আর রসিকতার বাইরে বন্ধুর প্রতি শিবরামের ছিল এরকমই শ্রদ্ধা আর বিনয়।


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়