ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

সংকটে জীবন-জীবিকা, বিকল্পের সন্ধানে মুণ্ডারা

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান, খুলনা  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:১৯, ২০ অক্টোবর ২০২১  
সংকটে জীবন-জীবিকা, বিকল্পের সন্ধানে মুণ্ডারা

মাথায় করে কাঠ বহন করছেন মুণ্ডা বৃদ্ধা

সুন্দরবনের কোলঘেঁষা খুলনার কয়রা উপজেলার ৬নং কয়রার টেপাখালী গ্রামের বেড়িবাঁধে আদিবাসী মুণ্ডাদের বসবাস। এখানে বাস করে ৪২ ঘর মুণ্ডা, যারা মূলত কৃষিজীবী। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি জমি কমে যাওয়ায় বর্তমানে মুণ্ডাদের পেশাতেও আসছে পরিবর্তন। ইটভাটা শ্রমিকের কষ্টকর কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে তারা। অনেকেই জমি-ভিটে বেচে এলাকা ছাড়ছেন। 

শুধু টেপাখালী গ্রামেই নয়, আশপাশের সব মুণ্ডা বসতিতেও দেখা মিলবে একই চিত্রের। খুলনা ও সাতক্ষীরার বিভিন্ন উপজেলার ৩০টি গ্রামে মুণ্ডারা বসবাস করে। এরা নিজেদের ‘হোরোকো’ বলে থাকে, যার অর্থ মানুষ। 

টেপাখালীর বেড়িবাঁধে দাঁড়িয়ে কথা হয় গণেশ মুণ্ডার সঙ্গে। মাঠে ধান কাটার কাজ করছিলেন তিনি। হাত-পায়ে কাদা নিয়েই তিনি এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন নিজেদের জীবন-জীবিকা নিয়ে।  

পেশায় গ্রাম পুলিশ গণেশ মুণ্ডা জানান, তাদের পূর্ব পুরুষ বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে জমি বানিয়ে এই এলাকায় বসবাস শুরু করেন। এক সময় তাদের প্রতিটি পরিবারেরই পর্যাপ্ত জমি ছিল। কিন্তু প্রভাবশালীরা ছলচাতুরী করে সেসব জমি দখলে নিয়েছেন। অনেকে অভাবের কারণে জমি বেচে দিয়েছেন। এখন অধিকাংশ মুণ্ডা পরিবারই হয় ভূমিহীন অথবা শুধু মাথা গোঁজার মতো বসতির অধিকারী। এক পুরুষ আগেও তাদের ১৬ বিঘা জমি ছিল। এখন আছে শুধুই ভিটে। 

তিনি বলেন, এখন তারা এক কুড়ি (২০ মুঠি) ধানছড়া কাটলে বিনিময়ে দুই মুঠি ধানছড়া পান। এক বেলায় কাটতে পারেন সাত কুড়ি ধানছড়া। এতে ১৪ মুঠি ধানছড়া মেলে, যাতে তাদের হিসাবে ৬-৭ পালি (মাপার পাত্র বিশেষ) ধান পাওয়া যায়। কেজি হিসাবে এর পরিমাণ ২০-২২ কেজি। মাঠে এই কাজের সুযোগ মেলে বছরে পাঁচ-ছয় মাস। বাকি সময় তারা বলতে গেলে বেকার থাকেন। জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে বিভিন্ন জীবিকার সন্ধানে নামছেন মুণ্ডারা। ইটভাটায় শ্রমিক হিসেবেও কাজ করছেন অসংখ্য মুণ্ডা। 

টেপাখালীর মুণ্ডাপাড়া ঘুরে দেখা যায়, কর্মক্ষম সদস্যরা কাজে গেছেন। পাড়ার বেশিরভাগ নারী মাঠের কাজে ব্যস্ত। বাড়ির পুরুষরা কয়েক মাসের জন্য চুক্তিতে ইটভাটার কাজে যাচ্ছেন। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইটভাটার কাজ থাকলে মহাজনদের কাছ থেকে অগ্রিম ২০-৩০ হাজার টাকা নেয় মুণ্ডারা। পরে ভাটার মৌসুমে পাঁচ-ছয় মাসের জন্য শ্রমিক হিসেবে কাজ করে তা পরিশোধ করে। অনেকে কিছু টাকা জমিয়ে বাড়িতে পাঠায়। 

উত্তর বেতকাশীর মাঝেরআইট গ্রামের শ্যামসুন্দর মুণ্ডা জানান, ভাটার মৌসুম শুরুর আগে প্রায় একমাস ধরে প্রতিদিন বাস ভরে শ্রমিকরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছুটে যান ইট বানানোর কাজ করতে। মুণ্ডাদের মধ্যে শিক্ষার হার খুব কম। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অংশগ্রহণ পড়াশোনায় বেশি। অধিকাংশ মুণ্ডা ছেলেমেয়েই পড়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। 

এ বিষয়ে কয়রা সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী সুমিলা মুণ্ডা বলেন, প্রথমত সচেতনতার অভাবে শিক্ষার প্রসার কম। মনে করা হয়, পড়ার চেয়ে মাঠে কাজ করলে রোজগার বেশি হবে। এ ছাড়া পরিবারের বড় সদস্যরা বাইরের কাজে ব্যস্ত থাকায় সন্তানদের পড়াশোনার খোঁজ নেওয়ার কেউ থাকে না। তারা ঠিকমতো বিদ্যালয়েও যান না। শিক্ষার হার কম হওয়ায় বিচিত্রমুখী পেশায় মুণ্ডাদের অংশগ্রহণ কম। 

স্থানীয়রা জানান, আইলা ও সিডরের পর পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। কয়রার উত্তর বেতকাশী গ্রামে এমন কয়েক ঘর মুণ্ডার খোঁজ মিললো, যারা সপরিবারে অন্যত্রে চলে গেছে। মুণ্ডাদের জীবন-জীবিকার এমন দুর্দশায়ও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাহায্য-সহযোগিতা মিললেও জীবনের টেকসই উন্নয়নের জন্য কেউ সেভাবে এগিয়ে আসছেন না। 

কয়েকজন মুণ্ডা জানান, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে হাতেগোনা কজন বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতা পান। চাকরিতে কোটা প্রথা থাকলেও অধিকাংশ সময় তাদের সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভূমিহীন হওয়ায় এনজিওগুলোও তাদের ঋণ দিতে চায় না। 

মুণ্ডাদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা কয়রার বেসরকারি সংস্থা আইসিডি’র প্রতিষ্ঠাতা আশিকুজ্জামান আশিক বলেন, মুণ্ডাদের প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে খাদ্য, জীবিকা, পানি ও শিক্ষার সুযোগ। এরা কৃষিভিত্তিক কাজে অভ্যস্ত। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাদের সে সুযোগ কমে আসছে। এজন্য এখন প্রয়োজন টেকসই বিকল্প জীবিকার খোঁজ।

তিনি জানান, বিকল্প জীবিকায় মুণ্ডাদের উৎসাহিত করতে তারা কয়েকটি পরিবারকে নৌকা দিয়ে উৎসাহিত করার উদ্যোগ নেন। এ ছাড়াও তাদের নিয়ে গরুর গোবর থেকে কেঁচো সার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। 

কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, কয়রার আদিবাসী মুণ্ডা ও মাহাতো পরিবারের সদস্যদেরকে স্বাবলম্বী করার জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে তাদেরকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। 

/এনএইচ/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়