ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ফুলের রাজ্যে তাদের কাঁটার জীবন

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:০৯, ৪ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১২:২৬, ৪ নভেম্বর ২০২০
ফুলের রাজ্যে তাদের কাঁটার জীবন

বিশ্বে চলছে করোনার তাণ্ডব। মরণঘাতী এই ভাইরাসের কারণে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন বিভিন্ন পেশার মানুষ। বাংলাদেশের ‘ফুলের রাজধানী’খ্যাত গদখালীতেও পড়েছে এর প্রভাব। সেখানে ফুলচাষিদের মুখে নেই হাসি। অবিক্রিত কোটি টাকার ফুল খাওয়ানো হয়েছে গবাদি পশু দিয়ে। এর সঙ্গে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে যোগ হয়েছে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান।

এবারই প্রথম বড় কোনো ঝড়ের কবলে পড়ে গোটা যশোর অঞ্চল। বিশেষ করে গদখালীর ফুলের পলি হাউজ বা ফুল চাষের বিশেষ ঘরগুলো প্রায় পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। সেখানকার অটোমেটিক ঝর্ণা ও এসি সিস্টেমও সম্পূর্ণ বিকল হয়ে পড়েছে। আর যেটুকুও অবশিষ্ট আছে সেগুলো মেরামত করতে লাগবে লাখ লাখ টাকা। এদিকে ক্ষেতে ফুল নেই বললেই চলে। দাম মোটামুটি ভালো থাকলেও নতুন করে ফুল চাষ করতে পারছেন না কষকেরা। এ যেন ফুলের রাজ্যে তাদের কাঁটার জীবনে বসবাস। 

যশোর গদখালীর একাধিক কৃষকের সাথে কথা বলে জানা যায়, এবার বছরের শুরুতে ফুলের আবাদ অনেক বেশি থাকলেও বর্তমানে আগের তুলনায় প্রায় অর্ধেকেরও কম জমিতে ফুল গাছ আছে। বাকি ফুল গাছ আম্ফানে নষ্ট হয়ে গেছে। ঘুর্ণিঝড়ের সময়ে ধুলা-বালি কিংবা নষ্ট ফুল গাছের গোড়ার কারণে আবাদ করা যায়নি। এজন্য আম্ফান পরবর্তী সময়ে এই জমিগুলোতে ধান চাষ করেছেন কৃষকদের কেউ কেউ।

কথা বলে জানা যায়, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস ও ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের কারণে গত ৭ মাসে ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীদের শত কোটির বেশি টাকার ক্ষতি হয়েছে। হতাশায় ভেঙে পড়েছেন ফুল চাষের ওপর নির্ভর এলাকার হাজার হাজার মানুষ। লকডাউনের আগে যে পরিমাণ ফুল ছিল তাও বিক্রি করতে না পেরে মাথায় হাত তাদের। একারণে বাগান বাঁচাতে ফুল কেটে গরু-ছাগলকে খাওয়াতে হয়েছে তাদের।

অক্টোবর-নভেম্বর মাসে গদখালী ফুলের সুবাসে মৌ মৌ করলেও এবার সেটি নেই। সরেজমিনে দেখা যায়, গদখালীর যেসব জমিতে আগে ফুল চাষ করা হতো সেগুলোর বেশিরভাগ খালি পড়ে আছে কিংবা শুধু গাছের মরা ডাল দেখা যাচ্ছে। জমিতে ফুল গাছ থাকলেও ফুল নেই। থাকলেও একটি দুটি। তবে নতুন উদ্যেমে ব্যস্ত সময় পার করছেন গদখালীর চাষিরা। বীজতলায় চারা তৈরি কিংবা নতুন করে ফুল গাছ লাগানোর কাজে ব্যস্ত চাষি ও শ্রমিকেরা।

উপজেলা কৃষি অফিস থেকে জানা যায়, যশোর জেলার পশ্চিমের উপজেলা ঝিকরগাছা ও শার্শা থানার ৭৫টি গ্রামের প্রায় সাড়ে ৬ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ করা হয় হরেক রকমের ফুল। ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী ইউনিয়নের পানিসারা, হাড়িয়া, কৃষ্ণচন্দ্রপুর, পটুয়াপাড়া, সৈয়দপাড়া, মাটিকুমড়া, বাইসা, কাউবা, ফুলিয়া আর শার্শার নাভারন, উলাশি, গদখালী ও শ্যামলাগাছি গ্রামে ফুল চাষ বেশি হয়। এসব জমিতে প্রায় শতাধিক রকমের ফুলের চাষ হয়। এর মধ্যে রয়েছে গাঁদা, গোলাপ, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, জারবেরা, রথস্টিক, জিপসি, গ্যালেনডোলা, কসমস, ডেইজ জিপসি, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকাসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুল। আগে গদখালীর যেকোনো দিকে তাকালেই চোখে পড়ত একটার পর একটা ফুলের বাগান। তবে এখন সেই দৃশ্য নেই। হাসি নেই কৃষকের মুখে।

গদখালীর ফুলচাষি ও ফুলব্যবসায়ী বাবর আলী বলেন, ‘আড়াই বিঘা জমিতে গোলাপ ফুলের চাষ করেছিলাম। বাংলা বর্ষবরণ উৎসব সামনে রেখে ফুল উৎপাদনের ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। কয়েক লাখ টাকা গোলাপ বাগানে বিনিয়োগ করা ছিল। ঠিক সেই সময়ে করোনাভাইরাস এলো। ফুল আর বেচতে পারলাম না। ঘরে বসে পহেলা বৈশাখ পালন করলে ফুল কিনবে কে? এরপর আম্ফান ঝড়ের তাণ্ডবে বেশিরভাগ ফুল গাছ উপড়ে ও ডালপালা ভেঙে গেছে। অনেক জায়গায় ফুল গাছ দুমড়ে মুচড়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এখন দোকানপাট খুললেও ক্ষেতে তো আর গোলাপ নেই। যতটুকু আছে তা দিয়ে খরচের টাকার অর্ধেকও উঠবে না। অত্যন্ত খারাপ অবস্থার মধ্যে আছি আমরা ফুলচাষিরা।’

শিশির নার্সারির কাউসার আলী জানালেন, তার ১০ বিঘার ফুল বাগানে আম্ফানের কারণে পলিশেডের অটোমেটিক স্প্রে সিস্টেম ও এসির জন্য প্রায় ২২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এসব ক্ষতি পুষিয়ে আবার নতুন করে আবাদ করা কষ্টসাধ্য। তারপরও দেখা গেলো নার্সারিতে ১৫ জন শ্রমিক কাজ করছে। তার ভাষ্যমতে, শীতকালে পর্যাপ্ত ফুল গাছ ও ফুলের জোগান দিতে পারবেন তিনি।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির (বিএফএস) সভাপতি আব্দুর রহিমের সাথে কথা বলে জানা গেলো এবার ঝিকরগাছা ও শার্শা উপজেলার ছয় হাজার কৃষক সাড়ে ছয় হাজার হেক্টর জমিতে ফুলের আবাদ করেছিলেন। ফুল চাষে আবহাওয়া ভালো থাকলে এবার অন্যান্য বারের তুলনায় রেকর্ড পরিমাণ ফুল উৎপাদনের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু করোনা এবং আম্ফানের কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। এ দু’য়ের কারণে ফুলচাষিদের যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। এই মুহূর্তে সম্ভাবনাময় এই সেক্টরটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারি সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।

তিনি আরো জানান, ঝড়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে জারবেরা ফুলের। প্রতি একর জারবেরা ফুল চাষ করতে ৩৬ লাখ টাকা খরচ হয়। এর জন্য যে পলিশেড বানাতে হয় তা তৈরি করতে প্রচুর টাকা খরচ হয়। কিন্তু আম্ফানের কারণে তা লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। এছাড়া রজনীগন্ধা চাষে একর প্রতি খরচ আড়াই লাখ টাকা, গোলাপ সাড়ে চার লাখ টাকা, গ্লাডিওয়াস চার লাখ টাকা, গাঁদা চাষে দুই লাখ ত্রিশ হাজার টাকার মতো খরচ হয়।

যশোর ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. মাহবুব আলম রনি বলেন, ‘উপজেলার গদখালীতে এবার সাড়ে ছয় হাজার হেক্টর জমি ফুল চাষের আওতায় আনা হয়েছিল। কিন্তু মহামারি করোনা ও ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের তাণ্ডবে প্রায় সব কৃষকই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। নষ্ট হয়ে গেছে ফুলের সব ক্ষেত। শুধু করোনার কারণে ফুল বেচতে না পারায় প্রায় ৩০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে কৃষকদের। আর ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের কারণে ক্ষেতের ফুল ও শেডের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ করোনা এবং আম্পানে মোট ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। এরই মধ্যে ফুল চাষের সঙ্গে জড়িত ৩০০ জন চাষির মাঝে বিনামূল্যে আউসের বীজ বিতরণ করা হয়েছে। যেসব কৃষকের শেড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদেরকে উচ্চ ফলনশীল টমেটোর বীজ দেয়া হয়েছে। সেগুলো এখন মাঠে দৃশ্যমান। এদিকে কৃষক নেতারা দাবি করেছেন, যাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকার যে প্রণোদনা ঘোষণা দিয়েছে তা ব্যাংকের মাধ্যমে কৃষকদের হাতে পৌছে দেওয়া হয়।’

১৯৮৪ সালের দিকে এখানে ফুলের চাষ শুরু হলেও গত দুই দশকে ফুল চাষে স্থানীয় কৃষকদের আগ্রহ বেড়েছে কয়েকগুণ। বর্তমানে এলাকার প্রায় ছয় হাজার কৃষক ফুলচাষে জড়িত। স্বাভাবিক সময়ে শুধুমাত্র ঝিকড়গাছা উপজেলায় প্রায় ৫০ লাখ টাকার ফুলের বেচাকেনা হয়।

ঢাকা/মারুফ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়