ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

জলে ভাসা জীবন

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৫, ২২ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১০:৩৬, ২২ নভেম্বর ২০২০
জলে ভাসা জীবন

গ্রামের নাম দৃষ্টিনন্দন। কোন প্রেক্ষাপটে গ্রামটির এমন নাম রাখা হয়েছিল বোঝা কঠিন। কেননা, নামের সঙ্গে এলাকার দৃশ্যপটের মিল নেই। গ্রামের ভেতর দিয়ে সরু মাটির রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে বহুদূর। রাস্তার দু’পাশে সারি সারি ঝুপড়ি ঘর। রাস্তাটুকু ছাড়া সর্বত্র চোখে পড়ে থইথই জলরাশি। কোথায় কৃষি জমি, কোথায় খেলার মাঠ, কোথায় পুকুর-ডোবা; কোনো কিছুই ঠাহর করা যায় না। কোনো বাড়ির উঠোন, সবজি বাগান কিংবা খেলার মাঠের ওপর দিয়ে চলে নৌকো। ছ’মাস ধরে এই নৌকাই এই এলাকার যাতায়াতের প্রধান বাহন। জলে ডুবে আছে ঘরবাড়ি, ফসলি জমি-মাঠ, চিংড়ির খামার। গ্রামের গাছগুলো যেন কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে আছে। লবণ পানিতে পুড়ে যাচ্ছে গাছের আগা। অন্তত আগামী পঞ্চাশ বছরে গ্রামের এই সবুজ আর ফিরবে কিনা কে জানে!

ঘূর্ণিঝড় আম্ফান বিধ্বস্ত এলাকার বর্তমান ছবি এটি। চলতি বছরের ২০ মে দিবাগত রাত বারোটা বাজার আগেই শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আঘাত করে বাংলাদেশের পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায়। বহুদিন ধরে পড়ে থাকা সংস্কারবিহিন নড়বড়ে বেড়িবাঁধ প্রবল জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কায় মুহূর্তেই ধ্বসে যায়। প্লাবিত হয় গ্রামের পর গ্রাম। যে মানুষগুলো ঘূর্ণিঝড়ের ঝাপটা থেকে বাঁচতে সাইক্লোন শেলটারে কিংবা এলাকার উঁচু দালানে আশ্রয় নিয়েছিল; তাদের অনেকেই ভোরে বাড়িতে এসে আর কিছু পাননি। সব ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল প্রবল জলোচ্ছ্বাস!

রাস্তার পাশে আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বসতি

ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতের ছ’মাস পড়ে কেমন আছেন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়েছিলাম সাতক্ষীরার আশাশুনি, শ্যামনগরের গাবুরা, কয়রার গোবরাসহ কয়েকটি এলাকায়। না, ভালো নেই তারা। প্রতিদিন দু’বার বহু পরিবার জোয়ারে ভাসছে। রাতের জোয়ার আসে আরও ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে। রাস্তাঘাট নেই। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার বাঁশের সাঁকো। স্থানীয় বাসিন্দারা নিজেদের উদ্যোগে সাঁকো দিয়েছেন। কোথাও আবার সাঁকোও নেই, নৌকাই মানুষের চলাচলের মাধ্যম।

দৃষ্টিনন্দন গ্রামটি সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন। খেয়াঘাট থেকে অনেক পথ পায়ে হেঁটে এই গ্রামের দিকে যেতে চোখে পড়ে একই দৃশ্য। যে দিকে চোখ যায় শুধু জলরাশি। রাস্তার ওপরে অসংখ্য ঘর। অথচ এই এলাকার কিছু অংশে চিংড়ির চাষ হতো। কিন্তু সেসব ছয় মাস ধরে পানির তলায় ডুবে আছে। একজন বললেন, ‘সাহায্যের দশ-পাঁচ কেজি চাল লাগবে না। আমরা রিলিফ চাই না। আমাগো বাঁধটা বান্দি দাও। আমরা কাজকর্ম করে খাবো।’

অধিকাংশ বাড়ি-ঘর এভাবেই ছ’মাস ধরে পানিতে ডুবে আছে

দৃষ্টিনন্দনের ফারুক চৌধুরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনের আশাপাশে অনেকগুলো ঘর। তথ্য সংগ্রহে দাঁড়াতেই ভিড় জমে গেল। অনেক নারী-পুরুষ এগিয়ে এলেন। সবাই নাম লেখাতে ব্যস্ত। আশাপাশে ভিড় করেছে অনেক শিশু। প্রতিটি মানুষ যেন গত ছয় মাসে এক একটি বড় বড় গল্পের সাক্ষী হয়ে আছে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের রাত থেকে এ পর্যন্ত তারা যেন প্রত্যেকেই বিরাট যুদ্ধ করে টিকে আছে। জীবন বাঁচিয়ে রাখার এ এক কঠিন লড়াই। জীবিকার সংস্থান ছিল, আয় রোজগারের পথ ছিল; ভালোই চলছিল জীবন। থাকার ঘর ছিল। সামান্য কৃষি জমিও ছিল কারো কারো। কিন্তু আম্ফান এদের সব কেড়ে নিয়েছে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে বকস গাজী (৬০) বললেন, ‘ঘর ভেসে গেছে। সরকারি স্কুল ভবনে থাকি। কাজকর্ম নাই। এভাবে ক’দিন চলতে পারবো জানি না।’ আব্দুল বারী ঢালীর স্ত্রী রোকেয়া খাতুন (৭৫), আবদুল মান্নান (৪৫), নূর মোহাম্মদ ঢালী (৪৬), নূরুন নাহার (৩৫), আবদুল বারী (৮০) এবং আরও অনেকের সঙ্গে আলাপ হলো দৃষ্টিনন্দনে। জলেভাসা মানুষগুলো বললেন, আবাসন আর খাবার সংগ্রহই এখন তাদের প্রধান সমস্যা। আম্ফানের আগে অনেকেই বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ করতেন। কিন্তু এখন সবই বাজার থেকে চড়া দামে কিনতে হয়। রান্নার জ্বালানির সমস্যা তো আছেই। আবাসনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা মোকাবিলা করছেন তারা। নিচু এলাকা থেকে অনেকেই ঘর সরিয়ে এনেছেন রাস্তার ধারে। সেখানেও যখন জোয়ারের পানি আসছে তখন মানুষগুলোকে ঘর ছেড়ে রাস্তায় উঠে আসতে হচ্ছে। মানুষগুলোর হাতে কোনো কাজও নেই। বাসিন্দাদের অভিযোগ, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের পর এ এলাকায় ছিটেফোঁটা সহযোগিতা এসেছে। এ পর্যন্ত পাওয়া সাহায্যে এক মাসের বেশি খাবার কেউ পায়নি। সামনের দিনে কী হবে জানেন না তারা।

দূরে কুড়িকাহুনিয়া লঞ্চঘাটের দিকে তর্জনী তুলে নূর মোহাম্মদ ঢালী বলছিলেন, ওখানে বেড়িবাঁধ ছিল খুবই নাজুক। সেদিন রাতের জোয়ার এসেছিল রাত বারোটার আগেই। শক্তিশালী জোয়ারের চাপে বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। ঘূর্ণিঝড়ের রাতে আমরা ঘর ছেড়ে এই স্কুলে উঠেছি। আর এখান থেকে নিজের ঘরে ফিরে যেতে পারিনি। কবে যেতে পারবো জানি না। কথা বলতে বলতে ফারুক চৌধুরী স্কুল ভবনের ভেতরে তার ঘরে নিয়ে গেলেন। স্কুলটি যেন এখন কয়েকটি পরিবারের একটি বাড়ি। যেখানে স্কুলের ঘণ্টা বাজার কথা, সেখানে ঝুলছে কাপড়-চোপড়, কাঁথা-বালিশ। স্কুলের বারান্দা আর সিঁড়ির অবশিষ্ট স্থানগুলোতে রাখা হয়েছে ডুবে যাওয়া ঘরের সব মালামাল।

নূর মোহাম্মদ ঢালী নিজের বাড়ি ছেড়ে এখন স্কুলভবনে বাস করেন

স্কুলের সবশেষ কক্ষে নূর মোহাম্মদ ঢালীর ঘর। এক কক্ষে বসবাস করছে দুটো পরিবার। স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের বসার বেঞ্চগুলো তাদের খাট বা চৌকি। অনেকগুলো বেঞ্চ একত্রিত করে বিছানা পাতা। স্কুলের এক কোনে রান্নার স্থান রাখা হয়েছে। এক সময়ের বেশ সহায় সম্পত্তির মালিক নূর মোহাম্মদ আজ পরিবারসহ পথে বসেছেন। পাঁচ জনের সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। জীবিকার একমাত্র অবলম্বন নৌকা ও জাল। কিন্তু নৌকা ও জাল সুন্দরবনে শীতকালীন মাছ ধরার জন্য।

নুরুন নাহার বেগমও এই ছয় মাস বসেই ছিলেন। কোনো আয়-রোজগার ছিল না। এই শীত মৌসুমে তারও কাজের সুযোগ হবে বলে আশা করেন। ইটভাটায় কাজে যাবেন। নারীরা যে ইটের ভাটায় কাজ করতে যান; তা প্রথম শুনলাম নুরুন নাহারের কাছে। তিনি এর আগেও বেশ কয়েকবছর গিয়েছেন। সেখানে শ্রমিকদের রান্নার কাজ করেন তিনি। মৌসুম শেষে যা পান, তা দিয়ে মোটামুটি কয়েক মাস চলে।

স্কুল ভবন যেন এখন বাড়ি, দৃষ্টিনন্দন ফারুক চৌধুরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

দৃষ্টিনন্দন গ্রামের এই রাস্তা ধরে যাওয়া যায় আরও অনেক দূরে। প্রতাপনগরের চাকলা কিংবা পথ ঘুরে অন্য ইউনিয়ন শ্যামনগরের পদ্মপুকুর কিংবা গাবুর পর্যন্ত। কিন্তু সবখানেই ধ্বংসের চিহ্ন। ছ’মাস আগে প্রবল শক্তি নিয়ে ধাক্কা দিয়ে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান যেন এই এলাকার চিত্রটাই বদলে দিয়ে গেছে। অনেকে বলেন, ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলার প্রলয় এতটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বেড়িবাঁধ না থাকায় মানুষের এই ভোগান্তি বেড়েছে। না, আর সামনে এগোনোর সুযোগ নেই। একদিকে রাস্তায় কাদাপানি, অন্যদিকে ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যে। কিন্তু সন্ধ্যাবেলায় রাস্তার ধারে বিলকিস বেগমের মুখ ভার করে বসে থাকার কারণ কী? দু’হাত কপালে তুলে নির্বাক বসেছিলেন তিনি। এখানকার মানুষের কাছে এক একটি দিন, এক একটি রাত অনেক লম্বা।

ঢাকা/তারা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়