ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মা জেলে থাকায় পড়ালেখা বন্ধ শিশুদের

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মা জেলে থাকায় পড়ালেখা বন্ধ শিশুদের

সুমাইয়ার অপলক দৃষ্টি। ভয়-আতঙ্কে জড়সড় অবুঝ শিশু ওসমানেরও মাকে খোঁজার আকুতি বিফলে গেল। অনেক মানুষের ভীড় ঠেলে মাকে দেখার স্বাদ পূর্ণ হয়নি। মাকে না দেখে শিশু ওসমান বার বার বোনের কাছে জানতে চায়, মা কই? অসহায় শায়লাও নিরুত্তর। ছোট ভাইকে বুকে জড়িয়ে নেন শায়লা।

মায়ের জন্য কান্না, আকুতি আর অপেক্ষার অবসান তো হলোই না উল্টো ছোট ভাই-বোনদের কান্না থামাতে হিমশিম খেতে হয় বোন শায়লাকে। শায়লাও শিশু, বয়স মাত্র ১১। তার ছোট ভাই ওসমান, বয়স মাত্র ৫ আর ছোট বোন সুমাইয়ার যার বয়স ৭। তিন ভাই-বোনের অসহায়ত্ব আদালতের পরিবেশকে মায়ার জালে আচ্ছন্ন করে তোলে । মায়া দিয়ে তো আর সব হয় না। বাস্তবতার নিষ্ঠুরতায় কখনো কখনো মানুষ হতভম্ব হয়ে পড়ে। তেমনি একটি ঘটনার সাক্ষী এই প্রতিবেদক ।

সম্প্রতি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বারান্দায় দেখা মেলে ওই তিন শিশুর। মাকে দেখে না মাসের পর মাস। মায়ের আদর পেতে ব্যাকুল ওসমান ও সুমাইয়া। তাদের মা জেলে বন্দি ৯ মাসের বেশি সময় ধরে। মায়ের ছোঁয়া পেতে ও তাকে দেখতে আদালতে ছুটে আসে তারা। কিন্তু ভাগ্য তাদের সহায় হয়নি। এদিন তাদের মাকে আদালতে আনার খবরে ছুটে আসে। কিন্তু তাকে আনা হয়নি। মাকে না দেখে হাউ মাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে ওসমান ও সুমাইয়া। তাদের কান্না দেখে অনেক বিচারপ্রার্থীদের চোখের পানি টলমল করে। এসময় অনেকে তাদের সান্ত্বনা দেন।   

জানা যায়, মা যখন তাদের সঙ্গে ছিলেন তখন সুমাইয়া ও শায়লা স্কুলে যেত। আর ওসমান সারাক্ষণ মায়ের কাছেই থাকতো। মায়ের স্বপ্ন ছিল ওসমানকে নিয়েই। কখনো চোখের আড়াল হতে দিতেন না। ওসমান দুষ্টুমিও করতো বেশ। এখন তাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ। খাওয়া-দাওয়ারও ঠিক নেই। কোন রকমে নানা-নানীর কাছে মানবেতর দিন যাপন করছে। সুমাইয়া ও ওসমান সব সময় মায়ের জন্য কান্নাকাটি করে।

শায়লা (১১) বলেন, আমার আম্মু নির্দোষ। যেদিন আম্মুকে ধরে নিয়ে যায় সেদিন আমি আমার আম্মুর সাথে আমি ঘরের ভেতর বসা ছিলাম। ওইদিন আম্মুকে নাম ধরে একজন ডেকে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়। এরপর আম্মুকে বলে, ‘তুই নাকি মাদক ব্যবসায়ী। তোর বাড়িতে মাদক আছে আমরা তোকে সার্চ করবো।’

সার্চ করার নাম করে আম্মুকে ওরা ধরে নিয়ে গেল। গত ৮ মাস ধরে মা জেলে রয়েছে। আম্মুর বান্ধবী কাকলি, আঁখি, ও আঁখি খালার স্বামী আসলাম আমার আম্মুকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।

আম্মুকে যখন মহিলা পুলিশ তল্লাশি করে তখন আমি নিজের চোখে দেখেছি তারা একটা চটের ব্যাগের মধ্যে তিন বোতল মদ রাখছিলো। এরপর ওই মদ আম্মুর রেখেছে বলে পুলিশ ধরে নিয়ে গেলো। 

পরিবারের এখন কী অবস্থা সেই বিষয়ে শায়লা বলেন, আমার একটা বড় ভাই আছে। নাম শাকিল। আম্মু কারাগারে যাওয়ার পর থেকে আমার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আর পড়িনা। আমরা চার ভাই বোন কেউই পড়ালেখা করি না।

বড়ভাই শাকিল প্রসঙ্গে শায়লা বলেন, ভাইয়ের হাতে সমস্যা রয়েছে। সে ঠিকমত কাজ করতে পারেনা। নানা-নানী কোনভাবে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে । মাঝে মধ্যে আম্মুর কথা খুব মনে পড়ে। যখন মনে পড়ে তখন খুব কান্না পায়। এছাড়াও আমার ছোট দুই ভাইবোন ‘আম্মুর কাছে যাবে, আম্মু কই,’ বলে কান্না করে।

আজ ৮ মাসের বেশি হল আম্মুর কাছে যেতে পারিনি। ছোট-ভাই বোনদের কোন কিছু বলে বুঝানো যাচ্ছে না। মাঝে মধ্যে নানা-নানী ওদের বুঝাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

আদালতে তিন ভাই বোন গিয়েছিলাম আম্মুকে দেখতে। আদালত যাওয়ার পর শুনছি তাকে নাকি আনা হবে না। তাই আম্মুকে না দেখেই আবার ফিরে যেতে হবে।

উল্লেখ্য, গত ২১ মার্চ পুলিশ খবর পায় ভাসানটেক থানাধীন ১ নং বস্তির মজুমদারের মোড় সংলগ্ন আসামি বেগমের বসত ঘরের সামনে গলি রাস্তার ওপর নেশাজাতীয় দ্রব্য বিক্রয় করছে। পরে সেখানে অভিযান চালিয়ে বেগমের কাছ থেকে সাদা পলিথিনে রক্ষিত একশ গ্রাম নেশাজাতীয় মাদকদ্রব্য কথিত লুজ হেরোইন এবং তার মা জোলেখা বেগমের কাছে থাকা প্ল্যাস্টিকের ব্যাগ থেকে ২১ বোতল নেশাজাতীয় মাদকদ্রব্য চোলাই বাংলা মদ পাওয়া যায়। যার মূল্য ১ লাখ সাত হাজার ৮শ টাকা।

এ ঘটনায় ওইদিনই ভাসানটেক থানার এসআই রুহুল আমিন হাওলাদার মা-মেয়ের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। বর্তমানে জোলেখা বেগম জামিনে আছেন। মামলাটি তদন্ত করে ভাসানটেক থানার সাব-ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) রবিউল আউয়াল ৩০ এপ্রিল আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন।



ঢাকা/মামুন খান/জেনিস

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়