ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ইতিহাস সেরা দুই নারী জলদস্যু

ইকবাল মাহমুদ ইকু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১১, ২৪ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইতিহাস সেরা দুই নারী জলদস্যু

‘জলদস্যু’ শব্দটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে আপনার চোখে কি কোনো নারী অবয়ব ভেসে ওঠে? হয়তো না। তবে ইতিহাস ঘাটলে এমন বহু নারী জলদস্যুর দেখা মিলবে যারা দস্যু হিসেবে পুরুষদের চেয়ে নিষ্ঠুরতায়, চাতুর্যে কম ছিলেন না।

সাইয়্যেদা আল হুরা ষোল শতকের শুরুর দিকের জলদস্যু। দস্যু না বলে তাকে ‘দস্যু রানী’ বলা ভালো।  তাকে অবশ্য সবাই ‘রানী’ বলেই ডাকত। ১৪৪৫ সালে স্পেনের গ্রানাডায় জন্ম। সেখানে খ্রিষ্টানদের কাছে মুসলিম রাজত্বের পতনের পর আল হুরা পরিবারের সাথে মরক্কো পালিয়ে যান। ষোল বছর বয়সে আল মান্দ্রি নামে একজনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। আল মান্দ্রি ছিল আল হুরার চেয়ে ত্রিশ বছরের বড় এবং উত্তর মরক্কোর তেতোয়ান শহরের গভর্নর। আল হুরা স্বামীকে শহর পরিচালনার কাজে সাহায্য করতেন এবং মান্দ্রির মৃত্যুর পর গভর্নর হন। 

খ্রিষ্টানরা যে তার পরিবারের উপর অত্যাচার চালিয়েছিল এবং তাদের বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছিল এই ঘটনা হুরা কখনো ভুলতে পারেননি। প্রতিশোধ নিতে সে একটি জলদস্যু বাহিনী গঠন করে এবং তুর্কি জলদস্যু ‘অরুক রেইস’-এর সঙ্গে হাত মেলায়। অরুক রেইস ইউরোপে ‘বার্বারোসা’ নামে পরিচিত ছিল। দুই জলদস্যু দলের মিলিত বাহিনী গভীর সমুদ্রে টহল দিত। তারা স্প্যানিশ এবং পর্তুগীজ জাহাজগুলো লুট করে নাবিকদের বন্দী করে মুক্তিপণ আদায় করতো। হুরা ভূমধ্যসাগরের পশ্চিম দিক, আর অরুক রেইস পূর্ব দিক নিয়ন্ত্রণ করতো। স্পেনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই মিলিত জলদস্যু বাহিনী ছিল তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ বাহিনী যারা সমুদ্র শাসন করতো। 

১৫৪১ সালে মরক্কোর রাজা আহমেদ আল ওয়াত্তাসী আল হুরাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। হুরা এতে অস্বীকৃতি জানালে ওয়াত্তাসী বাধ্য হয়ে নিজ রাজধানী ছেড়ে তেতোয়ান শহরে আসে। হুরা তাকে স্বামী হিসেবে বরণ করে নেয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ওয়াত্তাসী তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে তার সকল সম্পত্তি দখল করে নেয়। এরপর সাইয়্যেদা আল হুরার শেষ পরিণতি কী হয়েছিল ঠিক জানা যায় না। তবে এটুকু জানা যায় যে, নিজের ভাগ্যকে মেনে নেয়া একসময়ের সমুদ্র কাঁপানো নারী জলদস্যু আল হুরা’র মৃত্যু হয় ১৫৬১ সালের জুলাই মাসের ১৪ তারিখে।

মূলত ‘চেং আই সা’ নাম হলেও তিনি ‘চিং শিহ’ নামেই পরিচিত। জন্ম ১৭৭৫ সালে চীনের গুয়াংডং জেলায়। বাবা-মা নাম রেখেছিল শিল জিয়াং গু। চীনের ভয়ঙ্কর এই নারী জলদস্যু প্রথম জীবনে পতিতা ছিলেন। ১৮০১ সালে জলদস্যু জিং ইয়েই চিং শিহ’র রূপে মুগ্ধ হয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তবে আদৌ তাদের বিয়ে হয়েছিল কি না এ নিয়ে ইতিহাসে মতবিরোধ রয়েছে। 

সে যাই হোক, জিং ইয়েই ছিল কুখ্যাত জলদস্যু জাহাজ ‘রেড ফ্ল্যাগ’-এর ক্যাপ্টেন। কিছু ঐতিহাসিকের মতে, জিং ইয়েই তার জলদস্যু বাহিনীকে ক্যান্টনের সী ব্রোথেল থেকে চিং শিহকে তুলে আনতে পাঠিয়েছিল। তারা সী ব্রোথেলে ভাংচুর করে তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। মতান্তরে এটাও জানা যায় যে, জিং ইয়েই চিং শিহ’কে বিয়ের প্রস্তাব দিলে সে জাহাজের অর্ধেক মালিকানা দাবি করে। জিং ইয়েই এই দাবি মেনে নিলে তাদের বিয়ে হয় এবং তারা একত্রে জাহাজ পরিচালনা শুরু করে।

এই দম্পতি একটি পুত্র সন্তান দত্তক নেয়। নাম চেং পাও। ১৮০৭ সালে বিয়ের মাত্র ছয় বছরের মাথায় জিং ইয়েই মারা যায়। মৃত্যুর সময় প্রায় চারশ জাহাজ এবং প্রায় আশি হাজার জলদস্যু জিং ইয়েই-এর নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু বিভিন্ন কূটকৌশলে সেগুলো চিং শিহ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। চিং শিহ এবং তার পালিত পুত্র চেং পাও-এর মধ্যে অবৈধ প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। চিং শিহ চেং পাওকে বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড পদে নিযুক্ত করে। তারা একত্রে ‘রেড ফ্ল্যাগ’ বাহিনীর মাধ্যমে সমুদ্র শাসন করতে থাকে।

চিং শিহ বাহিনীতে কিছু নিয়ম চালু করে যা খুবই কড়াকড়িভাবে মানতে হতো। ক্যাপ্টেন ছাড়া অন্য কেউ নির্দেশ দিতে পারত না। নির্দেশ অমান্য করলে মৃত্যু। যেসব গ্রাম জলদস্যুদের সাহায্য করতো সেসব গ্রামে কেউ চুরি, ছিনতাই করতে পারত না। নারী বন্দীদের সঙ্গে সঙ্গম করলেও মিলত শাস্তি। যদি বন্দিনীর সম্মতি থাকে তবুও কেউ এই আদেশ অমান্য করতে পারত না। ধরা পড়লে সেই জলদস্যুর শিরশ্ছেদ করা হতো আর বন্দিনীর পায়ে পাথর বেঁধে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হতো। জলদস্যু জাহাজের কোনো নাবিক বিনা ছুটিতে অনুপস্থিত থাকতো তাহলে তার এক কান কেটে ফেলা হতো।

চিং শিহ-এর নেতৃত্বে ‘রেড ফ্ল্যাগ’ জলদস্যুরা অসংখ্য জাহাজ লুট করেছে। সরকার ১৮০৮ সালে এই জলদস্যুদের দমন করার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন সরকারের নৌবাহিনী আর এই কুখ্যাত জলদস্যু বাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে নৌবাহিনীর এতটাই ক্ষতি হয়েছিল যে, বলা হয়- সরকারের কাছে মাছ ধরার জাহাজও ছিল না। অবশেষে ও পো তায় নামে এক জলদস্যু বাহিনী রেড ফ্ল্যাগকে পরাজিত করে ডুবিয়ে দেয়। ও পো তায়ও ছিল ভয়ঙ্কর জলদস্যু। তারা ১৮১০ সালে রাজার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। চেং পাও সরকারি কর্মচারী হিসেবে বাকি জীবন পার করে দেয়। চিং শিহ গুয়াংজো শহরে একটি ব্রোথেল চালানো শুরু করে। ১৮৪৪ সালে, ৬০ বছর বয়সে সে মারা যায়।


ঢাকা/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়