ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বাবার খুনিদের শাস্তি আজও হলো না: ডা. নুজহাত চৌধুরী

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:০০, ১৬ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ০৭:৫২, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০
বাবার খুনিদের শাস্তি আজও হলো না: ডা. নুজহাত চৌধুরী

ডা. এ এফ এম আবদুল আলীম চৌধুরী।  ১৯২৮ সালের ১৬ এপ্রিল কিশোরগঞ্জ জেলার খয়েরপুর গ্রামে জন্ম। কিশোরগঞ্জ হাইস্কুল থেকে ১৯৪৪ সালে মেট্রিক এবং কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে আইএসসি পাস করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৫ সালে এমবিবিএস এবং ১৯৬১ সালে লন্ডন থেকে ডিও ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি বাম রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং ৫২-র ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে চক্ষু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী ছিলেন, উদয়ন বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ। বর্তমানে নিজের প্রতিষ্ঠিত উদ্দীপন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। আলীম চৌধুরীর দুই মেয়ে। ফারজানা চৌধুরী নীপা এবং নুজহাত চৌধুরী শম্পা।

যে ডিসেম্বরে বাবাকে হারিয়েছেন, সেই ডিসেম্বরের কোনো একদিন ডা. নুজহাতের সঙ্গে কথা হয় তাঁর বাবাসহ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে শহীদ হওয়া দেশের সূর্য সন্তানদের নিয়ে। সেদিনের ছোট্ট শম্পা আজ দ দু’সন্তানের জননী। নিজে চিকিৎসা পেশায় আছেন। স্বামীও দেশের নাম করা চিকিৎসক, ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)।

ডা. নুজহাত বলেন, ‘তখন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়। পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থা বেসামাল।  সেসময় মরিয়া হয়ে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কারফিউ দিয়ে রাখা হতো। বড় বোন নীপার বয়স ছিল পাঁচের কাছাকাছি। আমার তখনও তিন হয়নি। আমাদের বাসা ছিল ২৯/১ নম্বর পল্টন। পাকিস্তান সরকারের দেওয়া কারফিউ শেষ হলে শুরু হতো বাবার কাজ।  বাবা বিভিন্ন ফার্মেসি আর ওষুধ কোম্পানি থেকে ওষুধ সংগ্রহ করতেন। তারপর গাড়ির বনেট ভর্তি করে সেসব ওষুধ মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ঘাঁটিতে পৌঁছে দিতেন। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য যে গোপন হাসপাতালটি ছিল, সেখানে গিয়েও অন্যদের সঙ্গে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিতেন। নিজের এবং আমাদের পরিবারের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই কাজগুলি করতেন বাবা। তাদের সেবা পেয়ে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা সুস্থ হয়ে উঠতেন এবং পুনরায় যুদ্ধক্ষেত্রে চলে যেতেন।’

বাবা সম্পর্কে এসব তথ্য দেওয়ার সময় আলীম চৌধুরীর ছোট মেয়ের চোখে-মুখে বাবার জন্য ভালোবাসা উপচে পড়ে। বাবার সাথে কাটানো খুব বেশি স্মৃতি তার মনে নেই। থাকার কথাও না। তার বাবা যখন শহীদ হন, তখন তিনি তিন বছরেরও কম বয়সি শিশু! কথা বলতে বলতে হঠাৎই তার গলার স্বর পাল্টে যায়। বেশ দৃঢ় গলায় বলতে শুরু করেন ডা. নুজহাত চৌধুরী শম্পা। তার কণ্ঠে ঘৃণা ঝরে। ক্ষাণিকটা অভিমানের ছোঁয়াও পাই। আমি তখন কেবলি সন্মোহিত শ্রোতা। নির্বাক হয়ে শুনছি। তিনি বলে চলেছেন, ‘জানেন পাকিস্তানিদের দোসর, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর কয়েকজন আমাদের পল্টনের বাসা থেকে ১৫ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে চারটার দিকে বাবাকে তুলে নিয়ে যায়। তিনদিন পর ১৮ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে বাবাসহ আরো কয়েকজনের ক্ষত-বিক্ষত লাশের সন্ধান পায় আমাদের পরিবারের লোকজন। বাবার বুকটা ওই অমানুষরা অনেকগুলি বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা করে ফেলে। বাবার সারা শরীরে ছিল নির্যাতনের চিহ্ন। কপালের বাঁ দিকে আর তলপেটে বেয়নেটের গভীর ক্ষত। আর এসবের প্রধান জল্লাদ ছিল, আশরাফুজ্জামান। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত চিকিৎসা করাই ছিল বাবার অপরাধ। অমানুষ আর জানোয়ারের দল বাবার চোখ দুটি উপড়ে ফেলে...!’

আর বলতে পারেন না ডা. নুজহাত। চুপ হয়ে যান। মাটির দিকে তার দৃষ্টি। সময় পেরিয়ে যায়। দেয়াল ঘড়ির টিক্ টিক্ শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। তার সামনে মাথা নত করে বসে থাকি আমি।  তার চোখের দিকে তাকানোর সাহস হয় না। কতক্ষণ কাটে জানি না! একসময় নিজেকে সামলে আবারো মুখ খোলেন তিনি। সরাসরি আমার চোখে তাকান। আলীম কন্যা নুজহাতের স্নিগ্ধ আর শান্ত দু’চোখে তখন ক্রোধের আগুন!

কাঁপা গলায় বলতে শুর করেন তিনি- ‘বাবাসহ বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল মাওলানা মান্নান। অপারেশন ইনচার্জ ছিল চৌধুরী মইনুদ্দীন। আর প্রধান জল্লাদ আশরাফুজ্জামান। এই আশরাফুজ্জামান ছিল তৎকালীন জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় কমিটিরি সদস্য। বুদ্ধিজীবীদের ধরে যে গাড়িতে করে রায়ের বাজারের শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমিতে নিয়ে যেত, সেই গাড়ির ড্রাইভার মফিজুদ্দীন ধরা পড়ার পর, তার জবানবন্দিতে আশরাফুজ্জামানের পরিচয় জানা যায়।’

‘পরবর্তী সময়ে আশরাফুজ্জামানের ৩৫০ নাখালপাড়ার বাড়ি থেকে মুক্তিযোদ্ধারা একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি উদ্ধার করেন। সেই ডায়েরির দুই পৃষ্ঠাজুড়ে ২০ জন বুদ্ধিজীবীর নাম পাওয়া যায়, যাদের মধ্যে ৮ জনকে  হত্যা করা হয়। এঁরা হলেন- মুনীর চৌধুরী, ড. আবুল খায়ের, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, রশিদুল হাসান, ড. ফয়জুল মহী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ডা. গোলাম মুর্তজা। এই ৮ জনের সবাইকে নিজের হাতে গুলি করে আশরাফুজ্জামান হত্যা করেছে বলে জবানবন্দী দেয় ড্রাইভার মফিজুদ্দিন।’

একটু বিরতি দিয়ে আবারো বলতে শুরু করেন তিনি। ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড অপারেশনের ইনচার্জ চৌধুরী মইনুদ্দীন আর প্রধান জল্লাদ আশরাফুজ্জামান দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়।  চৌধুরী মইনুদ্দীন বর্তমানে লন্ডন আর আশরাফুজ্জামান নিউ ইয়র্কে বিশাল মুসলিম নেতা, ইসলামী চিন্তাবিদ হিসাবে দিন কাটাচ্ছে। যুক্তরাজ্য ও আমেরিকা সরকার যুদ্ধাপরাধী এই দুইজনকে বেশ নিরাপদেই রেখেছে! স্বাধীনতার ৫০ বছর হয়ে গেল। অথচ অনেক চেষ্টা করেও আজ পর্যন্ত তাদের ফিরিয়ে এনে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো গেলো না! বাবার খুনীদের শাস্তি আজও হলো না। '

শেষের দিকে এসে আক্ষেপ আর ক্ষোভ ঝরে পড়ে তার কণ্ঠে। কেবল বাবার কথা বলেই ক্ষান্ত হননি শহীদ ডাক্তার বাবার, ডাক্তারকন্যা নুজহাত। ৭১ সালে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পরিকল্পিতভাবে দেশের যেসব শ্রেষ্ঠ সন্তানদের খুঁজে খুঁজে নৃশংসভাবে খুন করা হয়, তাদেরকেও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন তিনি। বিশাল সেই তালিকা। যার মধ্যে রয়েছেন, ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী এবং শিল্পী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও প্রকৌশলী ১৬ জনসহ মোট ১ হাজার ১১১ জন।

একসময় আমাদের কথোপকথন শেষ হয়! আসলেই কি শেষ হয়? তারপরও সময় গড়িয়ে যায়। আলাপনের ইতি টানতে হয়। ডা. নুজহাত আমাকে এগিয়ে দেন দরজা অবধি। বিদায় নিয়ে আমি দরজার বাইরে পা রাখি। এসময় শেষবারের মতো অত্যন্ত ঠাণ্ডা স্বরে, ক্ষোভের সঙ্গে ডা. নুজহাত বাতাসে তার শেষ প্রশ্ন আর আক্ষেপের কথা ভাসিয়ে দেন- ‘ভেবে অবাক হই, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বিজয়ের মাসে এসে ৭১ এর জানোয়ারদের দোসররা স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার মতো সাহস দেখায় কী করে!’ 


 

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়