ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘তোমরা কী চাও- মা নাকি আর্থিক স্বচ্ছলতা?’

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৯, ২৬ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘তোমরা কী চাও- মা নাকি আর্থিক স্বচ্ছলতা?’

বলা যায় নিজেই সুবিধাবঞ্চিত। চা বিক্রি করাই পেশা। তারপরও সর্বস্ব দিয়ে তিনি দাঁড়িয়েছেন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে। ‘শুভ স্যার’ নামেই তিনি পরিচিত। তার তৈরি চা পান করতে করতে জানা গেল একজন মানবিক মানুষের গল্প। এই গল্পের পেছনের প্রেরণা কী? জানতে চাইলে শুভ পাল্টা হাসি দিয়ে জানালেন- স্বপ্ন।

‘স্যার, আমার রাবার নাই।’

‘শুভ স্যার, আমার অঙ্ক খাতা শেষ হইয়া গেছে। একটা খাতা দেন।’

‘ও স্যার, একটা বই দেন না!’

একের পর এক আবদার। হাসি মুখে আনন্দ নিয়ে সকলের আবদার মিটিয়ে চলেছেন ২৫ বছর বয়সী শুভ। পাশাপাশি উচ্চ কণ্ঠে চলছে পাঠদান। তাকে অনুকরণ করছে ২০-৩০ জন শিশু। গলার রগ ফুলিয়ে সমস্বরে বলছে- অ, আ, ই, ঈ...।

নারায়ণগঞ্জ চাষাঢ়া রেলস্টেশন প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে চোখে পড়ল এই দৃশ্য। প্ল্যাটফর্মের একপাশে খোলা আকাশের নিচে ছেঁড়া চটের ওপর বসেই চলছে পাঠদান। ঘিরে ভিড় জমিয়েছেন উৎসুক জনতা। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন বিকেলে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে বসে এই পাঠশালা। এখানে বই আনার চাপ নেই, নিজ খরচে কিনতে হয় না কিছু, সবকিছুই দেয়া হয় পাঠশালা থেকে। যিনি দেন তিনিই শিশুদের প্রাণ শুভচন্দ্র দাস। তিনিই এই পাঠশালা অর্থ্যাৎ ‘লাল সবুজের পতাকা শ্রী শুভচন্দ্র দাস প্রাথমিক বিদ্যালয়’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং একমাত্র শিক্ষক। যদিও শিক্ষকতা তার পেশা নয়, আগেই বলেছি- তিনি পেশায় চা বিক্রেতা।

ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিলো পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষক হবেন। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর আর্থিক টানাপোড়েনে পঞ্চম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। থমকে যায় স্বপ্ন। শুভ উদাস দৃষ্টিতে স্মৃতিচারণ করেন, ‘২০০৫ সালে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় মায়ের টিবি রোগ ধরা পরে। মা শয্যাশায়ী, চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা প্রয়োজন। আব্বা একদিন আমাদের চার ভাই-বোনকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- তোমরা কী চাও- মা নাকি আর্থিক স্বচ্ছলতা? তারপর মায়ের চিকিৎসার জন্য বাবা গ্রামের বাড়ি-ঘর যা ছিলো সব বিক্রি করে দিলেন। পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে গেল। আমরা ভাইবোনেরা মাকে সুস্থ করে তোলার আশায় গার্মেন্টসে কাজ শুরু করলাম কিন্তু মা বাঁচল না।’

শুভ বলেন, ‘তবু স্বপ্নটা মনে পুষে রেখেছিলাম। জীবিকার তাগিদে চাষাঢ়া রেলস্টেশনের একটা চায়ের দোকানে কাজ শুরু করি। কাজের ফাঁকে এখানকার বস্তির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে প্রায়ই আড্ডা দেয়ার সুযোগ হতো। আড্ডার ছলে নানা কথোপকথনে ওদের স্বপ্নের সঙ্গে পরিচিত হই। জানতে পারলাম ওদের পড়াশোনা করার প্রবল ইচ্ছার কথা। কিন্তু টাকা দিয়ে পড়ানোর মতো সামর্থ্য ওদের বাবা-মায়ের নেই।’

শুভ দেখলেন, সমাজে তার মতো অসংখ্য শুভ স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা নিয়ে ঘুরছে। তিনি তখন এগিয়ে এলেন ওদের স্বপ্নপূরণে। শুভ নিজের মুখেই বললেন, তার শিক্ষক হয়ে ওঠার গল্প- ‘২০১৬ সালে রেললাইনের পাশে অপু-দিপুর লাইব্রেরি থেকে ২১টি বই আর ১০জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু করি এই বিদ্যালয়। প্রথমে একটা ঘর থাকলেও টাকার অভাবে ঘরটা ছেড়ে দিতে হয়। তাই বাধ্য হয়ে রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে প্ল্যাটফর্মের একপাশে চট বিছিয়ে নিয়েছি। উত্থান-পতন নিয়েই চলছে জীবন। অনেক ঝড় গিয়েছে, এখনো যাচ্ছে। ঘর নেই, টাকা পয়সার অভাবে অনেক সময় ওদের ঠিকমতো বই, খাতা, পেন্সিল, রাবার কিনে দিতে পারি না। তবুও হাল ছাড়তে চাই না। আমি চাই না আমার মত কেউ অর্থের অভাবে স্বপ্ন থেকে ঝরে পড়ুক।’

স্কুলটিতে শিশু থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়। বর্তমানে স্কুলের শিক্ষার্থী ৭০ জন। এখান থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর যাদের অবস্থা স্কুলে ভর্তি করার মত হয়ে যায়, তাদের আশেপাশের সরকারি স্কুলগুলোতে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়।

শুভ বলেন, ‘বস্তিতে বড় হলেও এরা অনেকেই মেধাবী। ভালোমত পড়াশোনা করাতে পারলে ওরা ভবিষ্যতে ভালো কিছু করতে পারবে। তাই শত কষ্টের পরেও চায়ের দোকান থেকে যতটুকু আয় করতে পারছি ততটুকু দিয়েই ওদের স্বপ্নপূরণের চেষ্টা করছি।’

শুভ তার স্বপ্নের কথা জানিয়ে বলেন, ‘আমার অপূরণীয় স্বপ্ন ওদের দিয়েই পূরণ করতে চাই। একদিন এই স্কুল থেকে বের হওয়া শিক্ষার্থীরা দেশের সম্মানজনক পদে চাকরি করবে। হয়তো ওরাও একদিন এমন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করবে। দেশের জন্যে কাজ করবে। সেদিনই আমি সার্থক হবো। আমার স্বপ্নপূরণ হবে। ওদের অদম্য ইচ্ছাই আমার অনুপ্রেরণা।’ 

বেলা গড়িয়ে তেজ কমছে সূর্যের। বাড়ছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। ফিরোজা বেগম নামের এক নারী তার ৭ বছর বয়সী শিশুকন্যা বিথীকে নিয়ে স্কুলে এসেছেন। অন্যের বাসায় কাজ করে ছেলেমেয়ের অক্ষরজ্ঞান দেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও নিজের মত সন্তানদের অশিক্ষিত হতে দিতে চান না। ফিরোজা বলেন, ‘একবেলা খাবারই জোটে না, পোলাপাইন পড়ামু কী দিয়া? স্কুলে অনেক খরচা। এই খরচা দিয়া পোলাপাইন পড়ান সম্ভব না। আমাগো মতো মানুষগো লাইগা আল্লাহ শুভ স্যাররে পাঠাইছে। আমাগো শুভ স্যারই ভরসা।’

কথা হয় কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। ওদের কারো বাবা আছে, মা নেই। কারো বাবা-মা কেউ নেই। অনেকে জানেই না ওদের বাবা-মা কোথায় আছে। তবুও ওরা স্বপ্ন দেখে বড় হওয়ার। কেউ বড় হয়ে হতে চায় ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার। কারো আবার ইচ্ছে, শুভ স্যারের মতো শিক্ষক হওয়ার। স্থানীয় কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রেল স্টেশনের আশেপাশের ছেলেমেয়েরা এখানেই পড়াশোনা করে। তাদের দাবি- যদি সরকারি উদ্যোগে শুভ স্যারকে কিছু টাকা দেয়া যেতো তাহলে আরো ভালোভাবে তিনি স্কুলটি পরিচালনা করতে পারতেন।


ঢাকা/তারা  

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়