ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

দৃষ্টিকটু টাওয়ারটি আজ বিশ্বের বিস্ময়

তানভীর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৩, ৪ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১০:৩৮, ৪ অক্টোবর ২০২০
দৃষ্টিকটু টাওয়ারটি আজ বিশ্বের বিস্ময়

যে টাওয়ারটিকে শুরুতে প্যারিসবাসী ভেবেছিল দৃষ্টিকটু, সেটি বর্তমানে বিশ্বের কাছে বিস্ময় হিসেবে পরিচিত। বলছি, ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অবস্থিত আইফেল টাওয়ারের কথা।

প্যারিসবাসী একসময় ভেবেছিল, লোহার টাওয়ারটি শহরের সৌন্দর্য নষ্ট করবে। বিশাল এই টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনাটিকে প্যারিসের সকল অধিবাসীরা প্রথমে ভালোভাবে নেয়নি। অনেকেই এটিকে শহরের জন্য বেহুদা এবং বিকট, দৃষ্টিকটু, উদ্ভট হবে বলে মনে করেছিলেন। এমনকি প্যারিসের ৩০০ জন গণ্যমান্য ব্যক্তি টাওয়ারটি নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিলের জন্য প্রকাশ্যে বিরোধীতা করেছিলেন।

নির্মাণের পরেও উঁচু এ টাওয়ারটি অনেকেরই চক্ষুশূল হয়েছিল। সে সময় বিভিন্ন সংবাদপত্রে পাঠকদের পাঠানো চিঠিপত্রে দেখা যায়, তারা একে শহরটির অন্যান্য স্থাপনার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করছিলেন। কিন্তু শিল্প ও বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব  এই নিদর্শন দ্রুতই গর্বের বিষয় হয়ে ওঠে। বর্তমানে প্রতি বছর বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পর্যটককে আকৃষ্ট করে থাকে আইফেল টাওয়ার। প্রতি বছর এ টাওয়ার দেখতে প্রায় ৭০ লাখ দর্শনার্থী আসে, যাদের ৭৫ ভাগই আসে বিদেশ থেকে। বিশ্বে অর্থের বিনিময়ে দেখা স্থাপনার শীর্ষে রয়েছে এ টাওয়ার।
জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম- এর প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমান বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্যটন কেন্দ্র ফ্রান্স। আর ফ্রান্সের সর্বোচ্চ জনপ্রিয় স্থাপনা এই আইফেল টাওয়ার। ১৮৮৯ সালে সর্বপ্রথম মেলার উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছিল এই টাওয়ারটি। কথিত আছে, আইফেল টাওয়ার নির্মাণ করতে সর্বমোট ২ কোটি ৫০ লাখ নাট ব্যবহার করা হয়েছিল। মূলত এই নাটগুলো আইফেল টাওয়ারের ১৮,০৩৮টি পৃথক ধাতবখণ্ডকে একত্রে সংযুক্ত করার কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল। আর আইফেল টাওয়ারের এই নির্মাণ কাজে সর্বমোট ১৩২ জন দক্ষ কর্মীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমেই মাত্র ২ বছর ২ মাস ২ দিনে নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছিল এই টাওয়ারটি। যদিও পরবর্তীতে এই টাওয়ারটি পরিমার্জন (আংশিক পরিবর্তন) করা হয়েছে বেশ কয়েকবার। উল্লেখ্য যে, টাওয়ারটির সংস্করণ কাজেই কর্তৃপক্ষকে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, এক কালে টাওয়ারটির নিচের অংশের আংশিক পরিবর্তনের জন্য প্রায় ৩০ মিলিয়ন ইউরো ব্যয় করা হয়েছিল। তাছাড়াও টাওয়ারটির চাকচিক্য ধরে রাখতে প্রতি ৭ বছর পর পর পুনরায় একবার করে রং করা হয় টাওয়ারটিকে। যা খুবই ব্যয়বহুল।

পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় এই স্থাপনাকে ফরাসি ভাষায় ট্যুর আইফেল নামে অভিহিত করা হয়। আর তাই ফ্রান্সের মানুষের কাছে এই টাওয়ারটি ট্যুর আইফেল নামেই ব্যাপক পরিচিত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আইফেল টাওয়ারের বেশ কয়েকটি প্রতিকৃতি নির্মাণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে মোট ৯টিরও বেশি প্রতিকৃতি নির্মাণ করা হয়েছে এই টাওয়ারটির। এগুলোর মধ্যে মেক্সিকো, নেভাদা ও শেনঝেনে স্থাপিত প্রতিকৃতিগুলো সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য। বিশাল আকৃতির সুউচ্চ এই টাওয়ারটিতে সর্বমোট ১২০টি তরঙ্গায়িত এন্টেনার অস্তিত্ব রয়েছে। তাছাড়াও রাতের আঁধারে টাওয়ারটিকে আলোকসজ্জায় সজ্জিত করার জন্য এতে স্থাপন করা হয়েছে ৩৩৬টি প্রজেক্টর, সেই সঙ্গে টাওয়ারটির প্রতি পাশে ৫,০০০টি করে ব্যবহার করা হয়েছে মোট ২০,০০০ লাইট। ফ্রান্সের আইন অনুযায়ী রাতের আঁধারে আলোকসজ্জায় সৌন্দর্যমণ্ডিত অবস্থায় টাওয়ারটির ছবি ধারণ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। লোহার তৈরি এই টাওয়ারটি পর্যটকদের পরিদর্শনের জন্য মূলত তিনটি স্তরে বিভক্ত। টাওয়ারটির একেবারে চূড়ায় আরোহণের জন্য প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তর মিলিয়ে সর্বমোট ১৬৬৫টি সিঁড়ির ধাপ রয়েছে। তবে আপনার কাছে সিঁড়ি কষ্টসাধ্য ব্যাপার হলে বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে লিফট ব্যবহার করতে পারেন। বেশিরভাগ দশনার্থী টাওয়ারটির চূড়ায় উঠার জন্য লিফটকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। টাওয়ারটির একেবারে উপরে উঠার পরই আপনার জন্য উপভোগ করছে এক অবিস্মরণীয় মহূর্ত। কেননা টাওয়ারটির একেবারে চূড়া থেকে বিশ্ব সংস্কৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরটিকে এক নজরে দেখার সেই অনুভূতি সত্যিই অসাধারণ। যা আসলে কোনোভাবেই বলে বোঝানো সম্ভব নয় ।

আইফেল টাওয়ারের নামকরণ করা হয়েছে মূলত গুস্তাভো আইফেল-এর নামানুসারে। গুস্তাভো আইফেল ছিলেন এই টাওয়ারটির নকশা প্রণয়নকারী। তাই তার নামানুসারেই রাখা হয়েছে এই টাওয়ারটির নাম। এখানে আরো একটি কথা না বললেই নয়, গুস্তাভো আইফেল আরো একটি জনপ্রিয় স্থাপনার নকশা প্রণয়নকারী। আর সেই স্থাপনাটি আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে অবস্থিত ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’। যাই হোক, প্রকৃত আইফেল টাওয়ারটির উচ্চতা মূলত ৩০০ মিটার। তবে আইফেল টাওয়ারের ওপর ৪ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট একটি এন্টেনা রয়েছে। আর এই এন্টেনাসহ আইফেল টাওয়ারের মোট উচ্চতা ৩২৪ মিটার কিংবা ১০৬৩ ফুট। যাকে অনেকেই টাওয়ারটির প্রকৃত মোট উচ্চতা হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। এক সময় এই টাওয়ারটি বিশ্বের সর্বোচ্চ স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে যখন ক্রিসলার ভবনটি নির্মাণ করা হয়, তখন আইফেল টাওয়ার সর্বোচ্চ পরিকাঠামোর মর্যাদা হারায়। ক্রিসলার ভবনটি নির্মিত হওয়ার আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ৪১ বছর যাবৎ আইফেল টাওয়ারই ছিল পৃথিবীর একমাত্র সুউচ্চ পরিকাঠামো।  

অবস্থান ও যাতায়াত ব্যবস্থা

ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের ‘সপ্তম অ্যারোঁদিসেমেন্ট’ এর অন্তর্গত চ্যাম্প ডি মার্শ- এ বিস্ময়কর এই স্থাপনাটি অবস্থিত। বিশাল আকৃতির এই টাওয়ারটিতে যাতায়াত ব্যবস্থা ও পরিদর্শন প্রক্রিয়া খুবই সহজ। তবে বলাবাহুল্য যে, চমৎকার এই নগরীতে বিস্ময়কর স্থাপনাটি (আইফেল টাওয়ার) ছাড়াও আরো বেশ কিছু জনপ্রিয় স্থাপনা ও দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যার কারণে প্যারিস নগরীতেই ঘুরতে আসে সবচেয়ে বেশি পর্যটক, আর এর ফলে প্রায়ই ট্রাফিক জ্যাম লেগে থাকে এই শহরটিতে। ফলে আইফেল টাওয়ার পরিদর্শনে যাতায়াতের ক্ষেত্রে কিছুটা বেশি সময় লেগে যেতে পারে। সুতরাং কাঙ্ক্ষিত সময়ের চেয়েও কিছুটা বেশি সময় বিবেচনা করে ট্যুর প্ল্যান তৈরি করাটাই শ্রেয়।

টিকিট সংক্রান্ত তথ্যাবলী   

আইফেল টাওয়ারের টিকিট দুইভাবে সংগ্রহ করা যায়। টাওয়ার পরিদর্শনে গিয়ে সেখান থেকে সরাসরি টিকিট সংগ্রহ করা অথবা অনলাইনের মাধ্যমে টিকিট সংগ্রহ করা। প্রয়োজনীয় টিকিটের কিছু ধার্যমূল্য নিচে উল্লেখ করা হলো। উল্লেখ্য, ৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য টিকিট লাগে না।

সিঁড়ির মাধ্যমে আইফেল টাওয়ারের নিচ তলা থেকে দ্বিতীয় তলায় যাওয়ার ক্ষেত্রে

৪-১১ বছর বয়সী জনপ্রতি ২.৬০ ইউরো

১২-২৪ বছর বয়সী জনপ্রতি ৫.২০ ইউরো

প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য জনপ্রতি ১০.৪০ ইউরো

সিঁড়ির মাধ্যমে আইফেল টাওয়ারের দ্বিতীয় তলায় এবং সেখান থেকে লিফটের মাধ্যমে সর্বোচ্চ তলায় যাওয়ার ক্ষেত্রে

৪-১১ বছর বয়সী জনপ্রতি ৫.০০ ইউরো

১২-২৪ বছর বয়সী জনপ্রতি ৯.৮০ ইউরো

প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য জনপ্রতি ১৯.৭০ ইউরো

লিফটের মাধ্যমে নিচ তলা থেকে দ্বিতীয় তলায় যাওয়ার ক্ষেত্রে

৪-১১ বছর বয়সী জনপ্রতি ৪.১০ ইউরো

১২-২৪ বছর বয়সী জনপ্রতি ৮.৩০ ইউরো

প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য জনপ্রতি ১৬.৬০ ইউরো

লিফটের মাধ্যমে নিচ তলা থেকে সর্বোচ্চ তলায় যাওয়ার ক্ষেত্রে

৪-১১ বছর বয়সী জনপ্রতি ৬.৫০ ইউরো

১২-২৪ বছর বয়সী জনপ্রতি ১৩.০০ ইউরো

প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য জনপ্রতি ২৫.৯০ ইউরো

বি.দ্র.: ভিড় এড়াতে চাইলে আপনি অনলাইনে টিকিট কিনতে পারেন https://www.toureiffel.paris/fr। তবে সিঁড়ির টিকিট স্পট থেকে সংগ্রহ করতে হবে।

খোলা ও বন্ধের সময়সূচি

আসলে আইফেল টাওয়ার কখনো বন্ধ থাকে না। বরং বছরের পুরো সময়ব্যাপীই খোলা থাকে। তবে আইফেল টাওয়ার পরিদর্শনের জন্য কিংবা ভেতরে প্রবেশের জন্য বেশ কিছু নিয়মকানুন ও নির্দিষ্ট সময়সূচি রয়েছে।

* ১৫ জুন থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত পর্যটকদের ভেতরে প্রবেশের নির্ধারিত সময় সকাল ৯টা থেকে মধ্যে রাত পর্যন্ত।

* এছাড়া বছরের অন্যান্য সময় সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত যেকোনো সময় জনসাধারণের জন্য ভেতরে প্রবেশের অনুমতি রয়েছে।

বি.দ্র.: পর্যটন মৌসুমে নির্ধারিত সময় আরো বাড়িয়ে দেওয়া হয়।

আইফেল টাওয়ার পরিদর্শনের সেরা সময়

আইফেল টাওয়ার পরিদর্শনের সেরা সময়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শরৎ ও বসন্তকাল। প্যারিসের সবচেয়ে ব্যস্ততম সময় হচ্ছে ক্রিসমাস ডে উপলক্ষে ছুটির দিনগুলো। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় এই উৎসবে সবচেয়ে বেশি পর্যটকদের আনাগোনা থাকে প্যারিস শহরে। নানান সম্প্রদায়ের মানুষের ভিড়ে পর্যটন মৌসুমগুলোতে এক বৈচিত্র্যময় সাজে সেজে উঠে প্যারিস। নানান জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বৈচিত্র্যময় এই মিলনমেলায় জানার আছে অনেক কিছু, আছে অনেক শেখারও। তাই অন্যান্য সময়ের চেয়ে পর্যটন মৌসুমগুলোতেই প্যারিস ভ্রমণের সুবিধা এক্ষেত্রে একটু বেশি। কেননা এতে অনেক কিছু জানা ও শেখার পাশাপাশি ভ্রমণের শিক্ষণীয় গুরুত্বটাও উপলব্ধি করা যায় বেশ।

লেখক: ট্রাভেলার

https://travelertanvir.blogspot.com

ঢাকা/ফিরোজ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়