ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘অলিম্পিকে শুনতে চাই, মাবিয়া আক্তার রিপ্রেজেন্টিং বাংলাদেশ’

ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১১ জুলাই ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
‘অলিম্পিকে শুনতে চাই, মাবিয়া আক্তার রিপ্রেজেন্টিং বাংলাদেশ’

এসএ গেমসে ভারোত্তলনে স্বর্ণপদক জয়ের মঞ্চে দাড়িয়ে জাতীয় পতাকাকে তার স‌্যালুট ও অঝোরে কান্নার ছবি ছড়িয়ে গিয়েছিল দেশ থেকে দেশান্তরে। ২০১৬ এসএ গেমসের পর ২০১৯ সালেও তার গলায় উঠে শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার। বলা হচ্ছে মাবিয়া আক্তার সীমান্তর কথা।

‘গ্রেটেস্ট শো অব আর্থ’- অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মাবিয়া। মহারণের আগে প্রস্তুতিতে বাধ সাধলো মহামারি করোনা। শেষবার জিমে গিয়েছিলেন ১৭ মার্চ। প্রায় চার মাস হতে চলল কোনো কার্যক্রম নেই। দীর্ঘ সময় চার দেয়ালে কাটিয়ে তার উপলব্ধি, ক‌্যারিয়ারে দুই বছর পিছিয়ে গিয়েছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর শূন‌্য থেকে সব শুরু করতে হবে।

রাইজিংবিডি’র সাক্ষাৎকারে মাবিয়া আক্তার সীমান্ত আরো কথা বললেন নিজের সফর নিয়ে, কঠিন সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা, জানালেন নিজের লক্ষ‌্য, পরিকল্পনা, কষ্ট ও ক্ষোভের কথা। আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব। মুঠোফোনে তাঁর কথা শুনেছেন ইয়াসিন হাসান। 

প্রথম পর্ব: ‘স্পোর্টসে নারীদের সবচেয়ে বড় বাধা ড্রেস-আপ’

রাইজিংবিডি: অলিম্পিক নিয়ে মাবিয়ার ভাবনা কী?

মাবিয়া আক্তার সীমান্ত: মাবিয়ার স্পোর্টস ক‌্যারিয়ার জুড়েই একটাই ভাবনা, অলিম্পিক। আমি যখন থেকে ওয়েট লিফটিং বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই মাথায় ছিল আমাকে অলিম্পিকে খেলতে হবে। দেশকে, নিজেকে সবচেয়ে মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করার একটাই মাধ‌্যম অলিম্পিক। আট বছরের চেষ্টা করে যাচ্ছি। এবার ভালো সুযোগ আছে অংশগ্রহণ করার। চেষ্টা করবো যেন এবার সফলভাবে অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করতে পারি।

রাইজিংবিডি: ২০১৬ ও ২০১৯ এসএ গেমসে আপনি স্বর্ণপদক পেয়েছেন। দেশের পতাকা সবার উপরে দেখার আনন্দ কতোটুকু?

মাবিয়া আক্তার সীমান্ত: এটা একটা জয়। দেশের পতাকা আমার জন‌্য উপরে আছে, আমি সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছি। এটা নিজের কাছে নিজের অনেক বড় পাওয়া। হৃদয়ের ভেতরে একটাই কথা আসে, আজ আমার জন‌্য আমার দেশের পতাকা সবার উপরে। এটা অনেক বড় পাওয়া, অর্জন।

রাইজিংবিডি: সুযোগ-সুবিধার সীমাবদ্ধতার পরও আপনি যে নিবেদন দেখিয়েছেন, আপনার ভেতরে ভালো করার যে তাড়না…সেগুলোর রহস‌্য কী? উদ্দীপণা আসে কিভাবে?

মাবিয়া আক্তার সীমান্ত: এটা পুরোটাই নিজের কাছে। শুরুতে আমি ভাবতাম, যদি সহযোগীতা পাওয়া না যায় তাহলে আগানো যাবে না, জীবনে কিছু করতে পারে না। কিন্তু এখন দেখছি, নিজে থেকে কাজ করা যায়। আমি বুঝতে পারছি আমার প্রতিভা আছে। কিন্তু আমাকে কেউ সহযোগীতা করছে না, আমার প্রতিভা প্রমাণ করতে দিচ্ছে না। তার মানে তাদের ইচ্ছে নেই নয়তো হিংসা করছে। আমার মধ‌্যে প্রতিভা আছে। আমার ইচ্ছে আমি আগাবোই। কে দেখলি কি দেখল না, কে দিল কি দিল না সেটা জানার দরকার নেই। যখন আমি কোনো কিছু অর্জন করে আসি তখন সবাই ক্রেডিট নিতে আসে। আমি সব কিছুতে নিজের স্বার্থ দেখি। কারণ আমাকে তৈরি করার জন‌্য যে সহযোগীতার দরকার ছিল সেগুলো তো পাচ্ছি না। যেটা করছি নিজের চেষ্টায় করছি। এর অর্থ তো আমি নিজের জন‌্যই কাজটা করছি। তারা যদি আমাকে সহযোগীতা করতো তাহলে আমি তাদের কথাই ভাবতাম। যেহেতু নিজের চেষ্টায় করছি কৃতিত্ব সবটুকু নিজেকেই দেই।

রাইজিংবিডি: স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কষ্ট আছে, রাগ, ক্ষোভ আছে। পথ চলায় কখনো কি মাথায় এসেছে আপনাকে সহযোগীতা করার দায়িত্বটা দেশের। কিন্তু সংশ্লিষ্টরাই যখন করছে না তখন ছেড়ে দেই?

মাবিয়া আক্তার সীমান্ত: অবশ‌্যই এটা দেশের দায়িত্ব। কিন্তু আমি নিজের উদ‌্যোগে, নিজের স্বার্থে, নিজের ভালোবাসা, ভালোলাগা থেকে এতদূর এগিয়ে এসেছি। ওয়েটলিফটিং কিন্তু চাট্টেখানি কথা না। অনেকেরই ধারণা, ওয়েটলিফটিং শুধু ওজন উঠানো। দৈনিক তিন ঘণ্টা ওজন নিয়ে অনুশীলন করতে হয়। মানসিকভাবে শক্ত না হলে এ খেলা কোনোভাবেই সম্ভব না।

২০১৬ সালে স্বর্ণজয়ের পর আমার প্রথম চাওয়া ছিল একটা উন্নতমানের জিম। এটা আমাদের সরকার বলুন আর আমাদের ফেডারেশন বলুন এটা একদম সামান‌্য একটা বিষয়। যে খেলোয়াড়দের কাছ থেকে আমরা সাফল‌্য পেয়ে যাচ্ছি তাদের অর্জনের থেকে একটা উন্নতমানের জিম খুব সামান‌্য চাওয়া। এটা হলে আমরা অনেক উপকৃত হতাম। আমাদেরকে যতটুকু গাইড করছে তার থেকে বেশি গাইড করা উচিত ছিল।

রাইজিংবিডি: আপনি কি মনে করেন যদি ভালো একজন কোচের তত্ত্বাবধানে যেতেন তাহলে আপনার সাফল‌্যের সম্ভাবনা আরও যেত?

মাবিয়া আক্তার সীমান্ত: আমাকে যদি যথার্থ সুযোগ-সুবিধা এবং ঠিকমতো পরিচর্যা করা হয় তাহলে ভালো কিছুর আশা করতে পারি। কোচিং সুবিধার কথা যদি বলেন, বিদেশি কোচ নিয়ে আসতে হবে এমন কোনো কথা নেই। বিদেশি কোচ যে, সবকিছু বদলে দেয় এমনও কিন্তু না। আমরা দেশি কোচের কাছ থেকে সবকিছু শিখি। শুধু শেখার ধরনটা ভিন্ন থাকে। দেশি কোচের অধীনে যদি আমি দুইবার সাফ গেমসে স্বর্ণপদক পেতে পারি, কমনওয়েলথ গেমসে ১৫ জনের মধ্যে ষষ্ঠ স্থান অর্জন করতে পারি; তাহলে আমি বিশ্বাস করি আরও পরিচর্যা পেলে আমার পক্ষে ভালো করা সম্ভব।

রাইজিংবিডি: স্থানীয় কোচদের নিয়ে আপনার মূল‌্যায়ন কী?

মাবিয়া আক্তার সীমান্ত: আমি মনে করি, আমাদের যারা কোচ আছেন, খেলোয়াড়দের গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদের আরও সুযোগ সুবিধা দেওয়া উচিত। আপনি যদি দেখেন, আমাদের দেশি কোচদের কিন্তু সেই অর্থে মূল্যায়ন করা হয় না। শুধু বিদেশি কোচদের মূল্যায়ন করা হয়। তখন কোচরা কী করে? আমাদের খেলোয়াড়দেরকে কিন্তু দাবিয়ে রাখেন। তাদের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত এবং ভুল গণনায় আমরা পরবর্তী সময় সাফার করি।

রাইজিংবিডি: এখন প্রযুক্তির কারণে পৃথিবী হাতের মুঠোয়। আপনি নিজ থেকে অনলাইনে কোনো ভিডিও থেকে শেখার চেষ্টা করেছেন কখনো?

মাবিয়া আক্তার সীমান্ত: আমি কখনো কোনো ভারোত্তোলককে অনুসরণ করিনি। আমার ভারোত্তোলক হওয়ার পথে কেউ কখনো অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করেনি। আমি কোনো ভিডিও দেখে কিছু করিনি; আমি আমিই। আমি যখন এই খেলা শুরু করি তখন আমার কোচ আমাকে বলেছিলেন, একে অনুসরণ করো, ওর মতো করে কিছু করো, কিন্তু আমি কখনো কাউকে অনুসরণ করিনি। আমি আমার কোচের কথা শুনেছি। উনি আমাকে যেটা যেভাবে করতে বলেছিলেন, আমি সেটা সেভাবেই করেছি। আমি কোনো ভিডিও দেখে শিখিনি। আমি যেটা করি, সেটা নিজের থেকে করি। আরেকজনকে দেখে কেবল তাঁর মতন হওয়া যায়, নিজের মতন আর হওয়া যায় না।

রাইজিংবিডি: ক‌্যারিয়ার শেষে এমন কোন অর্জনটি চান যেটি পেলে আপনি নিজ থেকে সন্তুষ্ট হবেন?

মাবিয়া আক্তার সীমান্ত: আসলে এত স্বল্প সুযোগ সুবিধা পাই আমরা…আবার এই খেলাটাকে এখনো আড়চোখে দেখা হয়। তাই অনেক বড় স্বপ্ন আমার নেই। তারপরও যদি বলতে হয়, আমি বাংলাদেশের ইতিহাস গড়া কোন একজন ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব হতে চাই। অলিম্পিকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে চাই। আমি স্টেজে উঠে এটা শুনতে চাই, ‘মাবিয়া আক্তার রিপ্রেজেন্টিং বাংলাদেশ।’ তাহলেই আমি সার্থক। আমি বুঝবো, শুরু থেকে এই ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে আমার যে কষ্ট, যে সংগ্রাম করতে হয়েছে সবকিছু সফল। আমি এখন যে অবস্থায় আছি, এখান থেকে যদি আমি পরিপূর্ণ সমর্থন পেয়ে থাকি; তাহলে আমি আশা করি, আমি অলিম্পিকেও পদক জয় করতে পারবো।


ঢাকা/ইয়াসিন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়