ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

নিভৃতচারী বীর মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হকের গল্প

ড. জেবউননেছা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৯, ১৩ মে ২০২২   আপডেট: ১২:০২, ১৩ মে ২০২২
নিভৃতচারী বীর মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হকের গল্প

বীর মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হক। ছবি: সংগৃহীত

রাজধানী ঢাকায় ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত বেগম বাজার জামে মসজিদ এখনো তার মোঘল স্থাপত্যকলার আঙ্গিকে দাঁড়িয়ে আছে। সেই মসজিদে বেগমবাজারের আদি বাসিন্দা আলহাজ মো. আবু সাইদ ফজলুল হক ৭০  দশক থেকে  এবং ১৯৮৪ সালের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত আমৃত্যু সেক্রেটারি  ছিলেন। এরপর তার বড় ছেলে আলহাজ আজিজুল হক এই মসজিদে ২০২২ পর্যন্ত সেক্রেটারি ছিলেন।

এই পরিবারের আরেক সদস্য আজিজুল হকের ছোট ভাই আলহাজ আবু সাইদের মেজো ছেলে এনামুল হক। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে তাদের বাড়ি হওয়ায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় বাবার সাথে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে দাঁড়িয়ে শুনতেন, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নুরুল আমিনের কল্লা চাই’।  শৈশবে যে আগুন তার মাঝে রোপিত হয়েছিল, ধীরে ধীরে তা প্রতিবাদে পরিণত হয়। শৈশবে তিনি বাবার সাথে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে যান।

পরিণত বয়সে ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে সবার সাথে গর্জে উঠেন। শিক্ষা আন্দোলনের কর্মী হিসেবে তিনি এবং তার সহযোদ্ধারা মিলে মিছিল থেকে কার্জন হলে তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রী হাসান আসকারির খালি গাড়ি বোমা মেরে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন।

তিনি ১৯৬৬ সালের ছয় দফার একনিষ্ঠ সমর্থক ও কর্মী হিসেবে ঢাকার রাজপথে মিছিলে অংশগ্রহণ  করেছেন।  ১৯৬৯ সালে শহীদ আসাদ হত্যা মামলার একমাত্র জীবিত সাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হক যার সামনে শহীদ আসাদ মৃত্যুবরণ  করলে তিনি আসাদের মাথাটা কোলের মধ্যে  নেন এবং পকেটে রাখা রুমাল দিয়ে রক্ত মুছেন, তিনি এবং তৈয়বা আহমেদ তরু। এই আন্দোলনে তিনি ছিলেন মিছিলের অগ্রভাগে। আসাদের রক্তমাখা রুমাল অনেকদিন তার কাছে সংরক্ষিত ছিল।

এনামুল হকের ছোট ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক এবং ফুফাত ভাই নাট্যকার জালাল উদ্দিন নলুয়া

১৯৭০ প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে দুর্গত পূর্বপাকিস্তানে ইয়াহিয়া পরিদর্শনে না আসায় তারা বিক্ষোভ করেন। ১৯৭১ এর ৭ মার্চ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক বক্তব্য শোনার জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যান এবং মাঠের মধ্যভাগে থেকে বক্তব্য শুনেন।

২৫ মার্চ, ১৯৭১ এ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল তৎকালীন ইকবাল হলে রাতে অবস্থান করেন, পাক সেনাদের বর্বরতা প্রত্যক্ষ করেন। উল্লেখ্য, তিনি ছিলেন ইকবাল হলের ছাত্র।

২৬ মার্চ, ১৯৭১-এ ইকবাল হল থেকে বেগমবাজারে তার বাসায় যান। পাকবাহিনীরা পতাকা নামিয়ে ফেলার নির্দেশ দিলে তিনি বেগমবাজারে তাদের দোতলা বাড়ি থেকে পতাকা অনিচ্ছাকৃতভাবে নামালেও, তিনি পাকিস্তানের পতাকার এক কোণা পুড়িয়ে দেন, এরপর পোড়া পতাকা উড়ান। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ঠিক সাথে বাড়ি হওয়ায় ১৯৭১-এ কেন্দ্রীয় কারাগারের বহু বন্দুক, রাইফেল তাদের বাড়ি ফেলে যায় কারা রক্ষিরা।  তিনি এবং তার ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক এই অস্ত্র সরবরাহ করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের, এমনকি তার ছোট ভাই শামসুল হক ও  সাহায্য করতেন এই কাজে। এতেও যখন তিনি স্বস্তি পাননা, তখন তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য গৃহত্যাগ করেন। যাবার পথে মিরপুর ব্রিজে পাকসেনাদের বাঁধার মুখে পড়েন এবং বাড়ি ফিরে আসেন।

এরপর একদিন তাদের বেগমবাজারের বাড়িতে উপস্থিত হন ছায়ানটের প্রতিষ্টাতা সদস্য এবং বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা স্বাধীনতা পদক এবং একুশে পদক প্রাপ্ত ওয়াহিদুল হক, যিনি এনামুল হকের চাচাত ভাই।  তিনি ১৯৭১ এর সময়  বাংলাদেশ থেকে কলকাতা এক দল করে গানের শিল্পী নিয়ে যেতেন, এরপর বাংলাদেশে এসে আবার নিয়ে যেতেন। ওয়াহিদুল হক তাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে নিয়ে যান, সাথে নেন আর ও কয়েকজন শিল্পীকে।  প্রচণ্ড বৃষ্টি উপেক্ষা করে ঢাকা থেকে কুমিল্লার দাউদকান্দি হয়ে আলুর বস্তা আরোহনকারী ট্রাকে চড়ে তারা ধর্মনগরে পৌঁছেন। সেখানে শুনতে পান ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠ’ গানটি।  এই গানটি তাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে উজ্জীবিত হন। সেখান থেকে তারা আগরতলা যান,আগরতলা থেকে ক্রাফটস হোষ্টেলে যান।  সেখানে সেক্টর কমান্ডার বীর উওম নুরুজ্জামানের সাথে ওয়াহিদুল হক দেখা করিয়ে দেন,এরপর তিনি জানান মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থায় শিল্পী প্রয়োজন, তখন এনামুল হককে ওয়াহিদুল হক নিয়ে যান।

১৯৭১ এর বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী সমিতির সদস্য, রূপান্তরের গানের শিল্পী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে, শরণার্থী শিবিরে গানের মাধ্যমে উজ্জীবিত করেন তিনি।

কলকাতার রবীন্দ্রসদন, কলামন্দির, মহাজাতিসদনে সঙ্গীত পরিবেশন করেন এবং অর্থ সংগ্রহ করে বাংলাদেশ সরকারের তহবিলে জমা দেন।

ভারতে থাকাকালীন ১৯৭১-এ  সত্যেন সেন গল্প বলতেন তিনি লিখতেন, কারণ সত্যেন সেন চোখে দেখতে পেতেননা। ঋত্বিক ঘটক ছিলেন তার কাছের একজন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের কারিগর বিপ্লবী মাষ্টার দ্য সূর্যসেন এবং কল্পনা দত্ত, পরবর্তীকালে কল্পনা যোশির (সর্ব ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতির স্ত্রী) বাসায় ঋত্বিক ঘটক নিয়ে যান। সেখানে তাদের দল একটি করে গান শোনাতেন, আর কল্পনা যোশী স্মৃতিচারণ  করেন, কি করে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করেছেন সে গল্প বলতেন।

১৯৭১-এ ভারতে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হলে ৭ দিন তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্র নিজে এনামুল হককে সেবা করেন। এরপর সুস্থ না হওয়ায় কলকাতার পিজি হাসপাতালে ইলা মিত্রের স্বামী রনেন মিত্র তাকে ভর্তি করান, সেখানে ২৭ দিন থাকেন।

তিনি একজন নিভৃতচারী প্রচারবিমুখ মানুষ।  শুধু তাই নয় তার পুরো পরিবার মুক্তিযুদ্ধ সচেতন পরিবার, তার ছোট ভাই পুরান ঢাকা উর্দু স্কুলের অপারেশনের কারিগর বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক।  ছোট ভাই শামসুল হক ১৯৭১-এ তাদের বাড়িতে ষ্টেনগানের গুলি ট্রিগার থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় আহত হন, যে ক্ষতচিহ্ন নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন। তার চাচাত ভাই ইয়াকুব আলী চৌধুরী ভূইয়া, মাহমুদুল হক ভূইয়া, চাচাত ভাইয়ের ছেলে হাবিবুর রহমান ভূইয়া একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আরেক চাচাত ভাই জিয়াউল হক মিরপুরের নেতৃত্বস্থানীয় নেতা ছিলেন, ১৯৭১-এ শহীদ হন।  তার ফুফাত ভাই পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগের সদস্য, কবি ও নাট্যকার জালাল উদ্দিন নলুয়া ১৯৭১-এর একজন কলম সৈনিক, যিনি ১৮.০৩.১৯৭১ তারিখে ‘জয়বাংলা’ শিরোনামে কবিতা লিখেন। ১৯৭০ এর নির্বাচনে জয়ের ফলে ‘জয়নৌকা’  নাটক লিখেন যা নারায়ণগঞ্জের  স্থানীয় আওয়ামী লীগ অফিসে ১৯.১২.১৯৭২ তারিখে  প্রচারিত হয়। ১৯৭১-এ লিখিত  নারায়ণগঞ্জ এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তথ্যবহুল দিনলিপি নিয়ে বর্তমানে তার কন্যা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক গবেষণা করছেন। এই অসম্ভব সাহসী মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সবাই  নিভৃতচারী হয়ে আছেন।

ভাতিজি মিতা হকের সঙ্গে এনামুল হক

এনামুল হকের পরিবার সংস্কৃতি সচেতন পরিবার। তিনি ছিলেন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় এবং উদীচি শিল্পীগোষ্ঠীর  প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি  ষাট দশকে রেডিও পাকিস্তানের ঘোষক ছিলেন।

তার ফুফা মাতবর আলী ছিলেন রেডিও পাকিস্তানের প্রোগ্রাম অর্গানাইজিং সেক্রেটারি, আরেক ফুফা ঢাকা জাজের প্রাক্তণ   জোরার এবং বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র জাগো হুয়া সাভেরা ছবির অভিনেতা লিয়াকত হোসেন কানু মিয়া সরদার। তার ভাতিজি বিশিষ্ট রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী একুশে পদক প্রাপ্ত মিতা হক।

৭০ দশকে পুরান ঢাকার বেগমবাজারে তাদের বাড়িতে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের কর্মীদের নিয়মিত আসা যাওয়া ছিল। এনামুল হক ঢাকার নাট্য জগতে একজন প্রবীণ এবং পরিচিত মুখ। ঢাকা ক্লাবের তিন তিনবার কার্যনির্বাহী পরিষদের নির্বাচিত সদস্য।

এনামুল হক একজন জীবন্ত ইতিহাস। যিনি ১৯৬৯ সালের গণ অভুত্থানের শহীদ আসাদ হত্যা মামলার দুজন সাক্ষীর একজন। ঢাকার ইসলামিয়া বিদ্যালয়, জগন্নাথ কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এনামুল হক। তিনি কেরাণীগঞ্জের ভাওয়াল মনোহারিয়া গ্রামে আটি ভাওয়াল স্কুল (১৯৫৬) এর প্রতিষ্টাতা মরহুম আবদুল গফুর ভূইয়ার নাতি। এমন এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সদস্য এখন রাজধানীতে নিরবে  নিভৃতে বাস করেন।  মাঝে মাঝে বাসায় পিয়ানো বাজান, হারমোনিয়ামে গান করেন। অবসরে বই পড়েন।  বাগান করেন এবং গণমাধ্যমে ১৯৭১ এর রূপান্তরের গান পরিবেশন করেন।  সঙ্গীত শিল্পী শাহীন সামাদ এবং তার গাওয়া ‘রূপান্তরের গানের’ শ্রোতামহলে সমাদৃত। এই সিডিতে ধারা বর্ণনা দিয়েছেন বিশিষ্ট অভিনেতা  আসাদুজ্জামান নূর।  প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী কাইউম চৌধুরী।  গ্রন্থণা করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মফিদুল হক। সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী সুজেয় শ্যাম। মুখবন্ধ দিয়েছেন বিশিষ্ট অভিনেতা আলী জাকের।

এনামুল হক অবসরে পুরনো ছবিগুলো দেখে স্মৃতি হাতড়িয়ে বেড়ান, ১৯৬৪ সালের ছায়ানটের হারিয়ে যাওয়া সোনালি দিনগুলো। যেখানে তিনি গানের তালিম নিয়েছেন সনজীদা খাতুন, সোহরাব হোসেন এবং জাহিদুর রহিম প্রমুখের কাছে।

ছায়ানটে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ ছেলে শহীদ শেখ কামাল সেতার বাজাতেন, গানের আড্ডায় এনামুল হককে প্রায়ই বলতেন, ‘এনাম ভাই এই দেশ থেকে অবাঙালি বিহারীদের বহিস্কার করতেই হবে’। শেখ কামালের কথাই সত্যি হয়েছে। আমরা তাদের তাড়াতে পেরেছি।

এনামুল হক একজন গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ  করেছিলাম একটি স্বাধীন পতাকার জন্য। এরচেয়ে বড় অর্জন আর নেই। কিছুই চাওয়ার নেই। কিছুই পাওয়ার নেই।

বীর মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হকের দীর্ঘজীবন কামনা করছি। শেষ করব কবি ও নাট্যকার মু. জালাল উদ্দিন নলুয়ার একটি কবিতা, যেটি বীর মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হককে উৎসর্গ করে লিখেছেন-

‘ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একেবারেই কাছে/বেগমবাজার জামে মসজিদের পাশে/বীর মুক্তিযোদ্ধা দুই ভাই/এনামুল হক ও নুরুল হক হাসে’।

লেখক : অধ্যাপক ও প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক

আরও পড়ুন

৫৭তম জন্মদিনে আরিফ সেরনিয়াবাতের স্মৃতিকথা

মুক্তিযুদ্ধের অনন্য গবেষক জেবউননেছা

‘সামাজিক মাধ্যমে নয়, বইয়ে বেশি সময় দিন’

/সাইফ/

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়