ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ছোট্ট আভার স্বপ্নভঙ্গের চিঠি ও ট্রাম্পের জবাব

রাসেল পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২৭, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছোট্ট আভার স্বপ্নভঙ্গের চিঠি ও ট্রাম্পের জবাব

আভার বয়স এখন আট বছর

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বড়দিনের পরের দিন। মেরি অলসেনের বাড়ির দরজায় একটি চিঠি। সেটি হাতে নিলেন। চিঠির ওপরের বাঁ পাশে লেখা ‘দি হোয়াইট হাউস’। মেরি থমকে গেলেন! হোয়াইট হাউস থেকে এসেছে? ধন্ধে পড়ে গেলেন। চিঠিটির খামের শব্দ ও সিলের ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেললেন। দেখলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিল। নিশ্চিত হলেন। চিঠির প্রেরক ট্রাম্প।

আভা অলসেনের ঠিকানায় এসেছে চিঠি। মেরির মেয়ে আভা। দ্বিতীয় গ্রেডের শিক্ষার্থী। বয়স সবে আট বছর। খাম খুলে চিঠি বের করলেন মেরি। আভা তখনো কিছু জানে না। আভার মানসিক অবস্থা ভালো নয়। তাই চিঠিতে কী লেখা আছে, তা আগে ভালো করে বুঝে নিতে চাইলেন তিনি। আশ্বস্ত হলেন খারাপ কিছু নেই। শান্ত স্বরে মেয়েকে শোয়ার ঘরে ডাকলেন। মেরির হাতে চিঠিটি তুলে দিলেন। ট্রাম্পের সিলযুক্ত খামটিও দিলেন তার হাতে।

মায়ের পাশে বসে আভা চিঠিটি পড়লো। ট্রাম্প লিখেছেন, ‘প্রিয় আভা, তোমার চিঠির জন্য ধন্যবাদ। আমার সঙ্গে তোমার গল্প ভাগাভাগি করে নিয়ে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছো। তোমার বন্ধু জ্যাকবকে হারানোর কথা শুনে মিসেস ট্রাম্প ও আমি খুবই দুঃখ পেয়েছি।’ আভার দু-চোখ ভরে আনন্দ উছলে উঠল। ‘সত্যিই, প্রেসিডেন্ট পাঠিয়েছেন এই চিঠি!’

প্রায় ১৫ মাস আগের ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলাইনা রাজ্যের টাউনভিল। বিকেলবেলা। সাত বছরের আভা তার বিদ্যালয়ের বাইরে হাঁটছিল। হঠাৎ হট্টগোলা শুরু হলো। পুলিশ বলছিল, ১৪ বছরের এক কিশোর পিকআপ নিয়ে বিদ্যালয়ের মাঠে ঢুকেছে। তার কাছে অস্ত্র আছে। পিকআপ থেকে নেমে সে শিক্ষার্থীদের দিকে পিস্তল তাক করেছে এবং তাকে আটকানোর আগেই গুলি চালাতে শুরু করেছে। পিস্তলটি জ্যাম হওয়ার আগ পর্যন্ত টানা ১২ সেকেন্ড গুলি চালাল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তার ছোঁড়া গুলিতে টাউনভিল এলিমেন্টারি স্কুলের তিন জন বিদ্ধ হলো।

একটি গুলি আভার প্রথম গ্রেডের স্কুলটির এক শিক্ষকের কাঁদে গিয়ে বিধল। আরেকটি গুলি গিয়ে লাগল তার সহপাঠীর পায়ে। আর তৃতীয় গুলি গিয়ে লাগল জ্যাকব হল-এর গায়ে। আভার খুব প্রিয় জ্যাকব। মাত্র সাড়ে তিন ফুট উঁচু। পাতলা লেন্সের সাদা চশমা পরে থাকে। আভাদের শ্রেণিতে সবচেয়ে ক্ষুদে বন্ধু জ্যাকব। আভা ঠিক করেছিল, যখন তারা বড় হবে, তখন সে জ্যাকবকে বিয়ে করবে। জ্যাকবই একমাত্র ছেলে, যাকে চুমু দিয়েছে আভা।

 


আভার ক্ষুদে বন্ধু জ্যাকব, একদিন যাকে সে বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছিল

 

গুলিবিদ্ধ হওয়ার তিন দিন পর প্রিয় জ্যাকবের মৃত্যু হয়। তাকে হারিয়ে আভা খুব দুঃখ পায়। সে অমনোযোগী হয়ে পড়ে। পরে চিকিৎসক জানায়, ওই ঘটনায় আভা মানসিক সমস্যায় ভুগছে। তাকে বাড়িতে রেখে পড়াশোনা করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। এরপর ওই ঘটনা নিয়ে যত খবর হয়েছে, তাতে আভা যে শব্দগুলো বলেছে, তার মধ্যে বারবার এসেছে ‘বন্দুক, গুলি, রক্ত ও হত্যা’।

ওই দিনের পর আভা আর কখনো স্কুলে যায়নি। সেদিন তার ছোট ভাই ক্যামেরন স্কুলের বাইরে ছিল। সে এখন স্কুলে যায়। আভার বাদামি দুই চোখ এখন খুব সতর্ক। ক্যামেরনকে নিয়ে সে সব সময় দুশ্চিন্তায় থাকে। তার মন অস্থির থাকে। মানসিক জটিলতা থেকে তার বিশ্রাম মেলে খুবই কম। যুক্তরাষ্ট্রে লাখ লাখ শিশু স্কুলে যায়, খেলার মাঠে ছোটাছুটি করে, ক্যাফেটেরিয়ায় সময় কাটায়; তাদের সবার জন্য উদ্বেগে থাকে আভা। এসব নিয়ে ভাবনার মধ্যে গত গ্রীষ্মের এক সকালে নোটবুকের একটি পাতা ও পেন্সিল নিয়ে রান্নাঘরের টেলিবে বসে সে।

লেখা শুরু করে আভা : ‘প্রিয় মি. প্রেসিডেন্ট।’ পেন্সিল ঘঁসে ঘঁসে হরফগুলো মোট করে দেয় সে। তারপর সে তার দেখা দুর্ঘটনা ও সেই স্মৃতি নিয়ে যন্ত্রণাময় সময় পার করার বর্ণনা দিতে শুরু করে। আভা লেখে : ‘যা ঘটেছিল, তার সবই আমি শুনেছি ও দেখেছি এবং আমি খুবই আতঙ্কিত। আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু জ্যাকবের গুলি লাগে এবং পরে সে মারা যায়। ওই ঘটনায় আমি খুবই কষ্ট পেয়েছি। আমি ওকে ভালোবাসতাম এবং একদিন বিয়ে করব বলে ঠিক করেছিলাম।’

এরপর আভা প্রেসিডেন্টকে প্রশ্ন করে, স্কুলে বন্দুক হামলা থেকে তিনি কীভাবে শিশুদের রক্ষা করবেন। আভা লেখে : ‘দয়া করে, শিশুদের বন্দুক থেকে রক্ষা করুন।’ তার চিঠি শেষ হয় এখানে।

জ্যাকবকে হত্যাকারী কিশোর জেসে অসবর্ন। তখন তার বয়স ছিল ১৪ বছর। গত বছর সাক্ষাৎকারে তার পরিবারের সদস্যরা দাবি করেন, অসবর্নও স্কুলে নিপীড়নের শিকার হওয়ায় তার মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। যে কারণে সে তার বাবার কাছ থেকে পিস্তল ছিনিয়ে নিয়ে প্রথমে তার বাবার মাথার পেছন দিকে গুলি করে এবং পরে স্কুলে গিয়ে শিশুদের ওপর হামলা চালায়। সেদিন ছিল ২০১৬ সালের সেপ্টম্বর মাসের শেষ বুধবার।

 


পেন্সিল দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে লেখা আভার চিঠি

 

১৯৯৯ সালে কলাম্বিন হাই স্কুলে বন্দুক হামলার পর থেকে ২০১৬ সালের সেপ্টম্বর মাস পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১৭০টি প্রাইমারি ও হাই স্কুলে গুলি চালানো হয়েছে। এসব হামলায় বিভৎস অভিজ্ঞতার মুখে পড়েছে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার শিক্ষার্থী। একটি অনলাইনে এই তথ্য দেওয়া হলেও এমন আরো অনেক বন্দুক হামলার ঘটনা সেখানে উল্লেখ করা হয়নি।

সে যা হোক, জেসের বিচার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ১২ ফেব্রুয়ারি শুনানি হবে। তবে তার আগে ঠিক করা হবে, জেসের বিচার কিশোর না কি প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে করা হবে। যদি প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে বিচার করা হয়, তাহলে কয়েক দশক ধরে তাকে কারাগারে কাটাতে হবে।

হত্যাকারী জেসের চেহারা কখনোই ভুলতে পারে না আভা। দানব ও ভয়ংকর সন্ত্রাসীর মতো তার ছবি সব সময় আভার মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে। দুঃস্বপ্নেও জেসে তাকে তাড়া করে। তবে প্রেসিডেন্টের চিঠি পাওয়ার পর আভার মানসিক অবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। আভার বয়স এখন আট বছর।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, বন্দুক থেকে লাখ লাখ শিশুকে রক্ষা করবেন তিনি। ট্রাম্পের চিঠির জবাবে ৮ জানুয়ারি আরেকটি চিঠি পাঠিয়েছে আভা। প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার জন্য প্রার্থনা করেছে সে। চিঠিতে সে আশা প্রকাশ করেছে, নতুন করে আর কোনো শিশু আহত হওয়ার আগেই স্কুলগুলো নিরাপদ করে গড়ে তুলবেন প্রেসিডেন্ট।

আভা যা-ই প্রত্যাশা করুক না কেন, যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলে বন্দুক হামলা থামেনি। ৮ জানুয়ারির দুই সপ্তাহ পরই কেন্টাকির একটি স্কুলে হামলা হয়। দুজন নিহত ও বেশ কয়েকজন তাতে আহত হয়। তবে আভার মা তাকে আর এসব খবর দেখতে বা শুনতে দিতে চান না। কিন্তু আভা কি এসব থেকে মুক্ত থাকতে পারবে?

তথ্যসূত্র : এনডিটিভি অনলাইন



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/রাসেল পারভেজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়