ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে গুজবের ছড়াছড়ি

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:১২, ৩১ জুলাই ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে গুজবের ছড়াছড়ি

করোনায় স্থবির বিশ্ব। মন্থর বিশ্ব অর্থনীতির চাকা। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্যকর ভ্যাকসিনই পারে এই মহামারি সফলভাবে মোকাবিলা করতে। এই দুর্যোগময় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের বিকল্প নেই। যে কারণে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

জাতিসংঘের সর্বশেষ তথ্যমতে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে করোনার টিকা আবিষ্কারের জন্য ১৭৩টি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এ্রর মধ্যে অন্তত ৪টি টিকা ট্রায়ালের সর্বশেষ ধাপে রয়েছে। ১৩টি রয়েছে দ্বিতীয় ধাপে। এ ছাড়াও মানব শরীরে প্রয়োগ করা হয়েছে ৩০টিরও বেশি টিকা। কিন্তু এসব গবেষণায় বাধা হয়ে উঠেছে  সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, এমনকি বিভিন্ন গণমাধ্যমে টিকা নিয়ে নানা ধরনের গুজব বা অসত্য তথ্য প্রচার।

অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীরা যে ভ্যাকসিন তৈরি করছেন, সেটি মানবদেহে প্রয়োগ করে নিশ্চিত হওয়া গেছে, এটি মানবদেহে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি ও টি-সেল তৈরি করে। এবং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুবই কম। 

তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুসারে এই টিকার আরো গবেষণার জন্য তৃতীয় দেশ হিসেবে আফ্রিকায় ট্রায়াল চালানোর কথা থাকলেও তা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ইতোমধ্যেই দেশটিতে ‘উই আর নট গিনিপিগ’ নামে আন্দোলন শুরু হয়েছে। দেশটির একদল তরুণ নিজেদের গিনিপিগ হতে দিতে রাজি নন। এই আন্দোলন বেশ কয়েকটি শহরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে মানুষের মনে এক ধরনের এন্টি ভ্যাকসিন মনোভাব তৈরি হয়েছে বলে বিবিসি’র এক রিপোর্টে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইউটিউব-এ নানা ধরনের মতামত ছড়িয়ে পড়েছে। এ্ররই পরিপ্রেক্ষিতে দানা বাঁধতে শুরু করেছে ভ্যাকসিন ট্রায়ালের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন।

ভ্যাকসিনের প্রতি মানুষের এমন বিরূপ মনোভাবের কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, এর পেছনে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইউটিউব-এ ভাইরাল হওয়া কয়েকটি ভিডিও। এসব  ভিডিওতে ভুল ধারণা বা কুসংস্কার ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে মানুষের মনে সংশয়ের বীজ দানা বেঁধেছে।

সবচেয়ে বেশি যে কথাটি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তা হলো- টিকা গ্রহণকারীর ডিএনএ’র গঠন বদলে যাবে। এটি দাবি করেছেন ক্যারি ম্যাডেই নামে একজন অস্টিওপ্যাথ। তিনি একটি ভিডিও বার্তায় দাবি করেছেন, অক্সফোর্ডের উদ্ভাবিত কোভিড-১৯ এর টিকা যাদের দেওয়া হবে তাদের ডিএনএ’র গঠন বদলে যাবে। ফলে টিকা গ্রহীতারা জেনেটিক্যালি মডিফাইড প্রাণীতে পরিণত হবে। এই ভ্যাকসিন মানুষকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি ইন্টারফেসের সঙ্গে যুক্ত করে দেবে।’

বিবিসি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্যারি ম্যাডেই প্রমাণ ছাড়াই এসব দাবি করেছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাকসিন দলের প্রধান ড. অ্যান্ড্রু পোলার্ড বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ভ্যাকসিনের কাজ শরীরকে ভাইরাস চিনিয়ে দেওয়া এবং তার সঙ্গে লড়াই করতে শরীরের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে জাগিয়ে তোলা। আমাদের ভ্যাকসিনে এমন কোনো উপাদান বা প্রযুক্তি নেই যা মানুষের ডিএনএ বদলে দিতে পারে বা তাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ইন্টারফেসের সঙ্গে যুক্ত করতে পারে।’ নিরাপত্তার ব্যাপারে আমরা সব সময়ই সর্বোচ্চ সাবধানতা ও কঠোর প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছি। আমাদের সব ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা চালানো হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের প্রতিটি নিয়ম পালন করে। এখন পর্যন্ত টিকার পরীক্ষা যাদের ওপর চালানো হয়েছে তাদের কারো ক্ষেত্রেই কোনো বিপজ্জনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। ১৬-১৮ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেছেন, তাদের টিকা নেবার পর জ্বর হয়েছে। যা প্যারাসিটামলের মাধ্যমে সারিয়ে তোলা হয়েছে। বলেছেন ড. অ্যান্ড্রু পোলার্ড।

স্প্যানিশ ফ্লু’র ভ্যাকসিন নিয়েও গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। বলা হচ্ছে, ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারির সময় ৫ কোটি মানুষ টিকার কারণেই মারা গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন বলছে, তথ্যটি বানোয়াট। কেননা সে সময় কোনো টিকাই ছিল না। ফলে টিকা প্রয়োগের প্রশ্নই আসে না।

সর্বশেষ গুজব রটেছে ভ্যাকসিনের মাধ্যমে বিল গেটস মানুষের শরীরে এক ধরনের বায়োলজিক্যাল মাইক্রো চিপ ঢুকিয়ে দিতে চান। গুজবটি বেশি রটেছে ইংল্যান্ডের ব্র্যাডফোর্ড শহরে। এ বিষয়ে পাকিস্তানের কয়েকটি সংবাদপত্রে খবরও প্রকাশিত হয়েছে।

এ ছাড়াও করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে ফেসবুকে কিছু গ্রুপে বিতর্ক হচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের অনেকে মনে করেন, এত দ্রুত গতিতে করা গবেষণায় যে ভ্যাকসিন তৈরি হবে, তা কতটা নিরাপদ- এ নিয়ে তাদের সন্দেহ আছে!

এতো ধরনের গুজবের ফলস্বরূপ এখন আফ্রিকাজুড়ে চলছে খণ্ড খণ্ড মানববন্ধন ও ক্যাম্পেইন। ক্যাম্পেইনকারীরা বলছেন ‘উই আর নট গিনিপিগ’। আফ্রিকা-ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা ইডব্লিইএন-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বুধবার (২২ জুলাই) ভ্যাকসিনবিরোধী একটি দল জোহানেসবার্গের রাস্তায় তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। টিকার জন্য তারা আফ্রিকাকে প্রথম পরীক্ষাক্ষেত্র করার প্রতিবাদে এই সমাবেশ করেছে বলে জানা গেছে। তাদের দাবি, ১৯৮০ সালে যখন এইডস আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে, তখন এই মহামারি আফ্রিকাকে তছনছ করে দিয়েছে। ফলে তারা আর নতুন করে ঝুঁকি নিতে রাজি নয়।

তাদের আরেকটি দাবিও রয়েছে, তা হলো- যদি ভ্যাকসিন টেস্ট করাতেই হয়, তাহলে প্রথমে সাংসদ, মন্ত্রী এবং তাদের সন্তানদের উপর করতে হবে। কোনো গরিবের উপর নয়।

 

 

সূত্র: বিবিসি ও ইডব্লিউএন

ঢাকা/তারা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়