ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন

কেএমএ হাসনাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫০, ৩ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন

কেএমএ হাসনাত : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের বিশাল সময় কেটেছে কারাগারে। বাঙালি অধ্যুষিত তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠির শাসনের নামে শোষণের প্রতিবাদে সংগ্রাম করতে গিয়ে প্রায়  ৪ হাজার ৬৮২ দিন তিনি কারাভোগ করেছেন। এর মধ্যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালোরাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। পাকহানাদার বাহিনী নানা টালবাহানা করে তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানোর অপচেষ্টাও করেছিল।

শেখ মুজিবুর রহমানের মত এত বেশি কারাভোগ দেশের আর কোন রাজনৈতিক নেতার করতে হয়নি। তিনি স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ব্রিৃটিশ শাসনামলে সাত দিন কারা ভোগ করেন। বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাভোগ করেন পাকিস্তন সরকারের আমলে।

বঙ্গবন্ধুর কারাভোগ নিয়ে তার ঘনিষ্ট সহচর, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং আওয়ামী লীগের প্রবীন নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেন, কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের ১৪টি বছর কারাগারে ছিলেন।

তিনি ১৯৩৮ সালে প্রথম কারাগারে যান। এরপর ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত তিনি পাঁচ দিন কারাগারে ছিলেন। একই বছর ১১ সেপ্টেম্বর আটক হয়ে মুক্তি পান ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি। এ দফায় তিনি ১৩২ দিন কারাভোগ করেন।

এরপর ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল আবারও কারাগারে গিয়ে ৮০ দিন কারাভোগ করে মুক্তি পান ২৮ জুন। ওই দফায় তিনি ২৭ দিন কারাভোগ করেন। একই বছরের ১৯৪৯ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৩ দিন এবং ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত  টানা ৭৮৭ দিন কারাগারে ছিলেন।

তোফায়েল আহমেদ, বলেন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পরও বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে যেতে হয়। সে সময় বঙ্গবন্ধু ২০৬ দিন কারা ভোগ করেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারির পর বঙ্গবন্ধু ১১ অক্টোবর গ্রেপ্তাার হন। এ সময়ে টানা ১ হাজার ১৫৩ দিন তাঁকে কারাগারে কাটাতে হয়। এরপর ১৯৬২ সালের ৬ জানুয়ারি আবারও গ্রেপ্তার হয়ে মুক্তি পান ওই বছরের ১৮ জুন। এ দফায় তিনি কারাভোগ করেন ১৫৮ দিন। এরপর ’৬৪ ও ’৬৫ সালে বিভিন্ন মেয়াদে তিনি ৬৬৫ দিন কারাগারে ছিলেন।

আওয়ামী লীগের এ প্রবীন নেতা বলেন, ছয় দফা দেওয়ার পর জাতির পিতা যেখানে সমাবেশ করতে গেছেন, সেখানেই গেপ্তার হয়েছেন। ওই সময়ে তিনি ৩২টি জনসভা করে বিভিন্ন মেয়াদে ৯০ দিন কারাভোগ করেন। এরপর ’৬৬ সালের ৮ মে আবারও গ্রেপ্তার হয়ে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্তি পান। এ সময় তিনি ১ হাজার ২১ দিন কারাগারে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই পাকিস্তান সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এ দফায় তিনি কারাগারে ছিলেন ২৮৮ দিন।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ পূর্ণতা লাভ করে। চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করলেও জাতির উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও অপূর্ণতা থেকেই যায়। দেশজুড়ে বিজয়ের এত আনন্দ-উল্লাসের মাঝে স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুই অনুপস্থিত। এ অবস্থায় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানান। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের চাপে পাক সামরিক সরকার  বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে  মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

অতপরঃ ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পিআইএ’র একটি বিশেষ বিমান বঙ্গবন্ধুকে বহন করে লন্ডনের উদ্দেশে রাওয়ালপিন্ডি ত্যাগ করে। ১০ ঘণ্টা পর (বাংলাদেশ সময় ১২টা ৩৬ মিনিট) বিমানটি হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকাসহ বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে বারবার বঙ্গবন্ধুর মুক্তিলাভ এবং লন্ডন রওনা হওয়ার খবর প্রচারিত হতে থাকলে কেবল দেশবাসীর মধ্যেই নয়, বিদেশে- বিশেষ করে লন্ডনে অবস্থানরত বাঙালি ও বাংলাদেশ সমর্থকদের মাঝেও ব্যাপক আনন্দ ও প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়।

বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে বঙ্গবন্ধু উন্নতশিরে প্রবেশ করেন জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলন কক্ষে। এ সময় তিনি ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে সমবেত অন্তত দু’শ সাংবাদিককে অভিনন্দন জানান। সাংবাদিকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু প্রথমেই বলেন, ‘আমি বেঁচে আছি, সুস্থ আছি।’ শত শত বাঙালি ও বাংলাদেশ সমর্থক ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানায়।

লন্ডনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি আমার জনগণের মাঝে ফিরে যেতে চাই। এখানে আর এক মুহূর্ত থাকতে রাজি নই আমি।’ তিনি বলেন, ‘যখন আমার জনগণ আমাকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেছে, তখন আমি ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ দায়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে সেলে বন্দিজীবন কাটাচ্ছি। অবশ্য ট্রাইব্যুনালের বিচারের রায় কখনও প্রকাশ করা হয়নি। একটি খুব খারাপ স্থানে কল্পনাতীত একাকিত্বে বন্দিজীবন কাটাতে হয়েছে। কোনো রেডিও না, চিঠি না, বাইরের জগতের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই ছিল না।’ উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে আবেগঘন পরিবেশে পিনপতন নীরবতায় সেই দুঃসহ সময় অতিবাহিত করার বর্ণনা দেন বঙ্গবন্ধু।

সাংবাদিক পরিবেষ্টিত অবস্থায়ই বঙ্গবন্ধু কথা বলেন ঢাকায় তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা এবং পরিবার-পরিজনের সঙ্গে। সংক্ষিপ্ত কথা হয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে। তাজউদ্দীন আহমদের কাছে প্রথমেই বঙ্গবন্ধু জানতে চান দেশের মানুষের কথা। তিনি বলেন, ‘হ্যালো, তাজউদ্দীন; আমি সাংবাদিক পরিবেষ্টিত হয়ে আছি। আমি তাদেরকে কী বলব? দেশের মানুষ কেমন আছে? বর্বর পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে যে অগণিত নারী, পুরুষ ও শিশু নিহত হয়েছে, এ মুহূর্তে তাদের কথা আমার জানতে খুব ইচ্ছে করছে।’

দেশে ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন তিনি। বেগম মুজিবসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন বঙ্গবন্ধু। এভাবেই কেটে যায় দুটি দিন। ১০ জানুয়ারি বীরের বেশে স্বাধীন বাংলায় ফিরে আসেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন কারাগারে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র যার স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্নের দেশে ফিরে যেন নতুন করে প্রান ফিরে পান। 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ আগস্ট ২০১৯/হাসনাত/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়