ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

‘রঙ বাংলাদেশকে অনন্য ব্র্যান্ড হিসেবে দেখতে চাই’

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৫, ২ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৬:০০, ২ নভেম্বর ২০২০
‘রঙ বাংলাদেশকে অনন্য ব্র্যান্ড হিসেবে দেখতে চাই’

সৌমিক দাস। রঙ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী তিনি। ছোটবেলা কেটেছে মুন্সীগঞ্জের ইছাপুরা গ্রামে। ভর্তি হয়েছিলেন গ্রামের স্কুলে কিন্তু পড়াশোনা হয়নি। পরবর্তী সময়ে নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন। ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হন। নারায়ণগঞ্জ বার একাডেমি থেকে এসএসসি আর ঢাকা ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে। সেখান থেকেই স্নাতক (সম্মান) আর স্নাতকোত্তর শেষ করেন। চারুকলাতে প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করার সময় থেকেই 'হাতখরচের' টাকার জন্য টুকটাক কাজ শুরু করেন। সেই শুরু। তারপর রঙ নামক ফ্যাশন হাউজের সৃষ্টি। দেশজুড়ে অনেকগুলো শাখা। বেশ ভালোই চলছিল। এক সময় ঝড় ওঠে। রঙ ফ্যাশন হাউজের আরেক স্বত্বাধিকারীর সঙ্গে মতের অমিল। আলাদা হয়ে যান তারা। 'আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে'। সৌমিক দাস আলাদা করে শুরু করেন রঙ বাংলাদেশ নাম দিয়ে। রঙ এর সৃষ্টি, সফলতা, প্রতিকূলতা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা- এসব নিয়ে কথা বলেছেন রাইজিংবিডির সঙ্গে। কথোপকথনে  ছিলেন মেসবাহ য়াযাদ।

রাইজিংবিডি: দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ফ্যাশন হাউজ রঙ। এর শুরুটা নিশ্চয়ই সহজ ছিল না। শুরু গল্প জানতে চাই।
সৌমিক দাস:
সত্যি বলতে খুব পরিকল্পনা করে পরবর্তীতে দেশের অন্যতম ফ্যাশন হাউজে পরিণত হওয়া রঙ এর সৃষ্টি হয়নি। ১৯৯২-৯৩ সাল, চারুকলার ১ম বর্ষে পড়ি তখন। পড়াশুনা আর হাতখরচের জন্যে টুকটাক কাজ করতাম চারজন একসঙ্গে। অনুষ্ঠান ডেকোরেশনের কাজ। অন্যভাষায় ’খেপ’ও বলা যায়। এই কাজ করে নারায়ণগঞ্জ শহরে একটু নামডাক হওয়ায় মানুষ যোগাযোগের ঠিকানা জানতে চাইতো আমাদের কছে। সেই ঠিকানার প্রযোজনেই রঙ এর জন্ম।  এখনকার মতো মোবাইল ফোনের প্রচলন থাকলে রঙ প্রতিষ্ঠা পেত কি না- সেই প্রশ্ন করা অমূলক নয়। নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ার প্রায় বন্ধ থাকা সান্তনা মার্কেট। এর নিচতলায় ভিতরের এক কোণায় ১০ ফুট বাই ১০ ফুটের একটি দোকান নেই আমরা।  লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন। অনুষ্ঠান সাজানোর কাজ বছরের সব সময় না থাকায়, দোকানটিতে কিছু জিনিসপত্র বিক্রির জন্য রাখা হয়। ১৯৯৪ এর ২০ ডিসেম্বর সেই শুরু। প্রথমে অনুষ্ঠান সাজানোর সামগ্রী ছাড়াও চারুকলার স্যারের মাটির জিনিস ও কিছু বড় বোনের সহায়তায় পোশাক দিয়ে যাত্রা।

পরে ক্রেতার চাহিদা বাড়তে থাকলে আস্তে আস্তে নিজেদের ডিজাইন করা সামগ্রী উৎপাদন শুরু করি। এরপর নামডাক হতে থাকলে ১০০ স্কয়ার ফুট হতে আরো ২০০ তারপর আরও ৪০০ স্কয়ার ফুট হয়ে গেলো দোকানের পরিসর। নিঃস্বার্থ সমর্থন পেয়েছি আমাদের বন্ধুবান্ধব আর টাঙ্গাইলের শ্রদ্ধেয় তাঁতশিল্পীদের। এরপর সময়ের সাথে সাথে রঙ এর কর্মক্ষেত্রের পরিধি বাড়ে। অনেকেই যুক্ত হন রঙয়ের সাথে। সময় পরিক্রমায় ধীরে ধীরে ঢাকা হয়ে দেশের নানান শহরে ছড়িয়ে পড়ে রঙ। দেশের অন্যতম ফ্যাশন উদ্যোগ বলে পরিচিতি লাভ করে। আমাদের চারজন মানে বিপ্লব সাহা, মামুন আল কবীর, জাকিরুল হায়দার বাবু আর আমি।  মাঝে মামুন আর বাবু প্রবাসী হয়ে যায়।  বিপ্লব সাহা আর আমি চালিয়ে যাচ্ছিলাম রঙ এর পথ পরিক্রমা। ২০১৫তে এসে কিছুটা ছন্দপতন ঘটে। তারপর পরিস্থিতির বাস্তবতায় বাধ্য হয়েই একলা পথচলা শুরু আমার। রঙ থেকে রঙ বাংলাদেশ এর জন্ম।

রাইজিংবিডি: শুরু থেকে সারা দেশে অবিভক্ত রঙ এর শাখা কয়টি ছিল? বর্তমানে রঙ বাংলাদেশের শাখা কয়টি, সেগুলির অবস্থান?
সৌমিক দাস:
শুরুটা ছোট একটা শোরুম দিয়ে। পরবর্তী সময়ে, দুই দশকে সারাদেশে ১৬টি শোরুম হয় রঙ এর। বিভাজনের পর বর্তমানে রঙ বাংলাদেশ-এর ২৬টি শোরুম দেশজুড়ে। নারায়ণগঞ্জ ছাড়াও ঢাকায় ৮টি, ময়মনসিংহে ২টি, চট্টগ্রাম, সিলেট, বগুড়া, রাজশাহী, খুলনা, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া, ঈশ্বরদী, ফেনী, ব্রাম্মণবাড়িয়া, নেত্রকোণা, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মাদারীপুরে ১টি করে শোরুম রয়েছে। এর মাঝে সম্মিলিত ব্যবস্থাপনায় বিপণনের অনন্য উদ্যোগ দেশী দশ প্লাটফর্মের সাথে যুক্ত রয়েছে ৫টি শোরুম।

রাইজিংবিডি: রঙ আলাদা হয়ে রঙ বাংলাদেশ আর বিশ্বরঙ হলো।  আলাদা হওয়ার পর বর্তমান রঙ বাংলাদেশ এর সার্বিক অবস্থা নিয়ে বলুন।
সৌমিক দাস:
যেকোনো প্রতিষ্ঠান বিভাজনের পর নতুন করে গঠন করা সত্যিই অনেক কঠিন কাজ।  পরিকল্পনা, ডিজাইন টিম, উৎপাদন, স্টক, বিক্রয়সহ সব কার্যক্ষেত্র নতুন করে গোছাতে হয়েছে। সে কাজটা সঠিকপথে এগিয়ে নিতে  একদল অন্তপ্রাণ সহকর্মীর প্রচেষ্টার কমতি ছিল না। এছাড়া স্বজন-শুভানুধ্যায়ী-উৎপাদন সহযোগীদের নিরন্তর সমর্থন, পৃষ্ঠপোষকতা ও শুভকামনা পথটা অনেক সহজ করে দিয়েছে।  বিভাজনের সময়ের ৮টি শোরুম থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরে নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সারা দেশে ২৬টি শোরুম হয়েছে। অনলাইন প্লাটফর্মও গড়ে উঠেছে সঠিক ব্যবস্থাপনায়।

রাইজিংবিডি: রঙ আর রঙ বাংলাদেশ- দুটো প্রতিষ্ঠানের রয়েছে অনেক সফলতা। ব্যর্থতার কথা যদি বলেন-
সৌমিক দাস:
রঙ বাংলাদেশ আলাদা পথচলায় গত পাঁচ বছরে স্বতন্ত্র আইডেন্টিটি দাঁড় করাতে পেরেছে। কনসেপ্ট, ডিজাইন, কোয়ালিটিতে যথেষ্ট সাড়া জাগিয়েছে ফ্যাশন সচেতন ক্রেতা মহলে। প্রথম থেকেই এই প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট থিমভিত্তিক সামগ্রী তৈরি করে আসছে প্রতিটি উৎসবের জন্যে। আমাদের মূল ব্র্যান্ড রঙ বাংলদেশ এর পাশাপাশি চারটি আলাদা সাব ব্র্যান্ড গড়ে তুলেছে ক্রেতাদের জন্য। পরিবার-সমাজের শ্রদ্ধাভাজন গুরুজনদের জন্যে 'শ্রদ্ধাঞ্জলি', তারুণ‌্যের পছন্দ নিয়ে ’ওয়েস্ট রঙ’, শিশু কিশোরদের জন্যে ’রঙ জুনিয়র’ আর স্বদেশভূমির ব্র্যান্ডিং সংকল্পে ’আমার বাংলাদেশ’। এই চারটি সাব ব্র্যান্ড ইতিমধ্যে ফ্যাশন  জগতে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে। নতুন আইডিয়া অনেক সময় ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক না হলেও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে আয়োজন রেখেছে 'রঙ বাংলাদেশ'। 

রাইজিংবিডি: ব্যবসা চালাতে গিয়ে কী কী সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন?
সৌমিক দাস:
দেশীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির জন্যে দেশ এখনও ব্যবসাবান্ধব হয়ে উঠেনি।  যেকোনো দেশের শিল্প উন্নয়নে সরকারি সংস্থা ও ব্যাংকিং সেক্টর অনেক সহায়ক হয়।  যেটা আমাদের দেশে অনুপস্থিত।  এমনকি আমাদের সেক্টরটি এখনও সরকারিভাবে নির্দিষ্ট করা হয়নি। বরং অসচেতনতার সুযোগে প্রতিনিয়ত বিদেশি সামগ্রীর সহজলভ্যতা ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিপরীতে নানান প্রতিকূলতার সঙ্গে দেশীয় ঐতিহ্য নিয়ে লড়াই করে টিকে থাকতে হচ্ছে।

রাইজিংবিডি: রঙ বাংলাদেশ এর কর্মী সংখ্যা কতজন?
সৌমিক দাস:
বর্তমানে কর্মী সংখ্যা ২০০ জন।  এছাড়াও উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রায় ২০০০ জন।

রাইজিংবিডি: রঙ বাংলাদেশ নিয়ে আপনার স্বপ্ন?
সৌমিক দাস:
দেশীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় অনন্য ব্র্যান্ড হিসেবে দেখার স্বপ্ন আমার।  পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে- শ্রদ্ধাঞ্জলি, ওয়েস্ট রঙ, রঙ জুনিয়র ও আমার বাংলাদেশ-সাব ব্র্যান্ডগুলোকে নিজস্ব আইডেন্টিটি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। দেশের সব মানুষের কাছে রঙ বাংলাদেশ এর সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া। দেশের বাইরে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টাও রয়েছে পরিকল্পনায়।

রাইজিংবিডি: সময়ের প্রয়োজনে কিন্তু অভিজ্ঞতা ছাড়াই অনেকে এ পেশায় আসতে চাচ্ছেন। অনেকে অনলাইনেও শুরু করেছেন।  নতুনদের জন্য আপনার পরামর্শ-
সৌমিক দাস:
আমরা উদ্যোক্তা হয়েছি সৌখিন ভাবনা নিয়ে। পরে অনেক মানুষের জীবিকা-জীবনধারণ আমাদের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। সেটা আমাদের দায়িত্ববান করে তুলেছে। সচেতন উদ্যোক্তা হিসেবে ভাবতে শিখিয়েছে। আমরা কাজ করতে করতে শিখেছি। এখনও প্রতিনিয়ত শিখছি। আমাদের সময়ে এই ধরনের উদ্যোক্তাও সে পরিমাণে ছিল না।  নতুন উদ্যোক্তাদের বলবো, অবশ্যই  তৈরি হয়ে নামতে হবে। প্রচুর গবেষণা করার বিকল্প নেই। ইউনিক আইডিয়া ছাড়া জায়গা করে নেওয়া একটু কঠিন হবে। আর পরিশ্রম করার কোনো বিকল্প নেই।

রাইজিংবিডি: অনলাইন ভিত্তি করে যারা করোনাকালীন সময়ে এ ব্যবসায় আসছেন, তাদের পোশাকের মান, ডিজাইন আর মূল্য নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে ক্রেতাদের।  এ বিষয়ে আপনার ভাবনা কী? 
সৌমিক দাস:
অনলাইন ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছানোর আলাদা সহজ মাধ্যম হিসেবে গড়ে উঠেছে।  যা এই করোনাকালে আরও  শক্তিশালী হয়েছে।  আমাদেরও অনলাইন প্লাটফর্ম রয়েছে।  দেশের নানান জায়গায়, যেখানে আমাদের শোরুম নেই এবং বিদেশে ক্রেতার কাছে সামগ্রী বিপণনে এর বিকল্প নেই।  কিন্তু এক্ষেত্রে বিপণন সহজ হলেও আস্থার জায়গা তৈরির জন্যে উদ্যোক্তাদের আরও অনেক সচেতন হতে হবে। 

রাইজিংবিডি: করোনার কারণে বর্তমানে এ শিল্পের ভবিষ্যৎ কী?
সৌমিক দাস:
করোনাকালে দেশীয় পোশাকশিল্প বিপর্যরের মুখোমুখী।  আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দুটো বড় উৎসব বৈশাখ আর ঈদ।  করোনার জন্য ব্যবসা পুরো বন্ধ ছিল। যে কারণে সব খরচ দিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই কঠিন। ইতোমধ্যে দেশীয় পোশাকের অনেক ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে বা হওয়ার পথে। তাদের উৎপাদন সহযোগীদেরও একই অবস্থা। এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আছেন- হাজার হাজার মানুষ। পরোক্ষভাবে এসব পরিবারের লাখ লাখ সদস্য।  প্রচুর বানানো স্টক জমে থাকায় নতুন করে কাজের সুযোগও কমে গেছে। এই প্রেক্ষিতে দেশীয় শিল্পকে বাঁচাতে এবং উঠে দাঁড়াতে সহায়তা প্রয়োজন। ক্রেতারা যদি অন্তত: আরো ২/৩ বছর দেশীয়পণ্য ব্যবহার করেন- তাহলে এই শিল্প বাঁচবে, দেশ বাঁচবে। সবশেষে ভলোবেসে সবার প্রতি বিনীত অনুরোধ, দেশকে ভালোবাসুন।  দেশীয় শিল্পকে বাঁচান।

মেসবাহ/সাইফ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়