ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘এক জীবনে মানুষ কতবার জীবন গড়তে পারে’

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০৪, ২৭ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ০৭:৪০, ২৮ নভেম্বর ২০২০
‘এক জীবনে মানুষ কতবার জীবন গড়তে পারে’

প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের তাড়া করে ফিরছে। জীবন বাঁচাতে, দু’মুঠো খাবারের সন্ধানে তারা ছুটছেন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। বদলে যাচ্ছে পেশা, জীবিকার ধরন, জীবনযাপনের ধরন। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া। শিশুরা বই রেখে বাধ্য হয়ে যোগ দিচ্ছে কাজে। এই ছবিটি বাংলাদেশের পশ্চিম উপকূলে এখন দৃশ্যমান। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের ছয় মাস পরে সেখানে এখনও দগদগে ক্ষত স্পষ্ট। সাতক্ষীরার শ্যামগনর, আশাশুনি এবং খুলনার কয়রা উপজেলার অনেক স্থানের মানুষ এখনও নতুন করে বাঁচার দিশা খুঁজে পাননি। বেড়িবাঁধের উপরে, অন্যের জমিতে, স্কুল ভবনে আর কতদিন থাকবেন? শহরে কাজের সন্ধানে ছুটছেন অনেকে।

শ্যামনগরের নওয়াবেঁকী বাজারের নিকটে খুলনাগামী মালবাহী কার্গোতে ঘরের আসবাবপত্র তুলছিলেন ফারুক হোসেন। দৃশ্যটি আম্ফান বিপন্ন এলাকার খুব চেনা। এই জনপদের পথে পথে এমন আরও অনেক দৃশ্য চোখে পড়ে। একজন আক্ষেপ করে বলছিলেন, বেড়িবাঁধ আমাদের ভিখারি করে দিলো। শক্ত বাঁধ থাকলে আমাদের ভিটে ছেড়ে এভাবে চলে যেতে হতো না। ফারুক হোসেনের বয়স কতইবা; ৫৬ বছর। বাবার ভিটেতেই থাকতেন। যে মাটিতে তিনি বেড়ে উঠেছেন, কাজকর্ম করে জীবন কাটিয়েছেন, সেই মাটি ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। এক সময় কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও এক পর্যায়ে নদীর ভাঙনে হারিয়ে যায় কৃষিজমি। ফলে ফারুক হোসেন এবং তার অন্যান্য ভাইয়েরা কৃষি পেশা বাদ দিয়ে অন্য কাজে জীবিকার পথ খুঁজে বের করেন। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের আগ পর্যন্ত এলাকায় মোটরবাইক চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। অনেক কষ্টে বাবার ভিটেয় ছিলেন প্রায় ছয় মাস। কিন্তু অবশেষে সেই ভিটে ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে তাকে।

খুলনা যাচ্ছেন তিনি। সেখানে ২৭০০ টাকায় এক কক্ষের একটি ঘর ভাড়া নিয়েছেন। জীবিকার অবলম্বন হিসেবে জানালেন ভ্যান চালাবেন। অর্থাৎ কৃষক ফারুক হবেন এখন ভ্যানচালক। জীবনের গল্প তুলে ধরে ফারুক বলছিলেন, তারা চার ভাই একই বাড়িতে বাবা-মাসহ বাস করে আসছিলেন। কিন্তু নদীর ভাঙন তাদের গ্রাস করতে থাকে। প্রতিটি দুর্যোগেই ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। হয়তো ঘর গেছে, না হয় জমি। এক সময়ে বাবার ৪০ বিঘা জমি থাকলেও সব কেড়ে নিয়েছে প্রাকৃতিক বিপদ। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর, ২০০৯ সালে আইলা, ২০১৯ সালে ফণী, একই বছরের বুলবুল এবং চলতি বছরের ঘূর্ণিঝড় এই এলাকায় প্রচণ্ডভাবে আঘাত করে। শুধু ঘূর্ণিঝড় নয়, কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর ভাঙন, জোয়ারের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, পানি ও মাটিতে লবাণাক্ততা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে গোটা পশ্চিমাঞ্চল মানুষের বসবাসের উপযোগিতা হারাচ্ছে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিমত। নূর ইসলাম ঢালী কিংবা রোকেয়া বেগমের মতো বয়সী ব্যক্তিরা বলছিলেন, ১৯৮৮ সালের ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের অরও অনেক ক্ষতি করে গেছে। তাদের আক্ষেপ, এক জীবনে মানুষ কতবার তার জীবন গড়তে পারে!

কার্গোতে মালামাল উঠানোর সময় সঙ্গে ছিলেন ফারুক হোসেনের স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন এবং পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ে রেশমী আকতার। এ অবস্থায় সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে ফারুক হোসেনকে যে জন্মভিটা ছেড়ে চলে যেতে হবে; তা কখনোই তারা ভাবেননি। হাতের কাজ থামিয়ে ফরিদা ইয়াসমিন বলছিলেন, বাড়িতে আমাদের সবকিছু ছিল। সবজি হতো, জমিতে ধান হতো। আমরা বেশ ভালোই ছিলাম। কিন্তু সব ছেড়ে এভাবে চলে যেতে হবে; ভাবতেও পারিনি।

নওয়াবেঁকী বাজারের গফফারের খেয়া পারাপারের আগেই বৃষ্টিভেজা দুপুরে দেখা হলো আরেকজন স্থানান্তরিত মানুষের সঙ্গে। নাম হাবিবুর রহমান ঢালী। বয়স ৫০ ছাড়িয়েছে। তার বাড়িও ছিল আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের চাকলা গ্রামে। তেমন কোনো সম্পত্তি না থাকলেও নিজের ভিটে ছিল। সেখানেই কাজকর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। ঘূর্ণিঝড় আম্ফান তাকে পথে বসিয়ে দিয়ে গেছে। বাড়িতে আর থাকার সুযোগ নেই। বেশ কয়েকদিন আগে পানিতে ডুবে থাকা গ্রামের বাড়িটি ছেড়ে চূড়ান্তভাবে চলে এসেছেন শ্যামনগর উপজেলার আটুলিয়া ইউনিয়নের বীরালক্ষ্মী গ্রামের সরকারি আবাসনে।

খোলপেটুয়া নদী পেরিয়ে আশাশুনির প্রতাপনগর গিয়ে এমন আরও অনেক মানুষের সন্ধান মেলে, যারা পরিজনসহ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। কুড়িকাহুনিয়া গ্রামের আজিজুল সানা (৪০) ও আবদুল গফফার (৩৫) এলাকা ছেড়ে যশোর শহরে চলে গেছেন। প্রতাপনগর গ্রামের মৃত মোহাম্মদ আলীর ছেলে মিজানুর রহমান সরদার (৪০) তার স্ত্রী নাজমা খাতুন এবং ৩ মেয়ে নিয়ে চলে গেছেন সাতক্ষীরা শহরে। একই এলাকার লিয়াকত আলীর ছেলে শরিফুল ইসলাম (২৫) পরিজনসহ চলে গেছেন ঢাকা। একই এলাকার শওকত সরদারের ছেলে জাহিদুল ইসলাম (৩০) তার স্ত্রী আশুরা বেগম ও ২ ছেলে নিয়ে সাতক্ষীরা চলে গেছেন। একই এলাকার মোহাম্মদ আলীর ছেলে শহিদুল ইসলাম (৫০) পরিজনসহ যশোর চলে গেছেন। শ্রীপুর গ্রামের শাহিদা খাতুন (৩০) সাতক্ষীরা ও আশরাফুল ঢালী (২৮) খুলনা চলে গেছেন। এই তালিকা আরো দীর্ঘ।

২০০৯ সালের আইলার পরে এই এলাকা থেকে বহু মানুষ এলাকা ছেড়েছিলেন। এদের মধ্যে কিছুসংখ্যক এলাকায় ফিরতে পারলেও অনেকেই ফিরতে পারেনি। স্থানান্তরিত মানুষেরা বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বসবাস করে। অধিকাংশই স্থান নেয় শহরের বস্তিতে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশে স্থানচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে বলে দাবি করেছে জেনেভাভিত্তিক ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার- আইডিএমসি। ২০২০ সালের অর্থ বার্ষিক প্রতিবেদনে তারা বলেছে, ছয় মাসে বাংলাদেশে ২৫ লক্ষাধিক মানুষ স্থানচ্যুত হয়েছে। গত বছর ২০১৯ সালে সারাবছরে এই সংখ্যা ছিল ৪০ লাখ। এ বছর স্থানচ্যুতির সংখ্যা অস্বাভাবিক বৃদ্ধির নেপথ্যে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান, দীর্ঘ মেয়াদি বন্যাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগকে দায়ী করা হয়েছে।

সরেজমিনে কুড়িকাহুনিয়া ও শ্রীপুর গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, এই গ্রাম দুটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে এলাকায় এক বিপন্ন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কোথায় বাড়িঘর, ফসলি মাঠ, রাস্তাঘাট কিংবা পুকুর-ডোবা ছিল, তা বোঝার কোন উপায় নেই। বাঁধের উপরে দাঁড়িয়ে এলাকার লোকজন যে স্থানটিকে শ্রীপুর গ্রাম বলছে, সেখানে গ্রাম বলতে যা বোঝায় তা নেই। সবকিছুই যেন ওলটপালট! বেড়িবাঁধের একপাশে কপোতাক্ষ নদ, আরেক পাশে পানিতে ডুবে থাকা বিস্তীর্ণ ফসলি মাঠ। বাঁধের বাসিন্দা মরিয়ম বেগম বলছিলেন, শ্রীপুর গ্রামটি অনেক বড় ছিল। এখন তো গ্রামই নেই। এ গ্রামে ধান হতো, প্রচুর গাছপালা ছিল। অনেক মানুষ ছিল। অনেকেই এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এখানে থাকার তো কোনো সুযোগ নেই। কাজকর্ম নেই। থাকার জায়গা নেই। মানুষ থাকবে কীভাবে?

ঢাকা/তারা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়