ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

গার্মেন্টস পণ্য চুরি, মাস্টারমাইন্ড শাহেদের নেতৃত্বে শক্তিশালী চক্র

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২০, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩   আপডেট: ১৫:২১, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
গার্মেন্টস পণ্য চুরি, মাস্টারমাইন্ড শাহেদের নেতৃত্বে শক্তিশালী চক্র

সম্প্রতি ব্রাজিলে রপ্তানির গার্মেন্টস পণ্য চুরিসহ প্রায় দেড় যুগ ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানিকালে প্রায় দুই সহস্রাধিক কাভার্ড ভ্যান থেকে শত শত কোটি টাকার রপ্তানি পণ্য চুরির সংঘবদ্ধ চক্রের গডফাদার শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দাসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। 

শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে কারওয়ান বাজার র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির লিগাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং এর পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল-মঈন এসব তথ্য জানান। 

তিনি জানান, শুক্রবার রাতে মৌলভীবাজার, গোপালগঞ্জ ও ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে বহুল আলোচিত ব্রাজিলে রপ্তানিকৃত গার্মেন্টস পণ্য চুরিসহ দেশের বিভিন্ন গার্মেন্টস পণ্য চুরির মূলহোতা শাহেদ, মো. ইমারত হোসেন সজল,  শাহজাহান ও  মো. হৃদয়কে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে চুরির কাজে ব্যবহৃত ১টি কাভার্ড ভ্যান। 

তিনি বলেন, শাহেদ গার্মেন্টস পণ্য চুরি জগতের মাস্টারমাইন্ড এবং এই চক্রের মূলহোতা ও নির্দেশদাতা। তার ছত্রছায়ায় দেশের প্রায় অধিকাংশ গার্মেন্টস পণ্য চুরির ঘটনা সংঘটিত হয়ে থাকে। ৪০-৫০ জনের এ চক্রে রয়েছে অসাধু ড্রাইভার, হেলপার, গোডাউন মালিক, গোডাউন এলাকার আশ্রয়দাতা, অত্যন্ত দক্ষ কুলি সর্দারসহ একদল লেবার। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা ট্রান্সপোর্টে গার্মেন্টেসের মালামাল বহন শুরু করে। একপর্যায়ে তারা গার্মেন্টস পণ্য পরিবহনের সাথে সম্পৃক্ত কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভার ও হেলপারদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে এবং অল্প সময়ে বেশি অর্থ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে গার্মেন্টস পণ্য চুরির কাজে উৎসাহিত করে। প্রত্যেকটি চুরির ঘটনার আগে ড্রাইভারদের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানিকৃত গার্মেন্টস পণ্যের স্যাম্পল নিয়ে চোরাইকৃত পণ্যের সম্ভাব্য বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করতো। চুরির জন্য নির্ধারিত গার্মেন্টস পণ্যের আনুমানিক মূল্য যদি ১২-১৫ লাখ টাকা হতো তাহলেই শুধু তারা চুরির কার্যক্রম চালাতো। 

তিনি আরও বলেন, এই টাকা থেকে কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভার ৩০ হাজার, হেলপার ২০ হাজার, গোডাউনের মালিক ৫০ হাজার, গোডাউন এলাকার শেলটার পার্টি ৬০ হাজার, কার্টুন প্যাকেজিং এক্সপার্ট ১০ হাজার, অন্যান্য লেবার প্রত্যেকে ২/৩ হাজার টাকা করে পেতো। বাকি টাকা তাদের গ্রুপের মধ্যে অবস্থান অনুযায়ী বন্টন করে নিতো। ড্রাইভার এবং হেলপার পণ্যবাহী কাভার্ড ভ্যানটি নির্দিষ্ট গোডাউনে নিয়ে আসলে চক্রের অন্যান্য সদস্যরা কার্টুন কেটে গার্মেন্টস পণ্যগুলো আলাদা করে রাখতো। প্রথমত তারা ১০ পিসের কার্টুন থেকে ৪ পিস এবং ২০ পিসের কার্টুন থেকে ৬-৮ পিস গার্মেন্টস পণ্য সরিয়ে রেখে পুনরায় কার্টুনগুলো প্যাকেজিং করে দ্রুত কাভার্ড ভ্যানে লোড করে বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দিতো। পরবর্তীতে চক্রের অন্য সদস্যরা চোরাই পণ্যগুলো তাদের নিজস্ব পিকআপ বা কাভার্ড ভ্যানযোগে অন্য একটি গোডাউনে এক থেকে দেড় মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করতো। ট্রান্সপোর্টের মালামাল যখন বিভিন্ন দেশে রপ্তানির উদ্দেশ্যে বন্দর থেকে দেশের বাইরে চলে যেতো তখন তারা চোরাই পণ্যগুলো রাজধানীর উত্তরাসহ বিভিন্ন অসাধু বায়িং হাউজের কাছে বিক্রি করতো। 

খন্দকার আল-মঈন, ব্রাজিলে রপ্তানিকৃত পণ্য চুরির ঘটনাও শাহেদের নির্দেশে সংঘটিত হয়। গত বছরের ২৯ অক্টোবর গাজীপুর থেকে গার্মেন্টস পণ্য কাভার্ডভ্যানে লোড করে সন্ধ্যার সময় চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। কাভার্ড ভ্যানে পণ্য লোডের পর গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ ড্রাইভার শাহজাহানের কাছে স্যম্পল হিসেবে কিছু সোয়েটার প্রদান করে। ড্রাইভার শাহজাহান স্যাম্পল পাওয়ার পরপরই ছবি তুলে মোবাইলের মাধ্যমে মূলহোতা শাহেদের কাছে পাঠায়। শাহেদ স্যাম্পল পেয়ে আসামি তাওহীদুল ওরফে কাওছারের কাছে পাঠায় এবং পণ্যের গুনগত মান ও বাজারমূল্য বিবেচনা করে চালানটিতে চুরির নির্দেশ দেয়। মাস্টারমাইন্ডের নির্দেশ মোতাবেক কাওছার ড্রাইভারের সাথে যোগাযোগ করে চুরির মূল প্লট বাস্তবায়ন করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাওছারের নির্দেশে ড্রাইভার ও হেলপার ২৯ অক্টোবর মধ্যরাতে ডেমরা থানার মিরপাড়ায় আয়েশা প্যাকেজিং ভবনের গোডাউনে কাভার্ডভ্যানটি পার্ক করে চুরির ঘটনাটি ঘটায়। পূর্বে থেকে আয়েশা প্যাকেজিং ভবনের গোডাউনে অপেক্ষারত কুলি সর্দার নাজিম, স্থানীয়ভাবে আশ্রয়দাতা মাসুম ওরফে মাসুদসহ অজ্ঞাতনামা ৫/৭ জন লেবার নিয়ে মূলহোতা কাওছার প্রত্যেকটি কার্টুন থেকে ৩০-৩৫% পণ্য সরিয়ে পুনরায় প্যাকেজিং করে কাভার্ডভ্যানটি বন্দরের উদ্দেশে পাঠিয়ে দেয়। এ ঘটনায় কার্টুন প্যাকেজিং এ অত্যন্ত দক্ষ কুলি সর্দার নাজিম অন্যান্য লেবারদের নিয়ে কাভার্ডভ্যান থেকে কার্টুন আনলোড থেকে শুরু করে কার্টুন থেকে পণ্য সরিয়ে পুনরায় প্যাকেজিং এবং কাভার্ড ভ্যানে কার্টুন লোডের কাজটি করেছে। 

উল্লেখ্য, এই চুরির ঘটনার সাথে জড়িত কাওছার, নাজিম ও মাসুমকে রাজধানীর ডেমরা থেকে গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর  র‌্যাব-৪ কর্তৃক অপর একটি গার্মেন্টস পণ্য চুরির ঘটনায় হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে।

শাহেদ চট্টগ্রামে থাকাকালে ১৯৯৬ সালে ২টি ট্রাক কিনে লোকাল ব্যাবসা শুরু করে এবং ২০০৪ সালে ট্রাক দুটি বিক্রি করে ৪টি কাভার্ড ভ্যান কিনে গার্মেন্টস পণ্য পরিবহন শুরু করে। সে কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভার এবং হেলপারদের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের সহায়তায় গার্মেন্টস পণ্য চুরির কার্যক্রমের জন্য একটি সংঘবদ্ধ চোর চক্র তৈরি করে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত সে নিজেই স্বশরীরে উপস্থিত থেকে চুরির কার্যক্রম চালিয়ে যায়। ২০১৮ সাল পরবর্তী সময়ে সে পর্দার আড়ালে থেকে চুরির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ শুরু করে এবং প্রত্যেকটি চুরির ঘটনায় আয়কৃত অর্থের সর্বোচ্চ অংশ সে পেতো। 

মৌলভীবাজার শহরে সাহেদের প্রায় ১৫-২০ কোটি টাকা মূল্যের একটি বাড়ি রয়েছে। মৌলভীবাজারের দূর্লভপুর প্রায় ২০ একর জমির উপরে মাছের খামারসহ বিশাল দুটি হাঁস মুরগির খামারও রয়েছে এবং বর্তমানে তার নিজস্ব ৪টি সহ তার সহযোগীদের আরও ১৫টি কাভার্ডভ্যান রয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১৭-১৮টি গার্মেন্টস পণ্য চুরির মামলা রয়েছে এবং যার অধিকাংশ মামলায় সে কারাভোগ করেছে। 

র‌্যাব জানায়, গ্রেপ্তারকৃত আসামি ইমারত হোসেন সজল গত ২০১২ সাল থেকে ঢাকার উত্তরায় গার্মেন্টস পণ্যের স্টকলটের ব্যবসা শুরু করে। ব্যবসার সুবাদে গার্মেন্টস পণ্য চুরি জগতের গডফাদার শাহেদ, কাউছারসহ অন্যান্য সদস্যদের সাথে তার পরিচয় হয়। শাহেদের মাধ্যমে কম দামে চোরাইকৃত গার্মেন্টস পণ্য কিনে স্টক করে সুবিধাজনক সময়ে বেশি দামে স্থানীয় মার্কেটসহ বিভিন্নভাবে বিক্রয় করতো। গত ২ বছরে সে শাহেদের মাধ্যমে ১৫০-২০০টি চুরির ঘটনায় চোরাইকৃত গার্মেন্টস পণ্য ক্রয় ও বিক্রয় করেছে। তার এই চোরাইকৃত কিছু কিছু গার্মেন্টস পণ্য বিভিন্ন মাধ্যমে হাত বদল হয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয়েছে। সে অবৈধ পথে কোটি টাকার অধিক স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মালিক হয়েছে যার মধ্যে গ্রামে ৩০ লাখ টাকার একটি বাড়ি ও বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে ৩০-৩৫ লাখ টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। 

এদের রাসেল প্রথমে কাভার্ড ভ্যানের হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করে। পরবর্তীতে সে ৭ বছর পূর্বে এই চোর চক্রের মাস্টারমাইন্ড শাহেদের নিজস্ব কাভার্ডভ্যানের ড্রাইভার হিসেবে কাজ শুরু করে। সেই সুবাদে ড্রাইভার শাহজাহান এ চক্রের অন্যতম সদস্য। সে ব্রাজিলে রপ্তানিকৃত চুরি হওয়া গার্মেন্টস পণ্য বহনকারী কাভার্ডভ্যানের ড্রাইভার হিসেবে নিয়োজিত ছিলো। বিগত ৬-৭ বছরে সে প্রায় শতাধিক চুরির সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য দিয়েছে। 

ঢাকা/মাকসুদ/টিপু 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়