ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মুসকান হত্যা : নেপথ্যে টাকা ধার নাকি পরকীয়া!

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫৯, ১৩ মে ২০২২   আপডেট: ১৪:৪৯, ১৩ মে ২০২২
মুসকান হত্যা : নেপথ্যে টাকা ধার নাকি পরকীয়া!

জাহাঙ্গীর হোসেন ত্রিশ বছর বয়সেই তিনবার বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। এক স্ত্রী চলে গেলেও দুই জনের সাথে বসবাস করেন। একজনকে কাছে রাখেন, অন্যজন গ্রামে।  

গার্মেন্টসে চাকরির সুবাধে অনেক মেয়ের সাথে তার কথাবার্তা হয়। আর এভাবেই সহকর্মী শাহিনা আক্তার ওরফে মুসকানের সাথে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। স্ত্রীর অসুস্থতার কথা বলে মুসকানের কাছ থেকে টাকাও ধার নেয়। তবে মুসকানের উপরও তার লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। আর এতেই ঘটে নির্মম এক ঘটনা। ৫ এপ্রিল কৌশলে মুসকানকে নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকা থেকে ফোন করে যাত্রাবাড়ির মাতুয়াইল এলাকার একটি বাসায় নিয়ে আসে। বন্ধ ঘরে মুসকানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে জাহাঙ্গীর। ঘটনার এক পর্যায়ে মুসকান জাহাঙ্গীরের পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলে। সেই অবস্থায় ঘাতক জাহাঙ্গীর মুসকানকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে।  

এঘটনায় ওই দিনই মুসকানের স্বামী রুহুল আমিন জাহাঙ্গীরকে আসামি করে যাত্রাবাড়ি থানায় মামলা রুজু হয়। মামলাটি তদন্ত করছে যাত্রাবাড়ি থানা পুলিশ। পুলিশের ধারণা, পরকীয়ার জেরে হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। তবে মুসকানের স্বামী দাবি করছেন, টাকা না দিতে জাহাঙ্গীর মুসকানকে হত্যা করেছে।

জাহাঙ্গীর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। পুলিশ বলছে, এ অবস্থায় আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়নি। চিকিৎসা শেষে সুস্থ হলে ঘটনার আসল রহস্য জানা যাবে।

ঘটনার পরদিনই চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর হোসেনকে হাজতী পরোয়ানা জারির আবেদন করে পুলিশ। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান আসামিকে পুলিশ পাহারায় সুচিকিৎসা গ্রহণে তদন্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। চিকিৎসা শেষে সুস্থতা সাপেক্ষে হাসপাতালের ছাড়পত্রসহ তাকে আদালতে হাজির করে হাজতী পরোয়ানা জারি করেন। আগামি ১৬ জুন মামলাটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ধার্য রয়েছে।

মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে মুসকানের স্বামী রুহুল আমিন বলেন,‘আমার স্ত্রী মুসকান এবং আসামি জাহাঙ্গীর হোসেন একই গার্মেন্টসে চাকরি করতো। জাহাঙ্গীরের তিন বিয়ে। এক স্ত্রীর মেরুদন্ডে সমস্যা দেখা দেয়। ৪/৫ মাস আগে সে আমার স্ত্রীর কাছে টাকা চায়। বলে বেতন বোনাস পেলে দিয়ে দিবে। আমার স্ত্রী সরল বিশ্বাসে তাকে ৩৫ হাজার টাকা দেয়। কিন্তু সে আর টাকা ফেরত দেয় না। আমি মদনপুর অলিম্পিক কোম্পানিতে চাকরি করি। ৫ এপ্রিল আমার ডিউটি শুরু হয়। সকালে আমি বাসা থেকে বের হয়ে যাই।’

তিনি বলেন, ‘ঘটনার পর শুনেছি মাতুয়াইলের ওই বাসা থেকে মুসকানকে একজন ফোন দেয়। মুসকান আমার আম্মাকে বলে পরিচিত একজনের বাসায় যাচ্ছে। সেখানে জাহাঙ্গীর যে আছে তা সে জানতো না। ভিতরে ঢুকলে ওই বাসার একজন বাইরে দিয়ে দরজা লক করে দেয়। শুনেছি ওই লোকের নাম মামুন।’

তাদের মধ্যে পরকীয়ার সম্পর্ক ছিল না কি এমন প্রশ্নে রুহুল আমিন বলেন, ‘কখনো সে আমার সাথে ঝগড়া বা খারাপ ব্যবহার করতো না।  মোবাইলেও কারো সাথে ওইভাবে কথা বলতে দেখিনি। যদি তাদের মধ্যে পরকীয়ার সম্পর্ক থাকতো তাহলে কেন ওই বাসায় ধস্তাধ্বস্তি হবে। হাতাহাতি, মারামারি, খুনের ঘটনা ঘটবে। দুইজন মানুষ যদি রাজি থাকতো তাহলে তো কোনো অঘটন ঘটতো না। দেখছেন, কোনো মেয়ে পুরুষের কাছে যায় বা ডাকে? পুরুষরাই মেয়ে মানুষের কাছে যায়। আল্লাহ জানে কি হয়েছে। তবে এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই। বিচার না পেলে জাহাঙ্গীর আরও মেয়ের সাথে এ ধরনের ঘটনা ঘটাবে।’

রুহুল আমিন ও মুসকানের তিন বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। ঘুরে ফিরে শুধু মাকে খুঁজছে মেয়ে নুসাইবা। কান্নাকাটি করছে। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

মেয়েকে নিয়ে রুহুল আমিন বলেন, ‘নুসাইবা শুধু ওর মাকে খোঁজে। ওকে শান্তনা দেই, ওর মা বাজারে গেছে। অফিসে গেছে। মাকে না পেয়ে কান্নাকাটি করে। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিছে। ওর কারণে ডিউটিতে যেতে পারছি না। ডিউটিতে গেলে ওকে কে দেখবে। ওকে বাঁচাতে পারবো না। আবার চাকরি ছেড়ে দিলে না খেয়ে মরতে হবে। ওর দাদু অসুস্থ। বাচ্চাকে দেখে রাখবে এমন শক্তিও তার নেই। অনেক বিপদে আছি। কিভাবে যে এ বিপদ থেকে আল্লাহ রক্ষা করবেন। কারো যেন এ ধরনের বিপদ না আসে।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ি থানার সাব-ইন্সপেক্টর নাদিম মুন্সী বলেন, ‘তদন্ত চলছে। আসামির পুরুষাঙ্গ অপারেশন করা হয়েছে। তার চিকিৎসার বিষয়টি আদালতকে অবহিত করা হয়েছে। সুস্থ হলে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যাবে আসল রহস্য। তবে তদন্তে আমরা যেটুকু জানতে পেরেছি, তাদের মধ্যে পরকীয়ার সম্পর্ক ছিল। সময় কাটাতে তারা ঘটনাস্থলে এসেছিলেন। মনোমালিন্যের কারণে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।’

মুসকানকে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, মুসকান নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের চৈতি গার্মেন্টসে চাকরি করতো। জাহাঙ্গীর হোসেনও মুসকানের লাইনশিপে চাকরি করতো। ৫ এপ্রিল সকাল ৭ টার দিকে স্ত্রী ও মেয়েকে বাসায় রেখে রুহুল আমিন মদনপুর কর্মস্থলে যান। সকাল ১০ টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত রুহুল আমিন মুসকানের মোবাইলে ফোন দেন। তবে মুসকান ফোন রিসিভ করেননি। একটার পর থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পান রুহুল আমিন। বিকেল ৫ টার দিকে যাত্রাবাড়ি থানা পুলিশের মাধ্যমে মুসকানের মৃত্যুর খবর পান রুহুল আমিন। তাৎক্ষণিক তিনি যাত্রাবাড়ির মাতুয়াইল ৩৭ নং বাগিচা পাড়াডগাইরস্থ সারোয়ার জাহানের বাড়ির ৭ম তলার বাসার একটি রুমে স্ত্রীর লাশ শনাক্ত করেন।

পরে তিনি জানতে পারেন, দুপুর একটার দিকে মুসকানকে নিয়ে ওই বাসায় আসেন জাহাঙ্গীর হোসেন। আড়াইটার দিকে ওই বাসা থেকে ব্যাপক আর্তচিৎকারের শব্দ পাওয়া যায়। রুহুল আমিনের অভিযোগ, জাহাঙ্গীর হোসেন কোনো কিছু দিয়ে আঘাত করে অথবা শ্বাসরোধ করে তার স্ত্রী মুসকানকে হত্যা করেছে। যাত্রাবাড়ি থানা পুলিশ জাহাঙ্গীরকে পুরুষাঙ্গ কাটা রক্তাক্ত জখম অবস্থায় আটক করে। পরে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করে পুলিশ।  বর্তমানে জাহাঙ্গীর হোসেন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন।

ঢাকা/মামুন/টিপু  

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়