ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘বুলবুলের জন্য ১০ নম্বর সংকেত কেন?’

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২৫, ১৯ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘বুলবুলের জন্য ১০ নম্বর সংকেত কেন?’

সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ধরনের ঝড়ের আঘাত এই ব-দ্বীপ অঞ্চলের জন্য নতুন নয়। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব এবং পরবর্তী সময়ে করণীয় প্রসঙ্গে বলেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান। তিনি ঘূর্ণিঝড় বিশেষজ্ঞ। এ বিষয়ে তার রয়েছে একাধিক গবেষণা। কথোপকথনে ছিলেন জাহিদ সাদেক।

রাইজিংবিডি: এ অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। এর উৎপত্তি কীভাবে হয় বলে মনে করেন?

ড. মো. মনিরুজ্জামান: বাংলাদেশে প্রি মনসুন ও পোস্ট মনসুন দুই ধরনের ঘূর্ণিঝড় আছে। পোস্ট মনসুনের ক্ষেত্রে গত ২০ বছরে আমাদের সিডর বেশি শক্তিশালী ছিল। ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে যখন তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রী পার হয় তখন সেখানে ডিপ্রেশন তৈরি হয়। এই ডিপ্রেশন আস্তে আস্তে শক্তি সঞ্চার করে। পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে একটি গতি পায়। যেহেতু সেটি পানির মধ্যে শক্তি পায় ফলে নিরক্ষীয় রেখা থেকে ক্রান্তীয় রেখার দিকে আসার চেষ্টা করে। এ কারণে এর নাম হয় ক্রান্তীয় ঝড় বা ‘ট্রপিকাল সাইক্লোন’। বুলবুলের ক্ষেত্রে উত্তর আন্দামান সাগরে এর উৎপত্তি ঘটে। ৫ নভেম্বর প্রথমে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয় যা পরদিন অর্থাৎ ৬ তারিখ গভীর নিম্নচাপ এবং ৭ নভেম্বর দুপুরে নিম্নচাপ শক্তিশালী হড়ে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়। ঐদিন রাতেই এটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। তখন এর নাম হয় মত্মো। এটি হারিকেন ঝড়ের সমতুল্য শক্তি তৈরি করা দ্বিতীয় ঘূর্ণিঝড়। এর পূর্বে এমন ঝড় দেখা গিয়েছিল সর্বশেষ ১৯৬০ সালে। নিরক্ষীয় ঝড়গুলোর মধ্যে এটি ১৮০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পুনঃশক্তি অর্জন করেছে। এটি একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। গত ২৪ অক্টোবর ফিলিপাইন সাগরে মত্মোর উৎপত্তি। ফিলিপাইন সাগরকে ঘূর্ণিঝড়ের আতুরঘর বলা হয়।

রাইজিংবিডি: এর নামকরণ কেন বুলবুল হলো?

ড. মো. মনিরুজ্জামান: আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী রাষ্ট্রগুলো নিয়ে গঠিত ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিল ফর এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিক (এসক্যাপ) এর ৮ সদস্যের প্যানেল সকলের সম্মতির ভিত্তিতে নতুন ঘূর্ণিঝড়ের নাম বছরের শুরুতেই নির্ধারণ করে। সে মতে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের নামকরণ প্রস্তাব করে পাকিস্তান। তবে ফিলিপাইন সাগরে এটি মত্মো নামে পরিচিত ছিল।

রাইজিংবিডি: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বুলবুলের আঘাতের তীব্রতা যতটা ভাবা হয়েছিল তেমন হয়নি। এর পেছনের কারণ কী বলে মনে করেন?

ড. মো. মনিরুজ্জামান: বুলবুল প্রথমে ইন্ডিয়ার পূর্ব উপকূল ধরে এগিয়েছে। ফলে শক্তি কমে গেছে। তারপর এটি বাংলাদেশের উপকূলে প্রবেশ করে। সুন্দরবন হয়ে আমাদের উপকূলে আঘাত হানার কারণে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। যদিও এটি সিভিয়ার সাইক্লোন কিন্তু আমরা একে ক্যাটাগরী-২ বলি। সুন্দরবনের ল্যান্ড ফলের কারণে এটির প্রভাব কম হয়েছে। তবে যদি সিডরের মতো সরাসরি সাগর থেকে আসত তবে আরো বড় ক্ষতি হতো। তাছাড়া আমাদের উপকূলে যখন বুলবুল আঘাত হানে তখন মধ্যরাত। সে সময় ভাটা থাকায় খুব একটা প্রভাব দেখা যায়নি। কিন্তু সকালবেলা জোয়ার থাকায় পটুয়াখালী, বাগেরহাট, ভোলা অঞ্চলে ক্ষতির পরিমান বেশি। 

রাইজিংবিডি: ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় সুন্দরবনের ভূমিকা কী?

ড. মো. মনিরুজ্জামান: আমাদের দেশে ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে সিডর, আইলা, ফনী কিংবা বুলবুলের ক্ষেত্রে সুন্দরবন অনেক বেশি পরিমানে ক্ষতির শিকার হচ্ছে। সুন্দরবনের একটা সহ্য ক্ষমতা আছে। তাছাড়া সুন্দরবনের উপর আমরা অত্যাচার করি। সেখানে বিভিন্ন মানুষ যায় জীবিকা নির্বাহের জন্য। তারাও নানাভাবে ক্ষতি করে। মনে রাখতে হবে, সুন্দরবন না থাকলে ঝড়ের ভয়াবহ প্রভাব পড়বে উপকূলে। এ কারণে যে কোনো উপায়েই হোক সুন্দরবনের ক্ষতি করা যাবে না। ঝড় মোকাবেলার জন্য বনকে প্রস্তুত করে রাখতে হবে। প্রয়োজনে এখনই উদ্যোগ নিয়ে বন রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। না হলে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে। 

রাইজিংবিডি: এজন্য কী ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে?

ড. মো. মনিরুজ্জামান: সুন্দরবনে ৩০ থেকে ৪০ হাজার লোক বসবাস করে সিজনালি। তবে সারাবছর গড়ে ৪০ হাজার লোক থাকে। যা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-এর প্রতিবেদনেও এসেছে। এর মধ্যে রাশ মেলা এবং দূবলার চরে সিজনাল শুঁটকির ব্যবসার সাথে জড়িত যারা তারা খুব সংকটের মধ্যে রয়েছে। যদিও এবার বেঁচে গেছে কিন্তু বুলবুলের প্রভাব যদি সিডরের মতো হতো, তবে তাদের অনেকেরই জীবন নাশ হতো। সুতরাং তাদের জীবনের নিরাপত্তার বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা দরকার। তাদের উদ্ধার বা আপদকালীন কোনো ব্যবস্থা নেই। কোস্ট গার্ড-এর সহায়তা না পাওয়ায় সাধারণ মানুষ প্রথাগত ভাবে নৌকা কোনো ছোট খালে ভিড়ায়। এতে তাদের না খেয়ে বৃষ্টিতে ভিজে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করতে হয়। বৈরী পরিবেশে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়। যদিও তারা লড়াই করছে কিন্তু তাদের জন্য আরো ভালো কিছু করার সুযোগ আছে। এতো বড় দুর্যোগেও ওরা খোলা অকাশের নিচে রাত যাপন করে।

রাইজিংবিডি: ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় সরকারি কী ধরনের উদ্যোগ আছে?

ড. মো. মনিরুজ্জামান: সরকারী পদক্ষেপগুলো খুব দুর্বল। আর সাইক্লোন শেল্টারগুলোও খুব জরাজীর্ণ। দূবলার চরে সিজনালি যে ১০ থেকে ১৫ হাজার লোক কাজ করতে যায় তাদের শেল্টারগুলো দুর্বল। তাছাড়া সেগুলো সেখানকার প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে। আমাদের ফরেস্ট গার্ডদেরও বেশ কিছু দুর্বলতা আছে। এজন্য সুন্দরবনের সাথে যারা জড়িত বিশেষ করে এখানকার যারা পেশাজীবী বাওয়ালী, মওয়ালী, জেলেরা ঘূর্ণিঝড়কালীন সংকট অবস্থায় থাকেন। এই জায়গাগুলোতে আরো কাজ করা দরকার। সরকারি উদ্যোগে এই জায়গাটিতে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

রাইজিংবিডি: সরকারি কী ধরনের উদ্যোগ প্রয়োজন?

ড. মো. মনিরুজ্জামান: বিশেষ করে সুন্দরবনে যারা পেশাজীবী তাদেরকে উদ্ধার করার জন্য কোস্ট গার্ড ব্যবস্থা নিতে পারে। তাদের সে সক্ষমতা আছে। সুন্দরবনে আমাদের কোস্ট গার্ড, ফরেস্ট গার্ড এবং মংলা বন্দরের সক্ষমতা আছে ঘুর্ণিঝড় থেকে তাদের উদ্ধার করার। এদের মাধ্যমে তাদরে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসা সম্ভব। তাছাড়া আমাদের বেসরকারি সংস্থাগুলো সুন্দরবন এলাকায় কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না। আমাদের আইন তাদের সে অনুমতি দেয় না। যে কারণে কোন বেসরকারি সংস্থা সেখানে ঢুকতে পারছে না। বিধায় কাজেও খুব একটা অগ্রগতি হচ্ছে না। আমাদের দাবি থাকবে বেসরকারি সংস্থাকে সুন্দরবনে দূর্যোগ ব্যবস্থাপনার সুযোগ দিতে হবে। যেহেতু সরকার এককভাবে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। আরেকটি বিষয় হলো, পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে যে কমিটি করা হয়েছে তা দিয়ে খুব একটা কাজ হয় না। বিশেষ করে যারা ওখানে প্রধান দায়িত্বে থাকে তাদের কোন অভিজ্ঞতা না থাকায় এসব কমিটি কাজে আসে না। উদাহরণ হিসেবে যদি ওই এলাকার ডিসি কিছুদিন আগে সেখানে যান তবে তিনি দূর্যোগ ব্যবস্থাপনার কী জানবেন? এজন্য একটি ফরমাল ফোর্স দরকার। যেমন ‘ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স’ নামে ভারতে আছে।

রাইজিংবিডি: এর কাজ কী হবে?

ড. মো. মনিরুজ্জামান: ‘ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স’ নামে একটি বাহিনী থাকবে যাদের একটি কমান্ডিং এরিয়া থাকবে। তারা স্থানীয় প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে কাজ করবে। কিন্তু তারাই সবকিছু করবে। যেটা ভারতে ভালোভাবে কাজ করছে। ইতোমধ্যে তারা ১৫টির মতো রাজ্যে এমন ফোর্স গঠন করেছে। এসব বাহিনী বিভিন্ন বাহিনী থেকে নিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে সাধারণ মানুষও থাকতে পারে। তবে এটি অবশ্যই একটি অফিসিয়াল ফোর্স হতে হবে যাতে তারা ডিজাস্টারে যথাযথভাবে রেসপন্স করতে পারে। আমি চাই বাংলাদেশে এটা করা হোক। এটি হবে সিভিল ফোর্স। এখানে আর্মস এর কোন বিষয় আসবে না। এটা দীর্ঘ মেয়াদী প্রস্ততির অংশ হতে পারে।

রাইজিংবিডি: দূর্যোগকালীন পূর্বাভাস ঠিক আছে কিনা?

ড. মো. মনিরুজ্জামান: বুলবুলের জন্য ১০  নম্বর সংকেত কেন? এটি ১০ নম্বর হওয়ার কথা নয়। যদি সিডরের মতো ঘটনা ঘটত তবে এটা কত নম্বর সংকেত হতো? তখন তো বাড়ানোর কোন জায়গা নেই। এজন্যই আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি অনেক স্থানীয় বাসিন্দা ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেয়ার পরেও বাসা বাড়ি ছেড়ে যায়নি। এর কারণ স্থানীয়রা আমাদের চেয়ে বেশী অভিজ্ঞ। তারা জানেন কোনটা কত নম্বর সতর্ক সংকেত হতে পারে। তাদের স্থানীয় জ্ঞান থাকায় তারা কিন্তু বাসা ছেড়ে যায়নি। এজন্য দ্রুত ১০ নম্বর সংকেত দেয়ার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া খুলনা শহরে কীভাবে ১০ নম্বর সংকেত দেয়?  খুলনা শহরের যে স্থায়িত্ব তাতে ১০ নম্বর সংকেতের প্রয়োজন নেই। উপকূলীয় অঞ্চলে ঠিক যেখানে যেখানে ১০ নম্বর প্রযোজ্য সেখানেই জিআইএস দিয়ে ম্যাপিং করে দিতে হবে। অবশ্যই ক্যাটাগরি ঠিক করে দিতে হবে। যাতে বুঝা যায়,  কোনটি ৮ নম্বর সতর্ক সংকেত, কোনটি ১০ নম্বর। সংকেত নিয়ে এমন হওয়ার কারণ জিআইএস ব্যবহার না করেই আমরা বিভিন্ন বন্দরে সংকেত জারি করি। যেমন পায়রা বন্দর থেকে মংলা বন্দরের দূরত্ব প্রায় দুইশ কিলোমিটার। সুতরাং দুই বন্দরের সংকেত কখনো  এক হওয়ার কথা নয়। এই বিষয়গুলো আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়