টিন্ডার অ্যাপসে পরিচয়-বিয়ে, অতঃপর এলমার আত্মহত্যা
মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম
এলমা চৌধুরী ও ইফতেখার আবেদীন
বছর খানেক আগে টিন্ডার অ্যাপসের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের ছাত্রী এলমা চৌধুরী ওরফে মেঘলার সঙ্গে পরিচয় হয় কানাডা প্রবাসী ইফতেখার আবেদীনের।
ইফতেখার দেশে আসার পর দেখা এলমার সাথে। এরপর পরিবারের সদস্যদের সম্মতিতে বিয়ে। কিন্তু সংসার করা হয়নি বছর খানেকও। গত ২৪ ডিসেম্বর আত্মহত্যার চেষ্টা করেন এলমা। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনায় এলমার বাবা হত্যার অভিযোগ এনে মামলা করেন। সম্প্রতি মামলাটি তদন্ত করে ডিবি পুলিশ চার্জশিট দিয়েছে। হত্যা না, আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে ইফতেখারকে অভিযুক্ত করে এ চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। ইফতেখারের মা-বাবাকে অব্যাহতির আবেদন করা হয়েছে। তবে এলমার পরিবারের দাবি, পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
গত ২০ জুন ঢাকার অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আসাদুজ্জামান নূরের আদালতে মামলাটি শুনানির জন্য ধার্য ছিল। ওইদিন ইফতেখার এবং মা ও বাবা আত্মসমর্পণ করে জামিন বাড়ানোর আবেদন করেন। আদালত ইফতেখারের জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। তবে ইফতেখাতের বাবা ও মায়ের জামিন বহাল রাখেন আদালত।
এদিকে ডিবি পুলিশের দেওয়া চার্জশিটের বিরুদ্ধে নারাজি দিবেন জানিয়ে এলমার বাবা সময় আবেদন করেন। আদালত আগামি ৩ আগস্ট নারাজির বিষয়ে শুনানির তারিখ ধার্য করেছেন।
গত ৩১ মে দেওয়া চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা ক্যান্টনমেন্ট জোনাল টিমের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) কাজী শরীফুল ইসলাম বলেন, ইফতেখার ২০০২ সালে আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে বিএ পড়ার জন্য মালয়েশিয়া অলিম্পিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে ২০০৪ সালে পড়াশোনা শেষ করে ফ্রান্সের ম্যারিসুজানা নামে এক মেয়ের সাথে প্রেম হয় এবং ২০০৫ সালে তাদের বিয়ে হয়। ওই সংসারে ২০১০ সালে তাদের এক মেয়ের জন্ম হয়। পরে তাদের বিচ্ছেদ হয়। ইতিপূর্বে মেয়েকে নিয়ে কয়েকবার বাংলাদেশে আসেন ইফতেখার। গত বছর টিন্ডার অ্যাপসের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের ছাত্রী এলমা চৌধুরী ওরফে মেঘলার সাথে তার পরিচয় হয়। তাদের মধ্যে মোবাইল ফোনে অডিও ভিডিও কল চলতে থাকে। এক পর্যায়ে ইফতেখার বাংলাদেশে আসে। গত বছর ২৭ মার্চ উত্তরায় একটি রেস্টুরেন্টে তারা দেখা করেন। সেখান থেকে এলমাকে বনানীর বাসায় নিয়ে আসেন ইফতেখার এবং বাবা-মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। তার বাবা-মা এলমাকে পুত্রবধূ হিসেবে পছন্দ করেন। পরদিন বনানীর একটি রেস্টুরেন্টে তারা আবারও দেখা করেন। সেখানে তারা খাবার খেয়ে আবারও বাসায় আসে। ইফতেখারের বাবা-মা এলমার বাবা-মায়ের সাথে মোবাইলে বিয়ের বিষয়ে কথা বলেন। ২৯ মার্চ এলমার মা-বাবা ও খালু ইফতেখারের বনানীর বাসায় আসেন। ৪ এপ্রিল তারা বিয়ের তারিখ ঠিক করেন। উত্তরার একটি রেস্টুরেন্টে তাদের বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়।
তিনি বলেন, বিয়ের তিন মাস পর ইফতেখার ফ্রান্স চলে যান। পরবর্তীতে সেখান থেকে তিনি কানাডা যান। বিয়ের আগে ও পরে এলমার সাথে অন্য কোনো ছেলের সাথে সম্পর্ক থাকার বিষয়ে আসামি বিভিন্ন কৌশলে বুঝতে পারেন। ইফতেখারের সাথেও অন্য মেয়ের সাথে অবৈধ সম্পর্ক বিষয়ে সে নিজেই ভিকটিমকে জানিয়ে দেয়। স্ত্রীর অন্য ছেলের সাথে সম্পর্ক থাকার বিষয় জেনেও আসামি আস্তে আস্তে সামলে নেয়। এলমা ইফতেখারকে ফোন করে বলে তাকে কেউ কিছু পাঠিয়েছে কিনা? একথা সে তার স্বামীকে কয়েকবার বলেছে। এ বিষয়টি বার বার বলার পর ভিকটিমের প্রতি আসামির সন্দেহ বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে ইফতেখার এলমাকে বলে, তুমি যদি বেশি ভয় পাও তাহলে থানায় জিডি করো। সে মতে ভিকটিম বনানী থানায় ২৫ মে একটি জিডিও করে। এলমার চুল কাটার বিষয়টি ইফতেখার ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি। তাদের দুই জনের পূর্বের কিছু নেতিবাচক ঘটনা একে অপরের মধ্যে জানাজানি হয়। তারা দুজনই অতীত ঘটনার বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করে এবং বিষয়গুলো ভুলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সমস্ত অনাকাঙ্খিত ঘটনা যেন পুনরাবৃত্তি না হয় তা নিরসনে ও স্বামী-স্ত্রী একত্রে বসবাস করার জন্য এলমাকে বিদেশে পড়াশোনা করাবে এমন চিন্তাভাবনা করে ইফতেখার। বিদেশে নেয়া সহজীকরণের জন্য বিয়ের পর গত বছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসে কয়েক কিস্তিতে ইফতেখার এলমাকে সাত লাখ টাকা দেয়, যা বনানী থানাধীন ডাচ বাংলা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমা রাখা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলমার শিক্ষা বিষয়ক ফলাফল সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, এলমা এক বিষয়ে অকৃতকার্য ছিল। সে জন্য জরিমানাসহ অন্যান্য খাত হিসেবে ২৪ হাজার টাকা ইফতেখার এলমাকে দেয়। এতে প্রতীয়মান হয়, ইফতেখার এলমাকে পড়াশোনা করাতে আগ্রহী ছিলেন। ভিকটিমকে বিদেশ নেওয়ার জন্য কিছু কার্যক্রমও শুরু করেন। এরমধ্যে ভিকটিমের শারীরিক সমস্যার কারণে গাইনী বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন ডাক্তারদের শরণাপন্ন হয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করান। পরীক্ষা শেষে ভিকটিমসহ অন্যান্যরা জানতে পারেন, গর্ভধারণের জন্য ডিম্বাশয় যে পরিমাণ উপযুক্ত থাকতে হয় এলমা চৌধুরীর তা অনেক কম। সে কারণে এবং ব্যক্তিগত জীবনের অন্যান্য বিষয় নিয়ে ভিকটিম ডিপ্রেশনে ছিলেন। বিষয়টি তিনি বাসার কাজের মেয়ে, ড্রাইভার ও তার শাশুড়ির কাছে প্রকাশ করেছিলেন। ইফতেখার গত বছর ১১ ডিসেম্বর বিকেল চারটার দিকে বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে পৌঁছায় এবং ভিকটিম তাকে রিসিভ করে বনানীর বাসায় নিয়ে আসেন। পরদিন দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে বাবা-মাকে নিয়ে ঢাকা ক্লাবে গিয়ে দুপুরের খাবার খান। টিএসসিসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করে রাতে বাসায় ফেরেন। ১৩ ডিসেম্বর সকাল ১০ টার দিকে তারা স্বামী-স্ত্রী বের হন। স্ত্রীকে কানাডা নেওয়ার জন্য বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে যান। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেন এবং স্বামী-স্ত্রী বিভিন্ন বিনোদনমূলক স্থানে ঘোরাঘুরি করে দুপুর ও রাতের খাবার খেয়ে বাসায় ফেরেন।’
চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, রাত ১ টার দিকে তারা ঘুমাতে যান। রাত দুইটায় পাশের রুমে গিয়ে ইফতেখারকে এলমা মোবাইলে কথা বলতে দেখে। তার মোবাইল কেড়ে নেয় এবং ভীষণভাবে মেজাজ খারাপ দেখায়। কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে এলমা ওই রাতেই বাসা থেকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। বাসার কাজের মেয়ের সহায়তায় ইফতেখার এলমাকে বাইরে যেতে দেয় না এবং বাইরে যাওয়ার দরজার ভিতর দিক দিয়ে তালা মেরে চাবি লুকিয়ে রাখে ইফতেখার। ভিকটিম জোর করে নিজ রুমে যায় এবং তাদের মধ্যে মারামারি হয়। এতে ভিকটিমের জিদ আরও বেড়ে যায়। ফটো এলবামের কাঁচ দিয়ে নিজের গলা কাটার চেষ্টা করে এলমা। তারপর ইফতেখার উত্তেজিত হয়ে হাতের কাছে পাওয়া ফটো অ্যালবামের ফ্রেম দিয়ে এলমার হাত, পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে মারপিট করে জখম করে। ওই রাতেই এলমা বাইরে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করলে আসামি ভিকটিমের কাছে ক্ষমা চায় এবং ভিকটিমও আসামির কাছে ক্ষমা চায়। তারপর তারা ঘুমিয়ে পরে। বিষয়গুলো কাজের মেয়ে দেখে ও শোনে।
তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, পরদিন সকাল সাড়ে ১০ টায় তারা ঘুম থেকে ওঠে নাস্তা করে। ইফতেখার দুপুর ১২ টার দিকে পাশের রুমে সিগারেট খেতে যায়। এ নিয়ে ভিকটিম চিল্লাচিল্লি করে। দুপুর ২ টার দিকে আসামি টিকিট কেনার জন্য ভিকটিমের কাছে রাখা পাসপোর্ট চায়। তখন তাদের মধ্যে অনেক ঝগড়া হয়। তিনটার দিকে তাদের ড্রাইভার রবিউলকে দিয়ে ইফতেখার নিজে খাওয়ার জন্য ঘুমের ওষুধ আনায়। ওষুধ রুমে রেখে ইফতেখার ট্রাভেল এজেন্সির নম্বর আনার জন্য তার আম্মার রুমে যায়। তখন তার আম্মা রুমে ছিলেন না। বাইরে চলে গেছেন। ইফতেখার রুমে এসে দেখেন প্যাকেট থেকে তিনটি ঘুমের ওষুধ তার স্ত্রী খেয়ে ফেলেছে। স্ত্রীর সাথে তার আবার ঝগড়া হয়। তখন এলমার অবস্থা খারাপ বুঝে ইফতেখার বাসার কাজের মেয়েকে বলে মেইন গেটের দরজা বন্ধ করে চাবি তার কাছে দিতে। চাবির জন্য ভিকটিম তার পিছে ঘুরতে থাকে। সে তার স্বামীকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করে ইফতেখার কানাডায় চলে যাওয়ার বিষয়ে অটল কি না। তখন সে হ্যা বলে। ভিকটিম ঠিক আছে বলে রুমে চলে যায়। তখন আসামি বেলকুনিতে গিয়ে সিগারেট খায় এবং কাজের মেয়ে হাফিজাকে জিজ্ঞাসা করে তার মা কোথায় গেছে। হাফিজা বলে রুমেই আছেন। সিগারেট শেষ করে আসামি তার রুমে যাওয়ার চেষ্টা করে। দরজা বন্ধ থাকায় সে তার আম্মার রুমে যায়। সে ধারণা করছিল এলমার মেজাজ ঠান্ডা হলে ১০ মিনিট পর যাবে। কিন্তু ৫ মিনিট পর আবার সে দরজার কাছে যায়। তখনও রুমের দরজা বন্ধ দেখে ইফতেখার হাফিজাকে রুমের টিপ লকের চাবি নিয়ে আসতে বলে। হাফিজা নিয়ে আসলে দেখে তা আনলক করা। তবে ভিতর থেকে ছিটকানো লাগানো। তখন তার আম্মা ঘরে ছিল না। আসামির সৎ পিতা বাসায় দরজা বন্ধ দেখে তা ভেঙে ফেলার জন্য বলে। তখন আসামি হাফিজাকে তাদের ড্রাইভারকে ডেকে আনলে বললে দ্রুত সময়ের মধ্যে সে আসে। তারা তিনজন চেষ্টা করেও দরজা খুলতে পারেনি। তখন ডাইভারকে বলে নিচে থেকে দরজা ভাঙার মতো কিছু একটা আনতে। ড্রাইভার একটি শিলপাটা নিয়ে আসে। ড্রাইভার রবিউল বলে মামা আপনি টিপ লকটা ঘুরিয়ে ধরে রাখেন আমি দরজা বাড়ি দিয়ে ভাঙতেছি।
চার্জশিটে বলা হয়, প্রথমে কয়েকটি বাড়ি দিয়ে দরজার উপরের ছিটকানী ভেঙে ফেলা হয়। পরে বেশ কয়েকটি বাড়ি দিয়ে নিচের ছিটকানী ভেঙে ফেলে। দরজা খুলতেই তারা দেখে এলমা ওড়না দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে আছে। ইফতেখার তাড়তাড়ি করে জড়িয়ে ধরে পা উঁচু করে। ড্রাইভার রবিউল তা খোলার চেষ্টা করে। রবিউল খুলতে না পেরে হাফিজা বটি এনে দিলে ওড়না কেটে ফেলে। এলমাকে খাটে শুইয়ে আসামি মুখে ফুঁ দেয়। তখন গড়গড় করে দুইটা আওয়াজ হয়। সাথে সাথে রবিউল ও হাফিজা ধরাধরি করে এলমাকে দ্রুত গাড়িতে করে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে বিকেল ৪ টা ২০ মিনিটের দিকে এলমাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ইফতেখারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ঘটনার দিন বাসার বাইরে যেতে চাইলেও আসামি ইফতেখার আবেদীন তাকে যেতে না দিয়ে বাসার চাবি নিয়ে দরজা আটকে রাখে এবং শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করে। আসামি ভিকটিমকে অকারণে কুৎসা রটিয়ে অসৌজন্যমূলক আচরণ ও মারপিট করে। ভিকটিম অসৌজন্যমূলক আচরণ, অকারণে কুৎসা রটনা ও মারপিট সহ্য করতে না পেরে শয়নকক্ষে সিলিং ফ্যানের সাথে নিজের পরনের ওড়নায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে।
/টিপু/
আরো পড়ুন