ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ধ্বংসস্তূপে টিকে থাকার লড়াই

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২৩, ২৩ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৬:৩৯, ২৩ নভেম্বর ২০২০
ধ্বংসস্তূপে টিকে থাকার লড়াই

স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বন্যতলা গ্রামের রিংবাঁধ

এ যেন মানুষের অন্যজীবন। যে জীবনের কথা কেউ কখনো ভাবেননি। ধ্বংসস্তূপের ভেতরেই টিকে থাকার লড়াই করছেন হাজারো মানুষ। সাজানো-গোছানো ঘরের অর্ধেক ডুবে আছে পানির নিচে। ২৪ ঘণ্টায় দু’বার জোয়ারে পানিতে ডুবে যায় বাড়ি-ঘর। এ সময় রান্না থেকে শুরু করে ঘরের অন্যান্য সব কাজ বন্ধ থাকে। মানুষজন কোথাও বের হতে পারেন না। যেন জীবনটাই থেমে যায় কয়েক ঘণ্টার জন্য।

শ্যামনগরের খোলপেটুয়া নদীর তীর ধরে এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া বেড়িবাঁধের অনেক স্থান ভেঙে গেছে। একই অবস্থা আশাশুনির প্রতাপনগরের হরিশখালীর। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের রাতে এসব এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে হু হু করে পানি প্রবেশ করে লোকালয়ে প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে। ভাসিয়ে নেয় বাড়িঘর, গাছপালা, মাঠের ফসল, চিংড়িঘেড়- সবকিছু। খোলপেটুয়া নদীর তীর ধরে বন্যতলা গ্রামের মানুষের দুরবস্থার শেষ নেই। বিপর্যস্ত, বিপন্ন এক জনপদ। বন্যতলা খেয়াঘাট থেকে হরিশখালীর পথ ধরে যতদূর চোখ যায় একই চিত্র। কেউ ভাঙা বাঁধের পাশে, কেউবা বাঁধের উপরে ঘর বানিয়েছেন। এক জায়গায় অনেকের গাদাগাদি বসবাস।

বন্যতলা গ্রামে বেড়িবাঁধের বাইরে ঝুপড়িঘর

কথা বলছিলেন আবদুস সাত্তার সরদারের স্ত্রী আকলিমা বেগম। বেড়িবাঁধের ভেতর অর্ধেক পনিতে ডুবে থাকা ঘর দেখিয়ে বললেন, ‘ওখানে আমরা থাকতাম। ঘরের সামনে ছোট্ট উঠান ছিল। বেড়িবাঁধের ভেতরে নিরাপদ জীবন ছিল। কিন্তু আম্ফানে সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। অনেক কষ্টে আছি।’ আবদুস সাত্তার হাওলাদার আগে নদীতে মাছ ধরতেন। বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় এখন জালে মাছ ধরা পড়ে না। তিনি এখন ট্রলারে কাজ করেন। আকলিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘এভাবে কী জীবন চলে?’

বেড়িবাঁধের উপর দিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর দাঁড়াতে হলো। যাবার রাস্তা নেই! চারপাশেই ধ্বংসস্তূপ। নলকূপ এখনও পানিতে ডুবে আছে। টয়লেটের বিপন্ন অবস্থা। মাঠঘাট ডুবে আছে লবণ জলে। স্থানীয় প্রবীন ব্যক্তিরা জানালেন, ষাটের দশকে নির্মাণ করা হয়েছে এ বেড়িবাঁধ। তারপর বেড়িবাঁধে এক টুকরো মাটি পড়েনি। হরিশখালী এবং বন্যতলায় বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর বিকল্প বাঁধ দিয়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা। নিজেদের প্রয়োজনে পানি আটকানো থেকে শুরু করে বাঁশের সাঁকো নির্মাণ পর্যন্ত অনেক কাজই করেছেন তারা। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের পর বেশ কয়েকদিন হাজার হাজার মানুষ নিজেদের জীবন রক্ষায় স্বেচ্ছাশ্রমে বেড়িবাঁধ মেরামতের কাজ করেছেন। কিন্তু তাদের পক্ষে সব স্থানের বাঁধ মেরামত করা সম্ভব হয়নি। ফলে আটকানো যায়নি জোয়ারের পানি।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বন্যতলা খেয়াঘাট থেকে আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্র তালতলা বাজারে এখন দু’টি পথ তৈরি হয়েছে। একটি নৌপথ, আরেকটি সাঁকোপথ। বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করায় ভেঙে গেছে রাস্তাঘাট। ভাঙা রাস্তার ওপরেই দেওয়া হয়েছে বাঁশের সাঁকো। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের আগে বন্যতলা খেয়াঘাট থেকে সড়কপথেই তালতলা বাজার পর্যন্ত যাওয়া যেত। এখন আর সে সুযোগ নেই। তালতলা বাজারের শেষ মাথায় বন্যতলীর পথে সাঁকোর কাছে অপেক্ষমান কয়েকটি ভ্যান। চালকেরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। এদের একজন লিয়াকত আলী (৪৫)। ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন বছরের পর বছর। কিন্তু এখন জীবন যেন থেমে গেছে! যেখানে ৩০০-৪০০ টাকা দৈনিক উপার্জন ছিল, সেখানে ৫০ থেকে ১০০ টাকা উপার্জন করাই কঠিন। ঘরে সাত সাতটি মুখের খাবার তাকেই সংগ্রহ করতে হয়। একদিকে আয়-রোজগার নেই, অন্যদিকে থাকার ঘরের সমস্যা। ঘূর্ণিঝড়ের পরে কিছুদিন মাদ্রাসার সাইক্লোন শেলটারে ছিলেন। এরপর ভাসমান অবস্থায় প্রায় ২ মাস ছিলেন বিভিন্ন স্থানে। এখন আবার এলাকায় ফিরে এসেছেন।  

প্রতাপনগরের তালতলা বাজার থেকে আঁকাবাঁকা ইটের রাস্তা চলে গেছে কুড়িকাহুনিয়া লঞ্চঘাটের দিকে। রাস্তার দু’ধারে বসতি। পানিতে ডুবে আছে সব। রাস্তা থেকে প্রত্যেক বাড়ির সঙ্গে বাঁশের সাঁকো। গাছপালা লবণ পানিতে পুড়ে গেছে। নারিকেল-সুপারি, আম-জাম গাছ থেকে শুরু করে সব গাছের সবুজ পাতা গুটিয়ে গেছে। লবণের বিষে এই গাছগুলো অনেক আগেই মরে গেছে। খোলপেটুয়া কিংবা কপোতাক্ষ নদ উপচে যে পানি গত ছয় মাস ধরে এই এলাকাকে প্লাবিত করছে তা তীব্র লবণাক্ত। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এক একটি বাড়ির গাছগুলো বড় হতে অন্তত ২০ থেকে ৩০ বছর লেগেছে। অনেক গাছই মরে গেছে। গাছগুলো কেটে ফেলার পর এলাকাটি সবুজশূন্য বিরাণ জনপদে পরিণত হবে বলে এলাকাবাসীর ধারণা। ইটের রাস্তা ধরে হাঁটি কুড়িকাহুনিয়া লঞ্চঘাটের দিকে। রাস্তার আশপাশ থেকে অনেক বাড়ি রাস্তার উপরে উঠে এসেছে। কোথাও গবাদিপশুর স্থায়ী বসবাসের স্থান হয়েছে এই রাস্তা।      

  বন্যতলা গ্রামের রিংবাঁধের পাশে বিপন্ন বসতি

ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ঘর ভেসে যাওয়ার পরে কুড়িকাহুনিয়া লঞ্চঘাটের টার্মিনালের বিশ্রামকক্ষে আশ্রয় নেওয়া সুফিয়া বেগমের পরিবার ফিরে গেছে তাদের ভিটায়। শ্রীপুর গ্রামে বাবার রেখে যাওয়া চার শতাংশ জমির ওপর ঘর বানিয়ে থাকতের দিনমজুর আবুল কালাম ঢালী। আম্ফানের আঘাতের পর ঢালী পরিবারের সবাইকে নিয়ে উঠেছিলেন লঞ্চঘাটের টার্মিনালে। পানি কমে যাওয়ার পরে তারা বাড়িতে ফিরে এসেছেন। ধারদেনা করে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে ঘর মেরামত করেছেন। কিন্তু জোয়ারের সময় ঘরে থাকা যায় না। মাচা পাতা ঘরের ভেতরে যে খাট আছে, তার ওপরে পানি ওঠে জোয়ারের সময়। সে কথা তুলে সুফিয়া বেগম বলছিলেন, খাটের উপরে বসে অপেক্ষায় থাকি কখন ভাটার টান শুরু হবে। কপোতাক্ষ নদীর তীরে টিকে থাকা বেড়িবাঁধ থেকে সুফিয়া বেগমের ঘরে যেতে বাঁশের সাঁকো পার হতে হয়। সেখান থেকে রান্নাঘর কিংবা অন্য কোনো বাড়ির দিকে যেতেও আছে এই সাঁকো। সুফিয়া বেগম লঞ্চঘাটের টার্মিনাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন বটে কিন্তু সেই স্থান ফাঁকা নেই; পূরণ হয়েই আছে। সেখানে আছে আরও কয়েকটি পরিবার। তাদের বাড়িতে যাওয়ার মতো অবস্থা নেই।

শ্রীপুর গ্রামের আবুল কালাম ঢালীর ঝুঁকিপূর্ণ ঘর

সুফিয়া বেগমের মতোই ঘরে ফিরেছেন নৌকায় বসবাসকারী ওমর আলী সরদারের স্ত্রী আমিরুন নেছা। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের দুই সপ্তাহ পরে যখন এই এলাকায় আসি, তখন আম্বিয়া খাতুনকে দেখেছি তার ছেলের নৌকায় বসবাস করতে। ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের রাতে জীবন বাঁচাতে গিয়েছিলেন আশ্রয়কেন্দ্রে। পরদিন ভোরে এসে দেখেন; ঘরের কোনো কিছুই আর নেই। চাল-ডাল থেকে শুরু করে ঘরের সব মালামাল জলোচ্ছ্বাসের পানিতে ভেসে গেছে। ঘরে বসবাসের আর কোনো সুযোগ ছিল না। ফলে উঠেছিলেন ছেলের নৌকায়। কিন্তু ছেলের নৌকা শীতকালীন মৎস্য শিকারে সুন্দরবনের দুবলার চরে চলে গেছে। ফলে সেখানে আর থাকা সম্ভব হয়নি। তাই পানিতে ডোবা ঘরেই ঠাঁই নিতে হয়েছে।

ঢাকা/তারা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়