ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘একাত্তরের ক্ষুদিরাম’ কুষ্টিয়ার প্রথম শহীদ

ইমাম মেহেদী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪২, ১৯ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৩:৫৮, ১৯ ডিসেম্বর ২০২০
‘একাত্তরের ক্ষুদিরাম’ কুষ্টিয়ার প্রথম শহীদ

একাত্তরে বৃহত্তর কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রথম শহীদ রনি রহমান। পুরো নাম দেওয়ান মিজানুর রহমান রনি হলেও কুষ্টিয়ার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তিনি ‘একাত্তরের ক্ষুদিরাম’ নামে পরিচিত। ১৯৪৯ সালের ১২ নভেম্বর রংপুর জেলা শহরের পালপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতা দেওয়ান মোস্তাফিজুর রহমান ছিলেন রংপুর জিলা স্কুলের শিক্ষক। মাতা রহিমা খাতুন গৃহিণী। বাবা মায়ের দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন রনি।
একাত্তর সালে ২২ বছরের টগবগে তরুণ রনি রংপুরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ছিলেন পরিচিত মুখ। জড়িত ছিলেন ‘শিখা’ সংসদের সাথে। ১৯৬৮ সালে রংপুর শহরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘শতাব্দীর আহ্বান’ নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন। ষাটের দশকের শেষের দিকে এই সংগঠন রংপুরের অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠনে পরিণত হয়। যা মূলত স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন ও সামাজিক আন্দোলনে রূপ লাভ করে।
১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন ও সত্তরের নির্বাচনের সময় রনি গড়ে তুলেছিলেন ‘সম্মিলিত ছাত্র সমাজ, রংপুর’। এই ছাত্র সংগঠনের ব্যানারেই সত্তরের নির্বাচনে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। বন্যার কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে যায়। এসময় তিনি বন্ধুদের সাথে নিয়ে টানা ছয়দিন বরিশালের ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, গলাচিপা এলাকায় বন্যাদূর্গত মানুষের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন। সেসব দিনের দুর্দশার কথা তিনি তার দিনলিপিতে উল্লেখ করে গেছেন। 

রংপুর সরকারি কলেজের বিএ ক্লাসের ছাত্র থাকাকালীন রনি তার সহপাঠী রুনু, জয়নাল ও পোকাসহ আরও কয়েক বন্ধুকে নিয়ে ১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে রংপুর প্রেসক্লাবে (বর্তমান পায়রা চত্বর) স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে সবাইকে হতভম্ব করে দেন। এই খবর পাকিস্তানি শাসকদের কানে গেলে সরকার রনির নামে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র এনে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। ফলে রনির পক্ষে আর রংপুরে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যান তিনি।

রংপুর ত্যাগ করে রনি গোপনে কুষ্টিয়ায় বোনের বাসায় আশ্রয় নেন। সেখানেও তিনি স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে যশোর সেনানিবাস থেকে মেজর শোয়েবের নেতৃত্বে ২৭ বালুচ রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্য কুষ্টিয়া প্রবেশ করে কুষ্টিয়া জিলা স্কুল, ওয়ারলেস গেট ও পুলিশ লাইন্সে অবস্থান করে। ২৫ শে মার্চ রাতেই ঢাকাসহ সারাদেশে গণহত্যা চালায় হানাদার বাহিনী। ২৬ মার্চ থেকে কুষ্টিয়া শহরে কার্ফ্যু জারি করে। স্বাধীনতাকামী অন্যান্য মানুষের ন্যায় এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি রনি। রাতের অন্ধকারে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের বিজ্ঞান গবেষণাগারের তালা ভেঙে বিস্ফোরক নিয়ে আসেন রনিসহ কয়েকজন। সহযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে পেট্রোল ও বিস্ফোরক দিয়ে বোমা তৈরি করেন।

২৭ মার্চ সকাল ১০টার দিকে সহযোদ্ধা আব্দুল জলিল, শামসুল হাদী, আসম আখতারুজ্জামান মাসুম, মতিউর রহমান মতি ও অন্যান্য সহযোদ্ধাকে নিয়ে রনি বর্তমান সিভিল সার্জন অফিস সংলগ্ন ‘নিজামত উল্লাহ সংসদ’ ক্লাবের কাছে যান। নিজামত উল্লাহ সংসদের ছাদে উঠে অপেক্ষা করতে থাকেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জন্য।

বেলা দশটার দিকে পাক হানাদার বাহিনীর গাড়ি এগিয়ে আসতে থাকে। এসময় বোমা নিক্ষেপে প্রস্তুত রনি রহমানকে দেখেই গুলি করে পাকিস্তানি সেনারা। রনিও প্রস্তুতু ছিলেন। বোমা নিক্ষেপের আগ মুহূর্তে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনা স্থলেই শহীদ হন রনি। ঐ দিন এলাকাবাসী জানলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কুষ্টিয়ার প্রথম শহীদ রনির নাম। পরে অবশ্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও গুরুত্বের সাথে এই খবর প্রচারিত হয়েছিল।

জীবদ্দশায় রনির লেখা কবিতা, ছবি, গান নিয়ে বৃদ্ধ বয়সে ভগ্নিপতি ভাষাসৈনিক নজমউদ্দিন আক্ষেপ করে জানিয়েছিলেন, আমাদের চাওয়া পাওয়ার কিছুই নেই। যে রনি দেশের জন্য জীবন দিলো, স্বাধীনতার এত বছর পরও শহীদের স্বীকৃতি পেল না সে- এটাই দুঃখ। সহযোদ্ধা মতিয়ার রহমান মতি সাক্ষাতকালে জানিয়েছিলেন, পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে আমরা শুধু লাঠি নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করতাম। রনিই আমাদের পেট্রল বোমা বানাতে শিখিয়েছিল। পরে অনেক জায়গায় বোমা দিয়ে পাকবাহিনীকে আমরা প্রতিহত করেছিলাম। আজ রনি নেই। তাকে মূল্যায়ন করা হয়নি।

সেই সময়ের সহযোদ্ধা কুষ্টিয়া স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও একাত্তরে বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এডভোকেট আবদুল জলিল জানান, রনি খুবই হাসিখুশি ছেলে ছিল। পাতলা শরীর। বাম রাজনীতি করতো। বোমা তৈরি কতে পারতো। অসাধারণ মেধাবী এবং সমাজ সচেতন একটা মানুষ ছিল। রনির বাড়ি ছিল রংপুর। ওখানে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য ওর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে রনি পালিয়ে কুষ্টিয়ায় বোনের বাসায় চলে আসে। ভাষা সৈনিক নজম উদ্দিন ছিলেন রনির দুলাভাই। 

মুক্তিযুদ্ধের এত বছরেও রংপুর বা কুষ্টিয়াতে শহীদ রনী রহমানের স্মৃতি রক্ষার্থে কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আশির দশকে রংপুরে যখন অনেক সড়কের নামকরণ করা হয় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামানুসারে তখন গোমস্তাপাড়াস্থ রংপুর কমিউনিটি সেন্টারের ঠিক সামনে পালপাড়াসংলগ্ন একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছিলো শহীদ রনি রহমানের নামে। এখন আর সেই নামফলক নেই। সাধারণ মানুষও ভুলতে বসেছে এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে। বর্তমান সময়ের ক’জনই বা জানেন একাত্তরে প্রতিরোধ যুদ্ধে বৃহত্তর কুষ্টিয়ার প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রংপুরের রনি রহমানের নাম।

রনির সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা আসম আখতারুজ্জামান মাসুম সাক্ষাৎকালে জানান, রনি রহমান আমার বাড়ির পেছন দিক থেকে পাড়ার ভিতর দিয়ে এসে বাড়ির ভিতর ঢুকলো। তারপর বলল, আমি একটা বোমা বানিয়েছি। পেট্রোল বোমা। এটা আর্মির গাড়িতে মারতে হবে। ওখানে আমরা ছাত্রলীগের আরো কয়েকজন ছিলাম। বললাম, চলো যাই। আর্মিরা টহল দিচ্ছিল। আমরা তখন ছাত্র। বুকে খুব সাহস। এতকিছু ভাবার সময়ও নেই। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেওয়ার পর পুরো জাতি তখন ঐক্যবদ্ধ। আমরা নিজামত উল্লাহ সংসদ নামে পাড়ার একটা ক্লাব চালাতাম। আমরা ভাবলাম সেই ভবনের ছাদে উঠে অ্যাকশন করবো। রনি আগে, আমি তার পরে। আমরা প্রায় সাত আটজন। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠবো। একেবারে দরজার কাছে ছাদে ওঠার যে জায়গাটা, রনি এক পা সেখানে দিয়েছে হঠাৎ একটা গুলির শব্দ হলো। রনি পড়ে গেল। আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলাম। কারণ আমাদের হাতে তো কোনো অস্ত্র নেই।

কুষ্টিয়া পৌর কবরস্থানে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামমাত্র নামফলক নিয়েই ৫০ বছর ঘুমিয়ে আছেন রংপুরের সাংস্কৃতিক কর্মী ও প্রতিরোধ যুদ্ধে কুষ্টিয়ার প্রথম শহীদ রনি রহমান। দুঃখের বিষয় মুক্তিযুদ্ধের এতবছরেও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি আজও ঠাঁই পাননি সরকারি তালিকায়। রনির বড় ভাই দেওয়ান মাসুদুর রহমান জানু আজও ছোট ভাইয়ের স্মৃতি নিয়ে ছুটে বেড়ান বিভিন্ন অফিস আদালত ও মানুষের দ্বারে। মৃত্যুর আগে দেশপ্রেমীক ছোট ভাই রনির মূল্যায়ন দেখে যেতে চান তিনি।

লেখক: সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়