ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পাকিস্তানকে অস্ত্র পাঠাতে বাধা দেন যুক্তরাষ্ট্রের টেলর

কেএমএ হাসনাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৩৫, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পাকিস্তানকে অস্ত্র পাঠাতে বাধা দেন যুক্তরাষ্ট্রের টেলর

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পাশে দাঁড়ায়। শুধু আর্থিক সহায়তা নয় পাকহানাদার বাহিনীর নির্মমতাকে উস্কিয়ে দেয়ার যত ধরনের অপকৌশল ছিল তার সবটাই তারা করেছে।

তবে মার্কিন জনগন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের পাশে ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বাঙালির কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব মানবতাকে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানানোর পাশাপাশি অর্থ সংগ্রহ করে তা প্রবাসী সরকারের কাছে পাঠিয়েছে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনেক বিদেশি রাত দিন পরিশ্রম করেছেন। যাদের অবদান অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। দিন পরিক্রমায় আমরা হয়তো অনেককেই ভুলে গেছি, অনেকেই লোক চক্ষুর আড়াল থেকে গেছেন উদ্যোগের অভাবে। যাদের কথা প্রতিনিয়তই আমাদের স্মরণ রাখা উচিত। এদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোর সমুদ্রবন্দর শ্রমিকদের ভূমিকা অন্যতম।

বাল্টিমোর আমেরিকার মেরিল্যান্ড রাজ্যের সবচেয়ে বড় শহর। এখানে রয়েছে বাল্টিমোর সমূদ্রবন্দর। অনেক বাঙালি এ বন্দরে কাজ করে জীবীকা নির্বাহ করেন। এই সমূদ্রবন্দরে প্রতিদিন অনেক বড় বড় জাহাজ ভিড়ে। এসব জাহাজে পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজ করে অনেক শ্রমিকের সংসার চলে। কোনো কারণে বন্দর বন্ধ থাকলে বা শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিলে শ্রমিকদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়।

বন্দরটিতে তখন পাকিস্তানেরও পদ্মা নামে একটি জাহাজ নোঙ্গর করা ছিল। খবর ছিল ওই জাহাজে করে আমেরিকা সরকার পূর্বপাকিস্তানে বাঙালি নিধনে অস্ত্র পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে। বন্দরে ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল। শ্রমিকদের যত্রতত্র ঘোরাঘুরির ওপর ছিল নজরদারি। এমন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও ১৯৭১ সালের ১৪ জুলাই ওই বন্দরের একদল শ্রমিক ও স্থানীয় কিছু অধিবাসী পদ্মা জাহাজে অস্ত্র তুলতে বাধা দেয়। শুধু তাই নয় তারা অনেকগুলো ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে বাঁধ তৈরি করে ওই জাহাজের গতিপথ আটকে দিয়েছিল।

নিক্সন সরকারের বিরুদ্ধে এ প্রতিবাদ করতে গিয়ে সেদিন অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। জাহাজটি ছিল কয়েক হাজার টন ওজনের। বাল্টিমোরের জনগনের সেদিনের প্রতিবাদের ফলে ওই জাহাজ বন্দর থেকে কোনো অস্ত্র ও সরঞ্জামাদি নিতে পারেনি। স্থানীয়দের বাংলার মানুষের প্রতি এই সহানুভূতির ফলে সেদিন পুরো আমেরিকা এবং বিশ্বের অনেক দেশের মানুষ বাংলাদেশে পাক বাহিনীর হত্যাকান্ডের কথা জানতে পারে।

বাল্টিমোরের শ্রমিকদের এ কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন উন্নয়নকর্মী রিচার্ড কে. টেলর। পরে তিনি এ সংক্রান্ত একটি বই (ব্লকেড এ গাইড টু নন-ভায়োলেন্ট ইন্টারভেনশন) লিখেছিলেন। সেদিন শ্রমিকরা বলেছিলেন, যে অস্ত্র তাঁদের জাহাজে তুলে দেওয়ার কথা, সেই অস্ত্র দিয়েই তো পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। এই অস্ত্রের গুলিইতো কেড়ে নেবে নারী-শিশুসহ অসংখ্য মানুষের অমূল্য প্রাণ। বাল্টিমোরের শ্রমিকরা এতটা বিবেকহীন নন যে তাঁরা মানুষ হয়ে মানুষ হত্যার রসদ সরবরাহের অনুষঙ্গে পরিণত হবেন। অচলাবস্থা দেখা দিল বাল্টিমোর বন্দরে। বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও বন্দর শ্রমিকরা পদ্মায় অস্ত্র তুলে দেওয়াতো দূরের কথা উল্টো প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

করাচি থেকে পাকিস্তান শিপিং করপোরেশনের জরুরি টেলিগ্রাম এল বাল্টিমোর পোর্ট অথরিটির কাছে। শ্রমিকদের এই কর্মকাণ্ড পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ’ হিসেবেই মনে করতে থাকল পাক শিপিং করপোরেশন। তখন ইয়াহিয়ার শিখিয়ে দেওয়া বুলি আওড়াচ্ছিল শিপিং করপোরেশন।

মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানের বন্ধু। কিন্তু তারা তো আর নিজ দেশের মানুষের শত্রু নয়! বাল্টিমোরের শ্রমিকদের পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি পরোক্ষ সমর্থনকে কিন্তু তারা সরকারি কাজে বাধাদান হিসেবে না দেখে শ্রমিকদের কর্ম ও চিন্তার স্বাধীনতা হিসেবেই দেখল। তবে বন্ধুকেও তো খুশি করতে হবে। লোক দেখানোর মতো করেই অস্ত্র বোঝাই করে দিতে অস্বীকৃতি জানানো শ্রমিকদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয় এক রাত জেল খেটে তাঁরা পরের দিন সকালেই মুক্তি পান। ঘটনাটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে দ্রুত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।

 

 

টেলরের ওই বইয়ে বর্ণিত আছে, ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোর বন্দরে নৌ অবরোধের ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রেও এই ঘটনার কিছু কিছু তথ্য আছে। টেলর তার লেখা বইয়ে ওই অবরোধ ঘটনার সবিস্তার বিবরণ লিখলেও ২০১১ সালে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বিশেষ অনুরোধে তিনি সেই আন্দোলনের সারসংক্ষেপ রচনা করে দূতাবাসের একটি প্রকাশনার জন্য জমা দেন। এছাড়াও নানা সময় রিচার্ড টেলর ও আন্দোলনে অন্যতম সহযোগী তাঁর স্ত্রী ফিলিপ টেলর পত্র-পত্রিকায় এই আন্দোলনের তাৎপর্য নিয়ে লিখেছেন ও আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন। সে সময় প্রবাসী যেসব বাঙালি এই আন্দোলনে অংশ নেন তাঁরাও নানা সময় এই নিয়ে আলোকপাত করেছেন, যা বিভিন্ন গবেষণা সূত্রে এখন পাওয়া যাচ্ছে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ঘটনাবলীর বিবরণ জেনে টেলর ও তাঁর বন্ধুরা বিচলিত হন এবং পাকিস্তানে মার্কিন নীতির প্রতি রুষ্ট হন। তাঁরা চিন্তা করতে থাকেন কেমন করে এই নীতিকে চ্যালেঞ্জ করে পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন নীতির বিচ্যুতি তারা তুলে ধরবেন। কারণ ইতোমধ্যে সারা বিশ্বের মিডিয়ায় বাংলাদেশে ২৫ মার্চের পরের সহিংস পরিস্থিতির সচিত্র প্রতিবেদন প্রচারিত হয়, যেখানে সঙ্গত কারনেই পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতার খবরও ছিল। ফলে সংবেদনশীল মার্কিন নাগরিকরা এই হীন নীতির সমালোচনা করতে থাকেন।

অপরদিকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিশ্বের নানা দেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন ও সম্মান জানিয়ে ওইসব দেশের নীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করতে সংগঠিত হচ্ছিলেন, যাতে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার সেসব দেশের সমর্থন পায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রবাসী বাংলাদেশিরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য আর্থিক সহায়তা করারও উদ্যোগ নেন। অনেকে নিজেদের আয়েশি জীবন পরিত্যাগ করে প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন ও যুদ্ধক্ষেত্রের খবরাখবর সেসব দেশে পাঠিয়ে বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে সহযোগিতা করেন।

রিচার্ডের শহর ফিলাডেলফিয়া থেকে প্রায় ১০০ মাইল দূরে দেলাওয়ার রাজ্যে ১৯৭১ সালের মে মাসে তড়িৎ প্রকৌশলী এ এম মাজহারুল হকের নেতৃত্বে প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়ে নামে একটি সংগঠনের (Friends of East Bengal ev FEB) জন্ম হয়। এ সংগঠনের প্রথম সভাপতি ছিলেন প্রকৌশলী মাজহারুল হক, সহ-সভাপতি মোনায়েম চৌধুরী, কোষাধ্যক্ষ হন নূরুল হক।

প্রায় ২৫ সদস্য নিয়ে এই সংগঠন যাত্রা শুরু করে, যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সুলতানা আলম (সুলতানা ক্রিপেন্ড্রফ নামে পরিচিত), যিনি বাল্টিমোরে পদ্মা জাহাজে গোপনে অস্ত্র সরবরাহের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। সুলতানা আলম (তখন বয়স ৩১) তাঁর মার্কিন বন্ধুদের এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করেন।

পত্র-পত্রিকায় এ বিষয়ে খবর জেনে ও সুলতানা আলমের সঙ্গে আলাপের পরে রিচার্ড টেলর এবং তাঁর বন্ধু বিল ময়ের বাল্টিমোর সমুদ্রবন্দরে অস্ত্রের ওই জাহাজ ঠেকাতে এক অভিনব প্রস্তাব করেন। তাঁরা সবাই একমত হন যে, ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে পাকিস্তানী জাহাজকে তাঁরা ঘিরে রাখবেন ও বন্দর ছেড়ে যেতে দেবেন না। ফিলাডেলফিয়ায় রিচার্ডের সংগঠনের সভায় এই বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে প্রচুর আলোচনা হয়। এক সদস্য সুসান ক্যারোল খুবই উত্তেজিত হয়ে এক পর্যায়ে এমনও প্রস্তাব করলেন, মাইন বেঁধে আমরা এই অস্ত্রের জাহাজ উড়িয়ে দেব।

বিল ময়েরের প্রস্তাবে মাত্র চার দিনের প্রস্তুতি নিয়ে ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা গাড়ির ছাদে বেঁধে তাঁরা বাল্টিমোরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। ১১ জুলাই পদ্মা জাহাজের নোঙ্গর করার কথা। ইতোমধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশী ও প্রচুর মার্কিন নাগরিক সেখানে জড়ো হন। পত্র-পত্রিকায় এই সংবাদ ব্যাপক প্রচার হতে থাকে। ১১ জুলাই পদ্মা বাল্টিমোরে আসেনি। কিন্তু অবরোধকারীরা সমুদ্রে তাঁদের ডিঙ্গি নিয়ে মহড়া দিতে থাকেন। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক চিকিৎসক অধ্যাপকের বরাত দিয়ে কোনো কোনো মিডিয়া তাঁদের এ মহড়াকে বাংলাদেশের প্রথম নৌ-বাহিনীর প্রতিরোধ বলেও আখ্যায়িত করে।

যদিও এ সময় মার্কিন প্রশাসন বারবার জানাচ্ছিল যে, কোন অস্ত্র পাকিস্তানে দেয়া হয়নি। কিন্তু কেউই তা মানতে চাইছিল না। ১১ থেকে ১৪ জুলাই জাহাজ আসা পর্যন্ত অবরোধকারীরা তাঁদের মহড়া অব্যাহত রাখেন। এ সময় তাঁরা মিডিয়া ছাড়াও স্থানীয় পুলিশকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, এই আন্দোলন সম্পূর্ণ অহিংস ও পাকিস্তানের কাছে যে অস্ত্র যাচ্ছে তা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী মানুষের বিরুদ্ধে অত্যাচার ও গণহত্যা পরিচালনা করবে, যা মার্কিন জনগণ মেনে নিতে পারে না।

কিন্তু ১৪ তারিখে অস্ত্র নিতে আসা ওই জাহাজের চারপাশের অবরোধ প্রত্যাহার করে নিতে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ক্রমাগত চাপ দিতে থাকে। একপর্যায়ে রিচার্ড টেলরসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করে। বিচারে আন্দোলনকারীদের এক বছর জেল দেয়া হয়, যদিও অহিংস আন্দোলনের কারণে তাঁরা পরদিনই ছাড়া পেয়ে যান।

টেলর ও তাঁর বন্ধুরা বাংলাদেশিদের নিয়ে এই আন্দোলনের কারণ মিডিয়ায় বিস্তারিত তুলে ধরেন, যা সারা বিশ্বে আলোচনা হতে থাকে। তাঁরা কংগ্রেসে গিয়েও ধরনা দেন, যাতে বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানের নির্মমতার দ্রুত অবসান হয় ও বাংলাদেশ তার স্বাধিকার অর্জন করে।



ঢাকা/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়