ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

রোজা-ঈদ উপলক্ষে ৩৫ দিন বন্ধ, তবুও কর্মচারীরা পান বেতন-বোনাস

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৩১, ৫ এপ্রিল ২০২২   আপডেট: ১৭:৩৪, ৫ এপ্রিল ২০২২
রোজা-ঈদ উপলক্ষে ৩৫ দিন বন্ধ, তবুও কর্মচারীরা পান বেতন-বোনাস

‘নামের বড়াই ক‌রো না‌কো, নাম দি‌য়ে কী হয়, না‌মের মা‌ঝে পা‌বে না‌কো, সবার প‌রিচয়...।’ কালজয়ী এই গা‌নের গী‌তিকার ও সুরকার প্রয়াত সত্য সাহা।

আস‌লেই তাই। নামের মাঝে কিন্তু সব‌কিছুর পরিচয় মে‌লে না। বরং কা‌জের মা‌ঝেই এটা মে‌লে। সেটা মানুষ বা প্রতিষ্ঠান- যা-ই হোক না কে‌নো; এরকম কথাই যুগ যুগ ধ‌রে ব‌লে গে‌ছেন সমা‌জের জ্ঞানী-গুণীরা।

তাই কো‌নো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠা‌নের নাম শু‌নে বা দে‌খে হুট ক‌রে বিভ্রান্ত হ‌বেন না। এই যেমন ধরুন, বনশ্রী এলাকার এক‌টি দোকান। যার নাম ‘পিঠা মেলা কাবার অ্যান্ড বি‌রিয়া‌নি হাউজ’। বনশ্রী ই ব্ল‌কের প্রধান সড়‌কে ফরাজী হাসপাতাল লা‌গোয়া অবস্থান এই প্রতিষ্ঠানের।

‌‘পিঠা মেলা’ নাম হ‌লেও এখা‌নে কিন্তু পাওয়া যায় না কো‌নো রক‌মের পিঠা-পু‌লি। ত‌বে এই রেস্টু‌রে‌ন্টের বিখ্যাত ভর্তা-ভাজি খাওয়ার জন্য দূর-দূরান্ত থে‌কে ভোজনর‌সিকরা এখা‌নে ছু‌টে আসেন। কেবল ভর্তা ভা‌জি নয়; এখা‌নে সকাল, দুপুর, বিকেল, রা‌তের হ‌রেক কি‌সি‌মের খাবার পাওয়া যায়। এখানের খাবা‌রের মান, দাম এবং রেস্তোরাঁর মা‌লিক থে‌কে কর্মচারী- সবার আচরণের কার‌ণেই অনেকে এখানকার নিয়‌মিত খ‌দ্দের।

বনশ্রী‌র সি ব্ল‌কে এক‌টি জাতীয় দৈ‌নিকের অফিস। সেখানকার ক‌য়েক জ‌নের মু‌খেও শোনা গেলো এই রেস্টুরে‌ন্টের খাবারের মান, দাম ও এখানকার সবার আচর‌ণের প্রশংসা। আর সে কার‌ণে অনেকটা পথ হেঁটে এসব সংবাদকর্মীরা এখানকার খাবার খে‌তে আসেন ব‌লেও জানান।

এখানকার কাছাকা‌ছি থা‌কেন একজন গণমাধ্যমকর্মী, মাসুদ পার‌ভেজ। তি‌নি ব‌লেন, ‘আমি ঘরের কাছেই পিঠা মেলার বৈচিত্র্যময় ভর্তা-ভাজিতে বুঁদ হয়ে থাকি। ইদানীং যেমন ওদের রসুন ভর্তাটা বেশ উপভোগ করছি।’

মাসুদ পার‌ভে‌জের লেখা‌তেই এই রেস্টু‌রেন্ট সম্প‌র্কে জান‌তে পা‌রি। তি‌নি তার ফেসবু‌কে লি‌খে‌ছেন, ‘রোজার দিন-চারেক আগে মধ্যাহ্নভোজ সেরে এর দুই মালিকের একজনের সঙ্গে বাক্যালাপ থেকে পাওয়া চমকিত হওয়ার মতো তথ্যটি জানাই। গত দুই রোজাতেই লকডাউন ছিল এবং আশপাশের সব রেস্তোরাঁ তার মধ্যেও চুটিয়ে ইফতার সামগ্রীর হাট খুলে বসেছিল। কিন্তু পিঠা মেলার ঝাঁপ ছিল বন্ধ। বন্ধ মানে বন্ধ। এবার যখন করোনা বিদায় নেওয়ার পথে, তখন নিশ্চিত খোলা থাকবে ভেবে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাদের ইফতারের পসরায় স্পেশাল কী কী থাকছে।’

‘স্পেশাল দূরের কথা, এবার কিছুই থাকছে না’- অন্যতম মালিকের মুখে এই কথা শুনে প্রথমে বুঝিনি, সত্যিই কিছু থাকছে না! আসলেই তা-ই, মাসজুড়ে বিশাল অঙ্কের আয়ের নিশ্চয়তাকে পিঠ দেখিয়ে রেস্তোরাঁটি প্রথম রোজা থেকে এর কর্মীদের বেতন-বোনাসসহ ৩৫ দিনের ছুটি দিয়ে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দি‌য়েছে।

কেন এমন‌টি ক‌রে‌ছেন? ত‌বে কি রে‌স্তোরাঁটি বন্ধ ক‌রে দে‌বেন? জানতে চাইলে বলা হলো, ‘বাকি ১১ মাসে আল্লাহর অশেষ রহমতে আমাদের দারুণ ব্যবসা হয়। তাই এই এক মাস না হয় ব্যবসা না-ই করলাম। আমরা বরং এই মাসটিতে ইবাদত-বন্দেগিতে ডুবে থাকতে চাই। চাই কর্মীরাও তা-ই থাকুক। এজন্য প্রথম রোজা থেকে ৩৫ দিনের ছুটি, খুলবে ঈদের ৫ দিন পর।’

খোদ মা‌লি‌কের মু‌খে এমন কথা শোনার পর সাংবা‌দিক মাসুদ পার‌ভে‌জের ম‌তো অনেকেই অবাক হ‌বেন। কিন্তু অবাক হন না আ‌শপা‌শের বা‌সিন্দা আর বি‌ভিন্ন রক‌মের পসরা সা‌জি‌য়ে বসা ব্যবসায়ীরা। তা‌দেরই একজন বল‌লেন, ‘অনেক‌দিন থে‌কেই প্রতি রমজা‌নের সময় এই কাজ‌টি ক‌রেন পিঠা মেলার মা‌লি‌ক। রোজা শুরুর আগেই ২০-২৫ জন কর্মচারী‌কে এক মা‌সের ‌বেতন এবং বোনাসসহ ছুটি দি‌য়ে দেন।’

মাসুদ পার‌ভে‌জের লেখা‌টি প‌ড়ে আগ্রহী হই। সোমবার (৪ এপ্রিল) স‌রেজ‌মিন বনশ্রী যাই। রে‌স্তোরাঁটিও বন্ধ পাই। পা‌শের ব্যবসায়ী ভদ্রলো‌কের স‌ঙ্গে কথা ব‌লে, কথা শু‌নে তার দিকে তা‌কি‌য়ে থা‌কি। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। আর বিশ্বাস করবোই বা কীভাবে? যেখা‌নে সারা বছর ধ‌রে কার‌ণে-অকার‌ণে আমা‌দের বাজার নিয়ন্ত্রকরা নিত্যপ‌ণ্যের দাম বাড়া‌তে থা‌কে। মানুষ‌কে ঠ‌কি‌য়ে টাকা কামাই‌ করতে ব্যস্ত, সেখা‌নে এমন ব্যবসায়ীর দেখা পাওয়া যা‌বে; তাও খোদ রাজধানী‌তে! কেমন স্বপ্নময় ম‌নে হয়। হতাশার মা‌ঝেও এমন ছোট ছোট দু’চার‌টে আলো দে‌খেই মানুষ বাঁচার আশা খুঁজে পায়।

খুব ইচ্ছে ক‌রে, আশপা‌শের কা‌রো কাছ থে‌কে রে‌স্তোরাঁর মা‌লিকের ঠিকানা বা ফোন নম্বর নি‌য়ে দেখা ক‌রি, কথা ব‌লি। আবার ম‌নে হয়, যে মানুষ নি‌জে আড়া‌লে থে‌কে মানু‌ষের কল্যা‌ণে ‌নীর‌বে কাজ কর‌তে পছন্দ ক‌রেন; কী দরকার তা‌কে মানু‌ষের মা‌ঝে তু‌লে ধরার? তি‌নি বা তারা তো এ কাজ‌টি ফলাও ক‌রে মানুষ‌কে জানানোর জন্য কর‌ছেন না! আড়া‌লে থাক‌তে চাওয়া এসব মানুষের‌া আড়ালে থে‌কেই না হয় কাজ ক‌রে যাক ‘মানুষের জন্য’।

‌প্রিয় পাঠক, সংবাদকর্মী মাসুদ পার‌ভে‌জের লেখার শেষাংশ দি‌য়েই এরকম এক‌টি মান‌বিক ঘটনার কথা শেষ ক‌রি!

‘ঈদ ঘনিয়ে এলে প্রতিবছর ব‌কেয়া বেতন-বোনাসের দাবিতে আমা‌দের পোশাককর্মীদের আন্দোলনের খবরে যখন পত্রিকার পাতা সয়লাব হওয়াটাই অবধারিত, তখন এই শহরেরই এমন মানবিক খণ্ডচিত্র দেখে নীরবে অভিবাদন জানিয়ে ‌রে‌স্তোরাঁ থে‌কে বের হয়ে আসি। আসতে আসতে টের পাই, চোখ মুছতে দুই হাতের আঙ্গুলগুলোও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ইচ্ছে করে নিজেকেও ধিক্কার জানাতে। অভিজাত রেস্তোরাঁয় গিয়ে চেক ইন দিতে বিলম্ব করি না, অথচ এখানে নিয়মিত খেয়েও কোনো দিন চেক ইন দিলাম না। ত‌বে কথা দিচ্ছি, ঈদের পর রে‌স্তোরাঁ খোলামাত্রই এখানে বসে চেক ইন দেবই দেবো।’

ঢাকা/এনএইচ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়