ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

করোনা সনদ নিয়ে দৈনিক লাখ টাকার বাণিজ্য!

কাঞ্চন কুমার, কুষ্টিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:০৯, ২৫ অক্টোবর ২০২০  
করোনা সনদ নিয়ে দৈনিক লাখ টাকার বাণিজ্য!

সারা দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় হাসপাতাল ও চিকিৎসকরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেও কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিত্র ভিন্ন। এখানে কিছু অসাধু চিকিৎসক-কর্মচারী ও রাজনীতিক মিলে খুলেছেন করোনার সনদের দোকান। অভিযোগ উঠেছে, এ স্বাস্থ‌্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন লাখ টাকার সনদ বাণিজ‌্য হয়।

৫০ শয্যা বিশিষ্ট ভেড়ামারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আছে প্রায় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। তবে স্বাস্থ‌্যসেবা ও খাবারের মান এবং পরিবেশ সন্তোষজনক নয়। সেই সঙ্গে আছে ওষুধ ও করোনা সনদ বাণিজ্যের অভিযোগ। সরেজমিনে গিয়ে এসব অভিযোগের সত‌্যতা পাওয়া গেছে।

একটি শক্তিশালী চক্র ওষুধ ও সনদ বাণিজ‌্য নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের ভয়ে হাসপাতালের কেউ প্রতিবাদ করতে পারেন না।

ভেড়ামারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগে ঘুরে দেখা যায়, সেখানে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। অনেকের হাতেই দেখা যায় করোনা সনদ। 

 জানা যায়, পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় করোনা নেগেটিভ সনদ। তাই চাকরিপ্রত‌্যাশীরা এ সনদ জোগাড় করতে হন‌্যে হয়ে ঘুরছেন। সনদের ওপর সিল মেরে নিতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভিড় করছেন তারা। তাদের মধ্যে এমন লোকও আছেন, তিনি নমুনা কোথায় দিয়েছেন, তাও জানেন না।

করোনা মোকাবিলায় ভেড়ামারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পক্ষ থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, অনেকে নমুনা না দিয়ে শুধু জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি দিয়েই করোনার সনদ নিয়েছেন। করোনা নেগেটিভ সনদের চাহিদা থাকায় প্রতিদিনই লক্ষাধিক টাকার বাণিজ্য চলে এই স্বাস্থ‌্য কমপ্লেক্সে।

হাসপাতালে ভর্তি একাধিক রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাসপাতালে শুধু ব‌্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়। প্রায় সব ওষুধই বাইরে থেকে কিনতে হয়। খাবার তো কেউই খেতে পারে না। বেশিরভাগ রোগীই হাসপাতালের খাবার খান না।

হাসপাতালের রান্না ঘরে গিয়ে দেখা যায়, ৩০ জন রোগীর জন‌্য ৫০০ গ্রাম আলু, দুই-তিন কেজি চাল, একটি লাউ ও মাছ দিয়ে খাবার তৈরি করা হচ্ছে। রান্না ঘরে নেই বাবুর্চি। আউট সোর্সিং প্রদ্ধতিতে এক নারী রান্নার কাজ করেন। তিনিও নাকি বেতন পান না।

ওই নারী বলেন, ‘খাবারে মরিচ-লবণ কম দেওয়ার নির্দেশনা আছে। রোগীরা খাবার নিতে না চাইলে বেশি রান্না করে কী লাভ? এ খাবারেই হয়ে যাবে।’

ভেড়ামারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছেলেকে ভর্তি করে বিপাকে পড়েছেন রাইটা নতুন পাড়ার দিনমজুর তৌহিদুল। তিনি বলেন, ‘সরকারি হাসপাতাল তো না, এটা ডাকাতের ঘর। পদে পদে টাকা দিতে হয়। টাকা ছাড়া কেউ কোনো কাজ করে না।’

করোনা সনদ নিতে আসা সোহাগ আলী জানান, তিনি হাসপাতালের কমিউনিটি হেলথকেয়ার সার্ভিস প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) সুমনের কাছে নমুনা দিয়েছেন। তাকে করোনা নেগেটিভ সনদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তারা এ সনদ গ্রহণ করেননি। কারণ, এতে করোনা রেজাল্টের বারকোড নেই। তার নামের বানানও ভুল করা হয়েছে।

সোহাগ নামের বানান ঠিক করার জন্য যান পরিসংখ্যান কর্মকর্তা আতিয়ার রহমানের কাছে। মুহূর্তেই সুমনের নির্দেশে বানান সংশোধন করে দেওয়া হয়। সোহাগ সেটা স্বাক্ষর করানোর জন্য যান বহির্বিভাগে। সেখানে হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) আছেন শুধু করোনা সনদে স্বাক্ষর করার জন্য।

এরকম শতাধিক লোক বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছেন করোনা সনদ নেওয়ার জন্য।

সাধারণ মানুষের অভিযোগ, এ হাসাপাতালে সনদ বাণিজ‌্যের মূল হোতা জাসদের এক প্রভাবশালী নেতা। এর সঙ্গে সিএইচসিপি, পরিসংখ্যান কর্মকর্তা, আরএমও এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাও জড়িত। 

তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ভেড়ামারা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. নুরুল আমীন। তিনি বলেন, ‘আমরা বিশেষ দল গঠন করে রোগীদের বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহ করছি। এছাড়া, হাসপাতালে টেলিমেডিসিন সেবাও চালু রয়েছে। এতে রোগীরা বেশ সুবিধা পাচ্ছেন।’

তিনি দাবি করেন, সরকারি ওষুধ রোগীদের সঠিকভাবে দেওয়া হয়। খাবারের মানও ভালো। সরকারি বরাদ্দ অনুযায়ী খাবার দেওয়া হয়। প্রতিদিন এখানে গড়ে ৪০০ রোগী আসেন। চিকিৎসরা আন্তরিকভাবে চিকিৎসা দেন।

চিকিৎসক সংকটের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এ হাসপতালে ১১টি পদের বিপরীতে একটি পদে পদায়ন করা হয়েছে। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর পদ ফাঁকা। ফলে কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারছি না।’

ডা. মো. নুরুল আমীন বলেন, ‘করোনা সনদ জালিয়াতির সুযোগ নেই। অর্থের বিনিময়ে সনদ দেওয়ার লিখিত অভিযোগ পেলে, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ভেড়ামারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহেল মারুফ জানান, ‘করোনা সনদ নিয়ে জালিয়াতি বা অনিয়মের অভিযোগ পেলে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।’

ভেড়ামারা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামান মিঠু জানান, ‘হাসপাতালে অনিয়ম ও করোনা সনদ নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলেই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কুষ্টিয়া/কাঞ্চন/রফিক 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়