ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বাংলা গানের শুকতারা অতুল প্রসাদের ১৫০তম জন্মদিন

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫৮, ২০ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১০:০৮, ২০ অক্টোবর ২০২০
বাংলা গানের শুকতারা অতুল প্রসাদের ১৫০তম জন্মদিন

গানের জন্য অতুলপ্রসাদ নামটি অনেক প্রবীণের মনেই শুকতারার মতো জ্বলজ্বলে।  অমর গানের রচয়িতা অতুল প্রসাদ সেন তার সৃষ্টির জন্যই চিরকাল বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে রইবেন।

‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!/ মাগো তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা!/ কি যাদু বাংলা গানে! গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে/ গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।’ এ গানটিও অতুল প্রসাদের।  যা আজো মানুষের মুখে মুখে ফেরে।  বিশেষ দিবস এলে বুকের মধ্যে গুঞ্জরণ তোলে। 

সঙ্গীতের এই সাধকের ১৫০তম জন্মদিন আজ।  তার জন্ম ১৮৭১ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকায় তারই মাতুলালয়ে।  পৈতৃক বাড়ি ছিল দক্ষিণ বিক্রমপুরে।  বাবার নাম রামপ্রসাদ সেন এবং মায়ের নাম হেমন্ত শশী।

অতুলপ্রসাদ অতি অল্প বয়সেই বাবাকে হারান।  এরপর মাতামহ কালীনারায়ণ গুপ্তের কাছে প্রতিপালিত হন।  ১৮৯০ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি যখন কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, সে সময় তার বিধবা মা হেমন্ত শশী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জ্যাঠামশাই দুর্গামোহন দাশকে বিবাহ করেন।  এর ফলে তিনি মানসিকভাবে অত্যন্ত আঘাত পান।  মায়ের নির্দেশে তার বোনদের মায়ের কাছে রেখে আসেন, কিন্তু নিজে মামা বাড়িতে ফিরে যান।  এরপর তিনি মামাদের অনুরোধে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে (এখন বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন।

১৮৯০ সালে ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত যান।  তার মামারা বিলেত যাবার ব্যবস্থা করেন।  এই যাত্রার পেছনে অলক্ষ্যে সহযোগিতা করেন তার সৎপিতা দুর্গামোহন দাশ।  এ কথা জানতে পেরে তিনি দুর্গামোহন দাশের সঙ্গে দেখা করেন এবং এর ভেতর দিয়ে তার মা এবং সৎপিতার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।

বিলেত যেতে যেতে জাহাজে বসে তিনি লিখেছিলেন ‘উঠ গো ভারতলক্ষ্মী’ গানটি।  লন্ডনে গিয়ে তিনি আইন শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং আইন পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হন।  এ সময় তার বড় মামা কৃষ্ণগোবিন্দ সপরিবারে লন্ডনে যান।  অতুলপ্রসাদ নিয়মিতভাবে লন্ডনের মামাবাড়িতে যাওয়া-আসা শুরু করেন।  এই সূত্রে তার মামাতো বোন হেমকুসুমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা জন্মে।

১৮৯৪ সালে দেশে ফিরে এসে আইন ব্যবসা শুরু করেন।  এ ক্ষেত্রে তাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেন দুর্গামোহন দাশ।  ১৮৯৭ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রস্তাবে ‘খামখেয়ালী সভা’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।  এই সভায় যাওয়া-আসা ছিল অতুলপ্রসাদের।  রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও এই আসরে উপস্থিত থাকতেন বাংলা সংগীতের আরেক কিংবদন্তি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়।  এই আসর হাস্যরসাত্মক গান ছাড়াও রাগসংগীতের মতো উচ্চাঙ্গের গান হতো।

১৮৯৭ সালে দুর্গামোহন দাশ প্রয়াত হলে অতুলপ্রসাদকে সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়।  আর্থিক সুবিধা লাভের আশায় তিনি রংপুরে চলে যান।  এই সময় তার সঙ্গে হেমকুসুমের সম্পর্কের কথা জানাজানি হয়ে যায়।  হিন্দু রীতিতে এই বিবাহ অসিদ্ধ, তাই যথারীতি পারিবারিকভাবে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হয়।  পরে তারা ১৯০০ সালে পুনরায় বিলেত যান এবং স্কটল্যান্ডের রীতি অনুসারে বিয়ে করেন। বিলেতেই আইন ব্যবসা শুরু করেন। 

১৯০১ সালে তাদের জমজ পুত্র সন্তান জন্ম হয়। এই সময় তিনি প্রচণ্ড আর্থিক কষ্টে পড়েন। সংসারের খরচ মেটাতে এক সময় হেমকুসুম গহনা বিক্রি শুরু করেন।  এর ভেতর এক সন্তান সাত মাস বয়সে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যায়।  এই চরম হতাশা এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে এক বন্ধু তাকে উত্তর প্রদেশের লক্ষ্ণৌতে আইন ব্যবসার পরামর্শ দেন।

১৯০২ সালে কলকাতায় ফিরে আসেন।  কলকাতায় আত্মীয়-স্বজনেরা তাকে বর্জন করে।  তিনি লক্ষ্ণৌতে চলে যান।  এখানে নিজেকে প্রথম শ্রেণির আইনজীবী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন।  ক্রমে ক্রমে লক্ষ্ণৌ শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।

১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করার দিনটি জাতীয় শোক দিবস হিসাবে পালন করা হয়।  এই দিনে রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববন্ধনের প্রতীক হিসাবে ‘রাখিবন্ধন’-এর ব্যবস্থা করা হয়।  অতুলপ্রসাদ এই অনুষ্ঠানের জন্য কলকাতায় আসেন এবং ‘রাখিবন্ধন’ অনুষ্ঠানে যোগ দেন।  লক্ষ্ণৌতে ফিরে এসে তিনি স্বদেশি চেতনায় ভারতীয় যুবকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য, ‘মুষ্ঠিভিক্ষা সংগ্রহ’-এর সূচনা করেন। পরে এই সূত্রে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আউধ সেবা সমিতি’।

এই সময় অতুলপ্রসাদের আত্মীয়স্বজনরা, বিশেষ করে তার মা সব ভুলে গিয়ে সম্পর্ক উন্নতির ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এই উদ্দেশ্যে তার মা লক্ষ্ণৌতে আসেন। অতুলপ্রসাদও সব ভুলে গিয়ে সম্পর্ক দৃঢ় করায় আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু তার স্ত্রী হেমকুসুম অতীতের লাঞ্ছনাকে ভুলতে পারেননি। তাই তিনি কোনোভাবেই সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণকে মেনে নিতে পারেননি।  ফলে অনিবার্যভাবে পারিবারিক সংঘাত শুরু হয়।  পরম অশান্তি নিয়ে অতুলপ্রসাদ ১৯১১ সালে তৃতীয় বার ইংল্যান্ডে যান।

১৯১৪ সালে রবীন্দ্রনাথ হিমালয় ভ্রমণের পর রামগড় এলে, তিনি অতুলপ্রসাদকে আমন্ত্রণ জানান। অতুলপ্রসাদ রামগড়ে গিয়ে কিছুদিন কাটান।  পারিবারিক সংঘাতের কারণে স্ত্রী হেমকুসুমের সঙ্গে তার সাময়িক বিচ্ছেদ ঘটে।  এর কিছুদিন পর তিনি লক্ষ্ণৌ ছেড়ে কলকাতা হাইকোর্টে যোগ দেন এবং কলকাতার একটি ফ্ল্যাটে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন শুরু করেন।

১৯১৬ সালে লক্ষ্ণৌবাসীর আমন্ত্রণে লক্ষ্ণৌতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে যান।  ১৯১৭ সালে তিনি পুনরায় লক্ষ্ণৌতে ফিরে আসার উদ্যোগ নেন।  এরপর থেকে তিনি বিভিন্ন সভাসমিতি, সাহিত্য আসর, রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যস্ততার মধ্যে কাটান। ১৯২৩ সালে লক্ষ্ণৌতে রবীন্দ্রনাথ এলে, স্ত্রী হেমকুসুম ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে অতুলপ্রসাদের কাছে আসেন এবং একসঙ্গে কবিকে সম্বর্ধনা দেন। সম্বর্ধনা শেষে রবীন্দ্রনাথ বোম্বে চলে যান।  এরপরই হেমকুসুম ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে অন্যত্র চলে যান।

১৯২৫ সালে লক্ষ্ণৌতে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মিলনে তিনি সভাপতি হন। এই অধিবেশনে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়। অতুলপ্রসাদ এর নামকরণ করেন ‘উত্তরা’।  এই সময় হেমকুসুম দেরাদুনে যান।  সেখানে টাঙ্গা থেকে পড়ে গিয়ে তার ‘পেলভিস বোন’ ভেঙে যায়।  অতুলপ্রসাদ দেরাদুনে গিয়ে তার চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করে লক্ষ্ণৌতে ফিরে আসেন।  এরপর কলকাতা থেকে তার অসুস্থ মাকে লক্ষ্ণৌতে নিয়ে আসেন।  এ বছরই তার মা মৃত্যুবরণ করেন।

১৯২৬ সালে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মিলনের নির্ধারিত সভাপতি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অসুস্থ হয়ে পড়লে অতুলপ্রসাদ সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩৩ সালে এলাহাবাদ লিবারেল পার্টির উত্তর প্রদেশ শাখার অষ্টম অধিবেশনে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৩৪ সালের ১৫ এপ্রিলে পুরী যান।  গান্ধী (মহাত্মা) এই সময় পুরীতে আসেন।  গান্ধীজীর অনুরোধে অতুলপ্রসাদ তাকে গান গেয়ে শোনান। ২৫ আগস্ট তিনি অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন।  ২৬ আগস্ট গভীর রাতে মৃত্যুবরণ করেন।  এভাবেই থেমে যান এক বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্রময় জীবনের অধিকারী অতুল প্রসাদ।

ছোটবেলায় ঢাকা ও ফরিদপুরে বাউল, কীর্তন ও মাঝি-মাল্লাদের ভাটিয়ালি গানের মূর্ছনা অতুলপ্রসাদের হৃদয়ে স্থায়ী আসন লাভ করেছিল।  সে সুরের অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত তার বাউল ও কীর্তন ঢঙের গানগুলোতে বাংলার প্রকৃতিকে খুঁজে পাওয়া যায়। অতুলপ্রসাদ প্রেম, ভক্তি, ভাষাপ্রীতি, দেশপ্রেম প্রভৃতি বিষয়ভিত্তিক বহু গান রচনা করেছেন।

১৯১৬ সালে লক্ষ্ণৌতে সর্বভারতীয় কংগ্রেস অধিবেশনে স্বেচ্ছাসেবকদের অধিনায়ক হিসেবে তিনি যে দেশাত্মবোধক গানটি রচনা করেন, তাতে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের সুর আছে: ‘দেখ মা এবার দুয়ার খুলে/ গলে গলে এল মা/ তোর হিন্দু-মুসলমান দু ছেলে’। ‘মোদের গরব, মোদের আশা/ আ মরি বাংলা ভাষা’ গানটিতে অতুলপ্রসাদের মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ ফুটে উঠেছে।  এ গান বাংলাদেশের  ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিদের মধ্যে অফুরন্ত প্রেরণা জুগিয়েছে।  গানটির আবেদন আজও অম্লান। এভাবে বাণীপ্রধান গীতি রচনা, সুললিত সুর সংযোজন, সুরারোপের মাধ্যমে অতুলপ্রসাদ বাংলা সংগীতভাণ্ডারকে ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ করে গেছেন।

অসম্ভব দানশীল অতুলপ্রসাদ জীবনের উপার্জিত অর্থের অধিকাংশই ব্যয় করেছিলেন জনকল্যাণে। এমন কী তিনি তার বাড়িটিও দান করে গিয়েছিলেন।  মৃত্যুর আগে তিনি তার লেখা সমস্ত গ্রন্থের স্বত্ব বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে দান করে যান।  গানের জন্য চিরকাল বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে রইবেন অতুল প্রসাদ সেন ।

ঢাকা/টিপু

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়