ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

উচ্চাঙ্গসংগীত সাধক ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ খান স্মরণে

মোঃ আনসার উদ্দিন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫৬, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
উচ্চাঙ্গসংগীত সাধক ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ খান স্মরণে

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের দারভাংগা জেলার তিরহুত শহরে মরহুম ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ খানের জন্ম। প্রকৃত নাম মৌলভী গুল মোহাম্মদ খান নিয়াজী। পিতা ওস্তাদ আহাম্মদ খানজি  ছিলেন দারভাংগা স্টেটের মহারাজার নিয়মিত সভা গায়ক। এবং তাঁর মায়ের নাম রাহমানী বেগম। মাত্র সাত বছর বয়সে পিতার কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে হাতেখড়ি হয়। তিনি ধ্রুপদ ও খেয়াল-এর চর্চ্চা শুরু করেন।

পিতার অকাল মৃত্যুর পর তিনি ডাগর ঘরানার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গায়ক ওস্তাদ হায়দার বক্স-এর কাছে তালিম নেন। এ সময় তিনি সারগামে অত্যন্ত পারদর্শী হয়ে ওঠেন এবং সারগামের সঙ্গে তাল, বিস্তার ও অলঙ্কারে স্বর্গীয় লাবণ্য যুক্ত করতে বিশেষ পারদর্শীতা দেখান। তিনি ধ্রুপদ ও খেয়ালে এত পারদর্শীতা লাভ করেন যে, তাঁর যাদুকরী সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে খুব সহজেই ভূপাল স্টেটের নবাব নসরুল্লাহ্ খান বাহাদুরের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হন। এবং মাত্র ১৯ বছর বয়সে ১৮৯৫ সালে নবাব নসরুল্লাহ্ খান বাহাদুরের নিয়মিত সভা গায়ক হিসাবে নিযুক্ত হন। এখান থেকেই তাঁর সংগীতের বীজ বিকশিত হতে শুরু করে।

১৮৯৬ সালে ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ খান যখন আগ্রা অবস্থান করছিলেন তখন মথুরা বৃন্দাবনে সাকুরান বিবিকে বিয়ে করেন। বারেলী শরীফের পীর হযরত আহাম্মদ নিয়াজী নান্নে মিয়া শাহ্ (রাঃ)-এর নির্দেশে ১৯১০ সালে তিনি দেশে অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে স্বপরিবারে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর যাদুকরী সুরের মূর্চ্ছনায় বিমুগ্ধ তৎকালীন ঢাকার নবাব সাহেবের সবিশেষ অনুরোধ ও সর্বোপরি ভাওয়াল রাজার আমন্ত্রণে ১৯১০ সালে ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ খান স্বপরিবারে ঢাকা চলে আসেন। তখন ঢাকায় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে খেয়ালের প্রচলন থাকলেও বিস্তার ও বিকাশ ছিল না। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চর্চ্চা ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতকে বাংলদেশে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত করার একবুক আশা নিয়ে তিনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন। তিনিই ঢাকায় খেয়ালের আদী প্রচলন প্রতিষ্ঠাকারী। এভাবেই অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনি ঢাকাবাসীর কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রিয় শিল্পী হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন।

তৎকালীন মুকুল সিনেমা হলের উপর তলায় ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ খান প্রতিমাসে একবার তাঁর বন্ধু ও ভক্তদের নিয়ে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের জলসার আয়োজন করতেন। এই জলসায় কুমিল্লার মোহাম্মদ খসরু, ময়মনসিংহের শ্রী পঁচানন্দি এবং আরো অনেক বিশিষ্ট শিল্পীরা নিয়মিত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। তাদের সারগামের শব্দে পার্শ্ববর্তী রাস্তা লোকে লোকারণ্য হয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হতো। তিনি অগণিত  ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিক্ষা দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গীত ভুবন সমৃদ্ধ করেছেন। অগণিত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে প্রখ্যাত গায়িকা লায়লা আরজুমান্দ বানু, ফেরদৌসী রহমান, রওশন আরা মুস্তাফিজ, উৎপলা সেন, দীপালি নাগ, প্রতিভা বসু, মরহুম ওস্তাদ ফজলুল হক, মরহুম ওস্তাদ মুন্সী রইসউদ্দিন, রয়েলের জমিদার, শ্রী বীরেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী প্রমুখ। তাঁর বড় ছেলে মরহুম ওস্তাদ ইউসুফ খান কোরেশীও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে বিশেষ পারদর্শীতা দেখিয়েছিলেন। কনিষ্ঠ পুত্র ওস্তাদ মোহাম্মদ ইয়াসিন খান বাংলাদেশের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত জগতে অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন।

১৯৩৬ সালের কথা। ঢাকায় তখন কোনো রেডিও সেন্টার ছিল না। একই বছর ঢাকায় নাজিমুদ্দিন রোডের একটি ছোট্ট বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয় অল-ইন্ডিয়া রেডিও- ঢাকা কেন্দ্র। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি পুরিয়া রাগ সংগীত পরিবেশন করেন। তাঁর এই উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমেই শুরু হয় অল-ইন্ডিয়া রেডিও ঢাকা কেন্দ্রের অগ্রযাত্রা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পিতার সাথে মরহুম ওস্তাদ ইফসুফ খান কোরেশীসহ অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।  সংগীত সাধক ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ খান যে সমস্ত খেয়াল ও রাগ বেশী পছন্দ করতেন তার মধ্যে রাগ পুরিয়া ধানেশ্রী, রাগ বাগেশ্রী, মালকোষ এবং মূলতানী উল্লেখযোগ্য। এই রাগ ও খেয়ালগুলো এখনো তাঁর প্রতিষ্ঠিত ছাত্র-ছাত্রীরা রেডিও এবং টেলিভিশনে পরিবেশন করে থাকেন। শাস্ত্রীয় সংগীতের মহান এই সাধক কেবল সংগীত শিল্পীই ছিলেন না, তিনি একজন ধার্মিক ছিলেন। মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত  তিনি একদিকে সংগীত সাধনা অন্যদিকে ইসলামের অনুশাসন ও ধর্মীয় আদর্শে জীবন-যাপন করেছেন। তিনি দেহতত্ত্বের উচ্চ সাধক ছিলেন। এদেশে শাস্ত্রীয় সংগীত প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদকসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ও সম্মাননা প্রদান করেন। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ তাঁর সম্মানে স্মারক ডাক টিকেট ও উদ্বোধনী খাম এবং তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী প্রকাশ করে।

১৯৭৭ সালে শাস্ত্রীয় সংগীতের মহান সাধক ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ খান দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হন। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৭৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ভোরে তিনি মারা যান। আজ তাঁর মৃত্যুদিনে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়