ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

চলতি পথে সাত বীরশ্রেষ্ঠ’র সঙ্গে দেখা

শিহাবুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:০০, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৭:২৩, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০
চলতি পথে সাত বীরশ্রেষ্ঠ’র সঙ্গে দেখা

দুই দিক থেকে সাঁইসাঁই করে ছুটে চলছে বিভিন্ন যানবাহন। একদিকে রাজধানীর এয়ারপোর্ট, অন্যদিকে বনানী। মাঝে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও বিলাসবহুল রেডিসন হোটেল। কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ড থেকে বনানীর দিকে একটু এগিয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকলে দেখা যাবে নানান ধরনের ফুল, নারকেল গাছের সারি ও সৌন্দর্যবর্ধক গাছ। এর ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বেঞ্চ। চাইলে যে কেউ বসে দু’দণ্ড জিরিয়ে নিতে পারেন। তবে আরও একটু ভালোভাবে  লক্ষ্য করলে চমকে উঠতে হয়! একেই হয়তো বলে পথে কুড়িয়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা।

সেই ফুল, লতাপাতার মধ্যেই গোল সাদা সিরামিক্সের কাঠামোর উপর খোদাই করে আঁকা মুক্তিযুদ্ধের সাত বীরশ্রেষ্ঠ’র ছবি। এ যেন ফুল হয়ে ফুটে আছে সাতটি মুখ। শুধু তাই নয়, পাশে লেখা রয়েছে তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়। যদিও প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে জাগরুক দেশের সূর্যসন্তানদের কথা। তারপরও হঠাৎ পথের পাশে এ ধরনের আয়োজন পথচারীকে আবেগাপ্লুত করে। শ্রদ্ধায় নত হয় মস্তক। মনে পড়ে যায় একাত্তরের অগ্নঝরা দিনগুলোর কথা। তরুণ পথচারী হয়তো থমকে দাঁড়ান। মনে পড়ে তার পূর্ব পুরুষের গৌরবময় যুদ্ধজয়ের কথা।

৭১ সালের ২৬ মার্চ। নিরীহ, নিরস্ত্র, ঘুমন্ত বাঙালির উপর পাকিস্তানি সেনারা নির্মমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। চারিদিকে আগুন, হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ। এর আগেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে জেগে উঠেছিল বীর বাঙালি। শুরু হয় স্বাধীনতার সংগ্রাম। ৩০ লাখ জীবন, দুই লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে আসে স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধে দুঃসাহসী ভূমিকা রাখার জন্য সাতজনকে দেওয়া হয় সর্বোচ্চ সামরিক পদক ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধি। সেই সাত জন বীর শহীদের স্মৃতি অম্লান করে রাখতেই এই প্রয়াস।

রেহনুমা আকতার, পেশায় নার্স। এই রাস্তা ধরে হেঁটে কুর্মিটোলা হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। এমন সময় কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এখান দিয়ে যখন যাই, তখন এক অন্যরকম অনুভূতি হয়। মনে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা শহীদদের। তাদের জন্য আমার গর্ব হয় এজন্য যে, তারা আমাদের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন বলেই আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ’।

ফুটপাত ধরে হাসপাতালের দিক থেকে হাঁটা শুর করলে প্রথমেই দেখা যাবে বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ হামিদুর রহমানের খোদাই করা মুখ। এরপর বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন, বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ, বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ ও বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান। খোদাই করা মুখাবয়বের নিচে প্রত্যেকের নাম লেখা। তার নিচে যে পতাকার জন্য তাঁরা আরেক পাশে নাম, জন্ম-মৃত্যু সাল, বাবা-মায়ের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয়।

বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ হামিদুর রহমান। সিরামিক্সের কাঠামোতে লেখা রয়েছে, তিনি ১৯৫৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি যশোর জেলার (বর্তমানে ঝিনাইদহ জেলা) মহেশপুর উপজেলার খর্দ্দ খালিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্বাস আলী মন্ডল এবং মাতা মোসাম্মাৎ কায়েসুন্নেসা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরশ্রেষ্ঠ উপধিতে ভূষিত করে। মাত্র ১৮ বছর বয়সে শহীদ হওয়া হামিদুর রহমান, বীরশ্রেষ্ঠ পদকপ্রাপ্ত সাত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ।

এরপর রয়েছেন বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন। তিনি ১৯৩৪ সালে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি উপজেলার বাঘপাঁচড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আজহার পাটোয়ারী, মাতা জোলেখা খাতুন। তিনি বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। ২ নং সেক্টরে মেজর শফিউল্লাহ’র নেতৃত্বে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং স্থল যুদ্ধের বিভিন্ন অপারেশনে যোগ দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা।

বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার রহিমগঞ্জ গ্রামে ১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মুক্তিবাহিনীর ৭ নং সেক্টরের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। মহানন্দা নদীর তীরে শত্রুর প্রতিরক্ষা ভাঙার প্রচেষ্টাকালে তিনি শহীদ হন। তার সম্মানে ঢাকা সেনানিবাসের প্রধান ফটকের নাম জাহাঙ্গীর গেট করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য তাঁকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ ১৯৪৩ সালে ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার সালামতপুর (বর্তমানে রউফ নগর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মুন্সি মেহেদি হাসান ও মাতা মুকিদুন্নেসা। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের ল্যান্স নায়ক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। যুদ্ধের সময় তিনি নিয়মিত পদাতিক সৈন্য হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁকে রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলায় একটি টিলার ওপর সমাহিত করা হয়েছে।

বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল ১৯৪৭ সালে ভোলা জেলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হাবিবুর রহমান সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার। মোস্তফা কামাল ছিলেন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক। কর্ম তৎপরতার জন্য যুদ্ধের সময় তাকে ল্যান্স নায়েকের দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়। যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য তাকে বীরশ্রেষ্ঠ উপধিতে ভূষিত করে।

বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ ১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি নড়াইল জেলার মহিষখোলা গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মোহাম্মদ আমানত শেখ ও মাতা জেন্নাতুন্নেসা। ১৯৫৯ সালের ১৪ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস বা ইপিআর-এ যোগদান করেন। কর্মজীবনে তিনি ল্যান্স নায়েক পদে পদোন্নতি পান। ১৯৭১ সালে যশোর অঞ্চল নিয়ে গঠিত ৮ নং সেক্টরে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য তাকে বীরশ্রেষ্ঠ উপধিতে ভূষিত করে।

বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান। তিনি ১৯৪১ সালে পুরান ঢাকার ১০৯ আগা সাদেক রোডের পৈতৃক বাড়ি ‘মোবারক লজ’-এ জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মৌলভী আবদুস সামাদ ও মা সৈয়দা মোবারকুন্নেসা খাতুন। কর্মজীবনে ১৯৬৭ সালে তিনি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ যে সাতজন বীরকে সর্বোচ্চ সম্মান বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করা হয় তাদের অন্যতম তিনি। 

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়