ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

এখনো কূল হয়নি গোকুলের লাইব্রেরির

অনার্য মুর্শিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৬, ১৮ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এখনো কূল হয়নি গোকুলের লাইব্রেরির

আলোকচিত্র: রাসেল আবেদিন তাজ

‘অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়-/ আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়/ আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে/ খেলা করে;/ আমাদের ক্লান্ত করে...।’

জীবনসায়াহ্নে এসে গোকুলচন্দ্র দাশও এখন ক্লান্ত। এতই ক্লান্ত যে, রক্তের ভিতর খেলা করা বোধকেও তিনি এখন বিকিকিনির হাটে তুলতে বসেছেন। গত ১১ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে একটি জাতীয় দৈনিকে গোকুল তার প্রাণপ্রিয় লাইব্রেরি বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দেন। ৫০ বছরের সংগৃহীত প্রায় ২ হাজার বাংলা সাহিত্যের বই, ৪৭ বছরের পুরনো সাহিত্য পত্রিকা, বাংলাদেশ এবং ভারতে প্রকাশিত ৩০০ থিসিস পেপার, দুইশ অভিধানের মূল্য হাঁকা হয় পঁচিশ লাখ টাকা। বিজ্ঞাপনটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত হয়।  

অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে গোকুলচন্দ্র শখের লাইব্রেরি কেন এভাবে বিক্রি করে দিচ্ছেন? শুধু এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা গোকুলচন্দ্রের কাছে যাই। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি আসলে  লাইব্রেরি বিক্রি করতে চান না। কিছু ক্ষোভ, কিছু বিরক্তি, লাইব্রেরি ধরে রাখার সামর্থ্যহীনতা তাকে লাইব্রেরি বিক্রির সিদ্ধান্তে উপনীত করেছে। বলা যায়, তিনি এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন।

গোকুলচন্দ্র ছিলেন ঢাকা গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের শিক্ষক। বিজ্ঞাপনে তার ছবি থাকায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছাত্রদের মধ্যেও খবরের প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্ররা প্রিয় স্যারকে পরামর্শ দেয়, তিনি যেন লাইব্রেরি বিক্রি না করেন। এতে গোকুলচন্দ্র যেনো প্রাণ ফিরে পেলেন। কিন্তু টাকা ছাড়া তিনি কীভাবে ধরে রাখবেন এই লাইব্রেরি! চৌদ্দটি আলমারির জন্য তার অন্তত দুটি কক্ষ প্রয়োজন। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও অর্থ প্রয়োজন। অথচ সেই সামর্থ্য তার এখন নেই।

গোকুলচন্দ্র বলেন, একসময় যখন স্কুলে শিক্ষকতা করতাম, কোচিং চালাতাম, তখন টাকার অভাব ছিল না। তখন বছরের পর বছর বাড়ি ভাড়া গায়ে লাগেনি। কিন্তু এখন অবসরে যাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, প্রথমে আমি ভেবেছিলাম পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলে লাইব্রেরি বিক্রি হয়ে যাবে। কিন্তু বিজ্ঞাপন প্রচার হওয়ার পর মনে হচ্ছে, লাইব্রেরিটি হয়তো বিক্রি করতে হবে না। কোনো জায়গা থেকে অনুদান আসতেও পারে, যা দিয়ে আমি এটা রক্ষা করতে পারব। আপনার অনুপস্থিতিতে লাইব্রেরির উত্তরসূরি কে হবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে গোকুলচন্দ্র বলেন, মৃত্যুর আগে ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানকে উইল করে দিয়ে যাবো।

গোকুলচন্দ্র শুধু সংগ্রাহকই নন তিনি লেখকও। তার দুটি কবিতার বই প্রকাশ হয়েছে। প্রকাশের জন্য আরো পাঁচটি পাণ্ডুলিপি তিনি প্রস্তুত করে রেখেছেন। এগুলো হলো- ঢাকা গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের ইতিহাস, শিক্ষকতা জীবনের মনোমুগ্ধকর কাহিনি, ঐশী নিরুপমা, কবিতার রূপকথা, ধানমন্ডি লেক, সারাংশ ও ভাবসম্প্রসারণ অভিধান। কোনো প্রকাশক আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি পাণ্ডুলিপিগুলো তার হাতে তুলে দিবেন।

বই ছাড়াও তার ঘরে আরো দুটি মূল্যবান সংগ্রহ রয়েছে। একটি হলো দেশ বিদেশের বিভিন্ন মডেলের দুই শতাধিক ঘড়ি। আরেকটি রেডিও। এখন পর্যন্ত তার সংগ্রহে আছে ৯৯টি রেডিও। এই সংগ্রহগুলো সম্পর্কে গোকুলচন্দ্র বলেন, এক সময় আমার বাড়িতে ঘড়ি ছিল না। পাশের বাড়ির ঘড়ি দেখে আমি কাজে যেতাম। একটা ঘড়ির অভাব আমার মধ্যে দারুণ জিদ তৈরি করে। ফলে আজকের এই ঘড়ির বিশাল সংগ্রহ। রেডিও সংগ্রহের কারণটাও অনেকটা একই রকম। নিজের বাড়িতে রেডিও ছিল না। কিন্তু কে জানত এই না থাকাটা আমাকে একদিন সংগ্রাহক বানিয়ে দিবে!
গোকুলের লাইব্রেরি বিক্রয়ের খবরটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লেও এখনো কোনো ফল তিনি পাননি। যার ফেইসবুক আইডি থেকে বিজ্ঞাপনটি বেশি শেয়ার হয়েছে সেই আইডি হয়ত অধিক পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু তাতে গোকুলচন্দ্রের লাইব্রেরির কোনো কূল হয়নি- না লাইব্রেরিটি বিক্রি হলো, না কেউ এটি রক্ষার জন্য অনুদান নিয়ে এগিয়ে এলো।

গোকুলচন্দ্র বলেন, আমি দেখতে পেলাম আমার সঙ্গে কোনো প্রকার যোগাযোগ না করে এই লাইব্রেরির নাম ভাঙিয়ে কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে টাকা তোলার ঘোষণা দিচ্ছেন। এমনকি তারা প্রচার করছেন স্ত্রীর ক্যানসারের কারণে আমি এটা বিক্রি করে দিচ্ছি। অথচ আমার স্ত্রী দিব্যি সুস্থ আছে। আমি আশা করছি কেউ এ ধরনের মিথ্যা প্রচারে বিভ্রান্ত হবেন না। কেউ যদি আগ্রহী হোন আমার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করবেন।


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়