ওমিক্রন: লকডাউন প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞদের মতামত
মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম
ফাইল ছবি
করোনার আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন মোকাবিলায় নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে কি না, তা নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এরইমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেশব্যাপী ১৫টি নির্দেশনা দিয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও জানিয়েছেন, ওমিক্রনের বিস্তার ঠেকাতে সরকার বিধিনিষেধ নিয়ে ভাবছে। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিও শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে প্রয়োজনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আবারও বন্ধের ইঙ্গিত দিয়েছেন।
কিন্তু করোনার নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন অতি সংক্রামক হলেও তুলনামূলক কম শক্তিশালী এবং বাংলাদেশে ছড়ানোর মাত্রা বিবেচনায় এখনই বিধিনিষেধ আরোপের সময় আসেনি বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে ওমিক্রন এখনও সেভাবে বিস্তার লাভ করেনি। তাছাড়া এই ভ্যারিয়েন্ট তুলনামূলকভাবে অন্য সব ভ্যারিয়েন্ট থেকে কম শক্তিশালী। তাই আরও পর্যবেক্ষণ করে বিধিনিষেধের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন তারা।
অপরদিকে, সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, এখনো ওমিক্রনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়নি। এ অবস্থায় সংক্রমণ প্রতিরোধে আপাতত স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশে এখন পর্যন্ত ১০ জনের শরীরে ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। গত ১১ ডিসেম্বর দেশে প্রথম জিম্বাবুয়ে ফেরত বাংলাদেশি দুই নারী ক্রিকেটারের দেহে ওমিক্রনের জীবাণুর অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
এরপর গত ২৭ ডিসেম্বর একজন এবং ২৮ ডিসেম্বর আরও চারজনের শরীরে ওমিক্রন শনাক্তের তথ্য পাওয়া যায়।
ওমিক্রন সংক্রমণ নিয়ে ভীত বা আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছেন সরকারের করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য সচিব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘ওমিক্রন বিষয়ে এখনও কারিগরি কমিটির পক্ষ থেকে কোনো প্রস্তাবনা দেওয়া হয়নি। যদিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশেই ওমিক্রন ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে।’
অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট যদি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টকে সরিয়ে জায়গা দখল করে নেয়, তাহলে খুবই ভালো হবে। কারণ, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের চেয়ে অনেক মারাত্মক ও ক্ষতিকারক।’
বিধিনিষেধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখনো বিধিনিষেধের সময় আসেনি। অনেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার কথা বলছে, আমি মনে করি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনও হয়নি।’
অধ্যাপক ফরহাদ মঞ্জুর বলেন, ‘ওমিক্রন বিষয়ে ইউরোপিয়ান যেসব রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে, তাতে আমার মনে হচ্ছে, ওমিক্রন নিয়ে এতোটা আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা, লকডাউন দেওয়া বা কারফিউ জারি করা এসব শুনলে সাধারণ মানুষ ভয় পেয়ে যায়। এত ভীত হওয়া বা আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে, মাস্ক পরে, ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে।’
অপরদিকে, দেশে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হলেও এটি এখনো ছড়ায়নি বলে জানিয়েছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর।
তিনি বলেন, ‘ওমিক্রন নিয়ে এখনও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়লেও ওমিক্রনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়নি।’
ড. আলমগীর বলেন, ‘মনে রাখতে হবে যাদের বয়স বেশি, যারা ফ্রন্টলাইনে কাজ করছেন, যাদের কমোরবিডিটি আছে, ওমিক্রন ভাইরাস দুর্বল হলেও তাদেরকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করতে পারে। সেজন্য ওমিক্রন যেহেতু প্রচণ্ড সংক্রমণশীল একটি ভাইরাস, যদি বাংলাদেশে এটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যায়, তাহলে ঘরে ঘরে রোগী হবে। আর পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর একটা বড় প্রভাব পড়বে।
ডা. আলমগীর বলেন, ‘দেশে বর্তমানে করোনা সংক্রমণ বাড়ার অন্যতম কারণ ওমিক্রন নয়, স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা। দেশজুড়ে প্রচুর বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে, বনভোজন হচ্ছে কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি তেমনভাবে মানা হচ্ছে না। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতেও লাখ লাখ মানুষ ঘুরতে যাচ্ছেন। তাদের বেশিরভাগই মাস্ক পরছেন না, স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। এসব কারণেই দেশে সংক্রমণ বাড়ছে। বর্তমানে সংক্রমণ বাড়ার পেছনে ওমিক্রনের সঙ্গে সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই।’
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মনজুর রহমান গালিব বলেন, ‘ওমিক্রন নিয়ে এই মুহূর্তে কিছু বলা কঠিন। পৃথিবীতে যে হারে এই ভ্যারিয়েন্ট পড়ছে, তাতে আমাদের অবশ্যই আরও সিরিয়াস হতে হবে। যেকোনো সময় ওমিক্রন তার রূপ পরিবর্তন করতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘আশার কথা হচ্ছে- ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের মৃদু উপসর্গ, এতটা ভয়াবহ না। বাসায় বসেই এর চিকিৎসা করা যায়। সবমিলিয়ে বলা যায়, যে হারে এই ভ্যারিয়েন্ট সারাবিশ্বে ছড়িয়ে যাচ্ছে, নতুন বছরে ওমিক্রন আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সুতরাং আমাদেরকে আগে থেকেই সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি টিকা নিতে হবে।’
অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বলেন, ‘ভারতে যেভাবে ওমিক্রনের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে, আমাদের দেশেও যেকোনো মুহূর্তে ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই, যারাই দেশের বাইরে থেকে আসবে, তাদের সবাইকেই স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানা ও মাস্ক পরতে হবে।’
এদিকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ‘দেশে করোনা পরিস্থিতি খারাপ হলে লকডাউনের চিন্তা মাথায় আছে। তবে এখুনি আমরা সেই চিন্তা করছি না। যদি পরিস্থিতি হাতের বাইরে যায়, সংক্রমণ অনেক বৃদ্ধি পায়; তাহলে লকডাউনের চিন্তা মাথায় আছে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের বর্ডারগুলোতে স্কিনিং জোরদার করা হয়েছে। কোয়ারেন্টাইনে যারা থাকবে, তারা যাতে বাইরে ঘোরাফেরা না করতে পারে সেজন্য সেখানে পুলিশি প্রহরা থাকবে। এ বিষয়ে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে বলা হয়েছে।’
বিধিনিষেধ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘গণপরিবহনে আসন সংখ্যার অর্ধেক যাত্রী নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। যানবাহনে মাস্ক ছাড়া চলাচল করা যাবে না। যারা চলাচল করবে, তাদের জরিমানার মধ্যে পড়তে হবে। রেস্টুরেন্ট-হোটেলে মাস্ক পরে যেতে হবে। মাস্ক ছাড়া গেলে দোকানদার ছাড়াও যিনি যাবেন তারও জরিমানা হবে। দোকানপাট খোলা রাখার সময়সীমা কমিয়ে রাত ১০টার পরিবর্তে রাত ৮টা পর্যন্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য তাগাদা দেওয়া হয়েছে। রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে ভ্যাকসিন কার্ড দেখাতে হবে।
ঢাকা/সনি
আরো পড়ুন