ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ধ্বংসের পথে হরিপুর জমিদার বাড়ি

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:১৫, ২৮ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ২০:০২, ২৮ ডিসেম্বর ২০২০
ধ্বংসের পথে হরিপুর জমিদার বাড়ি

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলা। গ্রামের নাম হরিপুর। গ্রামের কোল ঘেঁষে বয়ে চলে তিতাস। এখন শীতকাল, তাই মরা নদী। বর্ষায় নদীতে ভরা যৌবন। নদী পাড়ের জীবন-জীবিকা নিয়ে ঋত্বিক ঘটকের ছবি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ কিংবদন্তী হয়ে আছে। উপন্যাসটি লিখেছেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। সেই তিতাসের পূর্বপাড়ে, কোল ঘেঁষে এক জমিদার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ এখনও দাঁড়িয়ে আছে আপন অস্তিত্ব জানান দিতে। গ্রামের নাম হরিপুর বলে এটিকে সবাই হরিপুর জমিদার বাড়ি নামে চেনেন।বর্তমানে অযত্ন- অবহেলা আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জমিদার বাড়িটি।

বাড়ির পশ্চিমে ভাঙাচুরা আর শ্যাওলা পড়া বিশাল ঘাট। ঘাটের শেষ সিঁড়িটা গিয়ে মিশেছে তিতাসের কোলে। একসময় এই সিঁড়ির কোলে এসে থামতো জমিদারের বজরা। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলেই চোখে পড়ে, কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জমিদার বাড়ি। এটিকে কেউ বলে রাজবাড়ি, কেউ বড়বাড়ি আবার কেউ বলে জমিদার বাড়ি। তবে বর্তমানে এটি জমিদার বাড়ি নামেই বেশি পরিচিত।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ১৮৮০ সালে ব্রিটিশ আমলে জমিদার গৌরী প্রসাদ রায় চৌধুরী ও কৃষ্ণ প্রসাদ রায় চৌধুরী এই বাড়ি নিমার্ণ করেন। বাংলা ১৩৪৩ সালের ১২ চৈত্র এক দোল পূর্ণিমায় কৃষ্ণ প্রসাদ রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর পর্যায়ক্রমে এর উত্তরাধিকারী হন হরিপদ রায় চৌধুরী ও শান্তি রায় চৌধুরী। তাদের কাছ থেকে পরে বাড়ির মালিকানা ও জমিদারি চলে যায় উপেন্দ্র রায় চৌধুরী ও হরেন্দ্র রায় চৌধুরীর কাছে। তারা জমিদারি চালান ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত। তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার অধীনে নাসিরনগরের লোকজন ছাড়াও সুনামগঞ্জ, ছাতক, দোয়ারাবাজার, আজমিরিগঞ্জ এলাকার লোকজনও তাদের খাজনা প্রদান করতো। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে তারা বাড়ি ফেলে কলকাতা চলে যান। কথিত আছে, জমিদাররা বাড়িটি ফেলে যাওয়ার সময় পুরোহিতদের রেখে যান। এখন জরাজীর্ণ সেই জমিদার বাড়িতে পুরোহিতদের বংশধররাই বাস করছেন বলে জানা যায়।

নাসিরনগর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে এই জমিদার বাড়ির অবস্থান। নাসিরনগর থেকে মাধবপুর যাওয়ার পথে হরিপুর গ্রামের রাস্তার পশ্চিম পাশে  নান্দনিক স্থাপত্য শৈলিতে নির্মিত বাড়িটি। তিতাস নদীর পূর্ব পাড়ে দুই গম্বুজের তিনতলা সুবিশাল বাড়ি। বাড়ির পেছনে নাসিরনগর-মাধবপুর সড়ক। দক্ষিণে তিতাসের কোল ঘেঁষে বিশাল ফাঁকা মাঠ। উত্তরেও তাই। পশ্চিমে এঁকেবেঁকে চলা তিতাস নদী। বাড়ির বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, কত বড় বাড়ির ভেতরটা! বিশাল বারান্দা পেরিয়ে মূল বাড়ি। বাড়ির অবয়বটি আর আগের মতো নেই। দেয়ালের অধিকাংশ পলেস্তারা খসে পড়ছে। সেখানে জমেছে শেওলার আবরণ। দৃষ্টি নন্দন কারুকাজের খুব অল্পকিছু অংশই বিলীন হতে বাকি আছে। সব ক’টি কক্ষেই পুরানো আমলের সেই দরজা নেই। বর্তমানে যারা বসবাস করছেন, তারা সাধারণ মানের দরজা লাগিয়ে বসবাস করছেন।

বর্তমানে সব মিলিয়ে ৩০টি পরিবার রয়েছে এখানে। পরিবারগুলোর বসবাস ১০ বছর থেকে শুরু করে ৭০ বছর পর্যন্ত। বাড়ির ভেতরটা অনেকটা গোছানো পরিবেশ। গ্রামের বয়স্ক লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিতাসের পূর্বপ্রান্তে এত বড় বাড়ি জেলার আর কোথাও নেই। ৪৮০ শতাংশ জমির উপর নির্মিত তিনতলা এই জমিদার বাড়ির ভেতরে ৬০টি কক্ষ, রঙ মহল, দরবার হল, ধানের গোলা, গোয়ালঘর, রান্না ঘর, নাচ ঘর, মল পুকুর, খেলার মাঠ, মন্দির ও সীমানা প্রাচীর রয়েছে। দোতলায় জমিদারদের পাশা খেলার অংকিত বোর্ডটি এবং বিনোদনের বাইজি নাচের জলসা ঘরটিও এখনো আছে। বিশাল আয়তনের এই জমিদার বাড়ির পুরো ভবনের কোথাও কোনো রডের গাঁথুনি নেই। পুরোটাই লাল ইট আর সুরকির গাঁথুনি দিয়ে তৈরি। ভবনের দুইপাশে দুটি সুউচ্চ গম্বুজ। দোতলায় ওঠার ৬ দিকে ৬টি সিড়িঁ রয়েছে। আর তিন তলায় ওঠার দুই দিকে ২টি সিঁড়ি। বাড়ির পশ্চিম-উত্তর কোণে ৬টি বেড রুম, পুকুরের পূব আর পশ্চিম পাড়ে ৪টি করে বেড রুম রয়েছে। পশ্চিম দিকে তিতাস নদীতে নেমে যাওয়া পাকা ঘাটলার। এই ঘাটলার উত্তর দিকে কৃষ্ণ প্রসাদ রায় চৌধুরী এবং দক্ষিণ দিকে গৌরী প্রসাদ রায় চৌধুরীর সমাধি মঠ রয়েছে। সেই সময় বাড়ির নদীর ঘাট থেকে ঐতিহাসিক নৌকা বাইচ হতো। এখনও বর্ষা মৌসুমে স্থানীয় জনসাধারণ সেই উৎসব পালন করে।  তখন চৈত্র সংক্রান্তীতে মেলা বসতো এবং তিতাস নদীতে পূন্য স্নান হতো।

এই জমিদার বাড়িতে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র ও নাটকের শুটিং হয়েছে বলে জানা গেছে। যার মধ্যে পরিচালক নারায়ণ ঘোষ মিতার 'মধু মালতী', 'হুমায়ূন আহমেদ-এর 'ঘেটুপুত্র কমলা', শাকুর মজিদের 'নাইওরী' উল্লেখযোগ্য।

প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পর্যটক আসেন বাড়িটি দেখতে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে তিতাস যখন পানিতে টইটুম্বুর থাকে, তখন বাড়িটির সৌন্দর্য অনেকাংশে বেড়ে যায়। শুরু থেকে বাড়িটিতে সংস্কারের ছোঁয়া লাগেনি। যার কারণে ক্রমশ বাড়িটি তার সৌন্দর্য হারাচ্ছে। জানা গেছে, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই বাড়িটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছে। যদিও সরেজমিন ঘুরে এসে বাস্তবে তার কোনো চিহ্ন চোখে পড়েনি। জরুরি ভিত্তিতে এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি সংস্কার করা না গেলে একদিন সব ইতিহাস ও ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে এই হরিপুর জমিদার বাড়ির।

ঢাকা/তারা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়