ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল সূর্যসেনের লাশ

রেজাউল করিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০১, ১৪ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল সূর্যসেনের লাশ

মাস্টারদা সূর্যসেন। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের এই বীর আজো চট্টলাবাসীর অহংকার।

আন্দোলনের অপরাধে তার ফাঁসি হয়েছিল, মৃতদেহে লোহার টুকরো বেঁধে বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল।

ফাঁসির আগে চট্টগ্রাম কারাগারে হাতুড়ি দিয়ে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছিল। এরপর অর্ধমৃত অবস্থায় সূর্যসেন ও তার সহযোগী তারকেশ্বর দস্তিদারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছিল। সে দিনটি ছিল ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি।

একথা সত্য যে, সূর্যসেন বাহিনী কয়েকদিনের জন্যে ব্রিটিশ শাসনকে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল।

চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ সূর্যসেনের জন্ম। সূর্যসেন শৈশবে পিতা মাতাকে হারান, কাকা গৌরমনি সেনের কাছে মানুষ হন। সূর্যসেন ছেলেবেলা থেকেই খুব মনোযোগী ও ভাল ছাত্র ছিলেন।

১৯১৬ সালে বহরমপুরে কলেজ ছাত্র থাকাকালে তিনি বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন। ১৯১৮ সালে শিক্ষাজীবন শেষ করে চট্টগ্রামে এসে সরাসরি বিপ্লবী দলে যোগ দেন।

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল একটি বড় অপারেশনে নেতৃত্ব দেন সূর্যসেন। ওইদিন  রাতে চারটি বাড়ি থেকে ৪টি দল অপারেশনে বের হয়। সেই রাতেই ধুম রেলস্টেশনে একটা মালবহনকারী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে উল্টে যায়। একদল বিপ্লবী আগে থেকেই রেল লাইনের ফিসপ্লেট খুলে নেয়। এর ফলে চট্টগ্রাম সমগ্র বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

অন্য একটি দল চট্টগ্রামের নন্দনকাননে টেলিফোন এবং টেলিগ্রাফ অফিস আক্রমণ করে। হাতুড়ি দিয়ে তারা সব যন্ত্রপাতি ভেঙ্গে দেয় এবং পেট্রোল ঢেলে সেখানে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আরেকটি দল পাহাড়তলীতে অবস্থিত চট্টগ্রাম রেলওয়ে অস্ত্রাগার দখল করে নেয়। উন্নতমানের রিভলবার ও রাইফেল গাড়ীতে নিয়ে অস্ত্রাগারটি পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগানো হয়। তবে সেখানে কোনো গুলি পাওয়া যায়নি।

সর্বশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ী বিপ্লবীরা দামপাড়ায় পুলিশ রিজার্ভ ব্যারাক দখল করে নেয়। এই আক্রমণে অংশ নেয়া বিপ্লবীরা দামপাড়া পুলিশ লাইনে সমবেত হয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। মিলিটারি কায়দায় কুচকাওয়াজ করে সূর্যসেনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সূর্যসেন অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন।

পরবর্তীতে ইংরেজ প্রশাসন সূর্যসেনকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখে। সূর্যসেন গৈরলা গ্রামে ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন। ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে সেখানে এক বৈঠকে মিলিত হন সূর্যসেন। এই বৈঠকে থাকা ব্রজেন সেনের সহোদর নেত্র সেন সূর্য সেনের উপস্থিতির খবর পুলিশকে জানিয়ে দেয়। পুলিশ আর সেনাবাহিনী বাড়িটি ঘিরে ফেলে। রাত ২টার দিকে অস্ত্রসহ সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেন ধরা পড়েন। বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে সূর্য সেনের নিজের হাতে লেখা অর্ধসমাপ্ত আত্মজীবনীর খাতা উদ্ধার করে পুলিশ। সেই খাতার উপর লেখা ছিল ‘বিজয়া’। বিচারের সময় বিজয়াতে লেখা তার কথাগুলো বিপ্লব এবং প্রশাসনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

১৭ই ফেব্রুয়ারি রাতে সূর্যসেন এবং ব্রজেন সেনকে প্রথমে জেলা গোয়েন্দা সদর দপ্তরে, পরে চট্টগ্রাম কারাগারে নেয়া হয়।

সূর্যসেন গ্রেপ্তার হবার পর তারকেশ্বর দস্তিদার দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৯৩০ সালের ১৮ মে আনোয়ারাা থানার গহিরা গ্রামে পুলিশ আর মিলিটারির সাথে সংঘর্ষের পর তারকেশ্বর দস্তিদার গ্রেপ্তার হন। ১৯৩৩ সালের মার্চ মাসে বিপ্লবীরা জেল থেকে সূর্য সেনকে মুক্ত করার জন্য কয়েকবার চেষ্টা চালায়। কিন্তু প্রতিবারই তাদের গোপন পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়।

সূর্যসেন, তারকেশ্বর দস্তিদারকে বিচারের জন্য ইন্ডিয়ানন পেনাল কোডের ১২১/১২১এ ধারা অনুযায়ী স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৯৩৩ সালে ১৪ আগস্ট এই মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। ট্রাইব্যুনাল সূর্যসেনকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। তারকেশ্বরকেও একই দণ্ড দেয়া হয়।

১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি মধ্যরাতে সূর্যসেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

পরদিন ১৩ জানুয়ারি লাশ দুটো জেলখানা থেকে ট্রাকে করে চট্টগ্রামের ৪ নম্বর স্টিমার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে মৃতদেহ দু’টোকে ব্রিটিশ ক্রুজার জাহাজে করে গভীর সমূদ্রে নিয়ে মৃতদেহের সাথে লোহার লোহার টুকরা বেঁধে বঙ্গোপসাগর ডুবিয়ে দেয়া হয়।


রেজাউল/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়