ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রের বীরত্ব

খালেদ সাইফুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ১০ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুক্তিযুদ্ধে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রের বীরত্ব

অস্ত্র কাঁধে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন সিদ্দিকুর, ডানে বর্তমান সময়ের ছবি

দুরন্ত শৈশব। নেই কোনো ধরাবাঁধা নিয়মের বালাই। ছুটোছুটি, হৈ-হুল্লোড়; কেটে যায় দিন। গ্রামে এমন শৈশব কার না কেটেছে! কিন্তু দস্যিপনায় ছেলেবেলা সবার কাটলেও সেই বয়সে দেশের জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিতে পারে ক’জন? ছোট্ট বুকে অসীম সাহসে ভর করে যে শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে সে সৌভাগ্যবান। ইতিহাস তাঁকেই স্মরণ করবে যুগে যুগে। দেশ তাঁকে বরণ করবে সসম্মানে।

সিদ্দিকুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। চারদিকে যুদ্ধের দামামা। দিনে-রাতে, সাঝ-প্রভাতে শোনা যায় বুলেটের শব্দ। পাখিগুলো উড়ে গেছে ভিন্ন কোনো দেশে প্রাণের ভয়ে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে পাকিস্তানি সেনারা। দীর্ঘ লাইন পড়েছে সীমান্তগামী মানুষের। তাদের চোখে-মুখে মৃত্যুভয়! মনে অনিশ্চিত জীবনের গুমোট হতাশা। ইতোমধ্যেই ঘর ছেড়েছেন সিদ্দিকুরের বড় ভাই জিন্দার আলী। তিনি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিবেন এই হলো বাসনা। ওদিকে সিদ্দিকুর তখন নিজ গ্রাম যশোরের গাঁওঘরায় ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন পরিবারের সঙ্গে। বাবার এক কথা- মরলে নিজ বাড়িতেই মরব। কোথাও যাব না।

একদিন বড় ভাই ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে বাড়িতে আসেন বাবা-মায়ের দোয়া নিতে। ভাগ্য সহায় ছিল না। বাঁধল বিপত্তি। রাজাকাররা এর অপেক্ষাতেই ছিল। তারা তো ছাড় দেয়ার পাত্র নয়! রাতের আঁধারে আক্রমণ করল সিদ্দিকুরের বাড়ি। সিদ্দিকুর তখন বড় ভাইয়ের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী এক বাগানে পালিয়ে আশ্রয় নেয়। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পরিবারের অন্যরা। যে যেদিকে পারে ছুটে পালাতে থাকে। চোখের সামনে দাউ দাউ জ্বলতে থাকে ঘরবাড়ি। আগুনের লেলিহান শিখা ছোট্ট সিদ্দিকুরের মনে জ্বালিয়ে দেয় প্রতিশোধের আগুন।

পরদিন সূর্য ওঠার আগেই জীবনবাজি রেখে বড় ভাই এলাকা ছাড়েন। কিন্তু একা নন, সিদ্দিকুরকেও সঙ্গে নেন। বাবা বড় ভাইয়ের হাতে তুলে দেন প্রাণপ্রিয় শিশুসন্তানকে। বলেন, ওকেও ভারতে নিয়ে যা। এখানে থাকলে ওকে ওরা বাঁচতে দিবে না।

বড় ভাইয়ের হাত ধরে সিদ্দিকুর হাঁটতে থাকেন সীমান্তের দিকে। খাল-বিল, মাঠ পেরিয়ে পৌঁছান বনগার চাপাবেড়ে ক্যাম্পে। ক্যাম্পের কমান্ডার তাঁরই ভগ্নিপতি জাহাতাব উদ্দীন। আবদার জুড়ে দেন- তাকেও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কিন্তু নাম লেখাতে গেলে বয়সের কারণে বাদ পড়েন। কারণ সিদ্দিকুরের বয়স তখন মাত্র ১১ বছর। তবে হাল ছাড়ার পাত্র নন তিনি। এক মাস অপেক্ষা করার পর সুযোগ মিলল। এবার উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য পার্শ্ববর্তী বারাকপুর ক্যাম্পে গিয়ে লাইনে দাঁড়ালেন। তাকে দেখে কমান্ডার ক্যাপ্টেন মুখার্জির চক্ষু চড়কগাছ! এতটুকু ছেলে যুদ্ধ করতে পারবে? কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি! সুতরাং এবারও বাদ পড়তে হলো। কিন্তু কখন ডাক আসে সেই অপেক্ষায় রইলেন সিদ্দিকুর! ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো। সেপ্টেম্বর মাসে চূড়ান্ত প্রশিক্ষণের জন্য তাকে পাঠানো হলো বীরভূমের রামপুরহাট সেনানিবাসে। সে যাত্রায় ভগ্নিপতির অনুরোধে অনুমতি পান তিনি।

সিদ্দিকুর রামপুরহাটে উচ্চতর অস্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ নেন। এত ভারী অস্ত্র কি শুধু মনের জোরে চালানো যায়? অন্যদের সহায়তায় সিদ্দিকুর প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন। ক্যাম্পে তিনি সবার ছোট। ফলে সবাই তাকে আদর করে, সহায়তা করতে এগিয়ে আসে। সিদ্দিকুর সে-সময়ের স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, ‘কখনো চাচাতো ভাইয়েরা, কখনো অন্য সঙ্গীরা দেখিয়ে দিত, বুঝিয়ে দিত। এভাবে এক মাসের প্রশিক্ষণ সফলভাবে শেষ করে যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি পাই।’

এবার সবকিছু গুছিয়ে দেশে ফেরার পালা। নভেম্বর মাসে তিনি সরাসরি রণাঙ্গনে আসেন যশোরের চৌগাছার সীমান্তবর্তী ধূলিয়ানিতে। সেখানে পাক-বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধরত মুক্তিসেনারা। কয়েকদিন চলতে থাকল দুই পক্ষের তুমুল যুদ্ধ। সম্মুখসমরে তখন সিদ্দিকুরের বড় ভাই, চাচাসহ অন্যান্য জ্যেষ্ঠ সেনারা। অপেক্ষাকৃত ছোটরা পেছনে আছেন পজিশন নিয়ে। সিদ্দিকুরও সেই দলে বুক চিতিয়ে লড়ে যাচ্ছেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ব্যাপক গোলাগুলির মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়েন তিনি। মৃত লাশের মধ্য থেকে সিদ্দিকুরকে উদ্ধার করা হয় জীবিত অবস্থায়। পার্শ্ববর্তী একটি বাড়িতে নিয়ে তাকে সুস্থ করা হয়। ৬ ডিসেম্বর পাক-বাহিনী পর্যুদস্ত অবস্থায় যশোর ছাড়তে বাধ্য হয়। অন্যান্য যোদ্ধাদের সঙ্গে বাড়ি ফেরেন তিনি। কিন্তু ততদিনে জানতে পারেন তার ভাই ও চাচা শহীদ হয়েছেন সেই যুদ্ধে।

সিদ্দিকুর তখনও জানতেন না তার জন্য আরো হাহাকার অপেক্ষা করছে। ভাই হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাজাকারদের অত্যাচারে অসুস্থ হয়ে পড়েন বাবা। সেই অত্যাচার তিনি আর সইতে পারেননি। এরপর দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীন দেশের পতাকা আকাশে উড়িয়ে এক বুক গর্ব নিয়ে বাড়ি ফেরেন সিদ্দিকুর। ফিরে যান ছাত্রজীবনে।

কর্মজীবনে সিদ্দিকুর চট্টগ্রাম তেল কোম্পানি, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ রেলওয়েতে চাকরি ছাড়াও কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। বর্তমানে তিনি উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিজীবনের একেবারেই শেষ পর্যায়ে আছেন। সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের উদ্যমী হতে হবে। আমরা অস্ত্র হাতে নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি, তাদেরকে এই স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। একত্র হয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে বহুদূর। তবেই আমাদের উদ্দেশ্য সার্থক হবে।’



ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়