ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

শত বছর তৃষ্ণা মেটাচ্ছে বিউটি লাচ্ছি

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৩, ১২ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শত বছর তৃষ্ণা মেটাচ্ছে বিউটি লাচ্ছি

প্রায় শত বছর ধরে তৃষ্ণা মেটাচ্ছে পুরনো ঢাকার বিউটি লাচ্ছি। ৫২ বাজার ৫৩ গলির প্রাচীন এই নগরীর বয়স চারশ ছুঁয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় নগরের অলিগলিতে গড়ে উঠেছে নামীদামি হোটেল-রেস্তোরাঁ। এসব খাবারের দোকানের কোনো কোনোটির বয়স প্রায় শত বছর। এমনই একটি লাচ্ছির দোকান ‘বিউটি লাচ্ছি’। তারা আজও সুনামের সঙ্গে ধরে রেখেছে ব্যবসায়িক ঐতিহ্য।

পুরনো ঢাকার ৩০/এ জনসন রোড ধরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দিকে কয়েক পা এগুতেই রাস্তার পশ্চিম পাশে এর অবস্থান। প্রায় ২০ বছর প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত জাকির হোসেন। বর্তমানে ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন। তার মুখেই শুনলাম বিউটি লাচ্ছির শুরুর কথা।

১৯২২ সাল। টং দোকান দিয়ে বিউটি লাচ্ছির যাত্রা শুরু মরহুম আব্দুল আজিজের হাত ধরে। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয়তার পাশাপাশি বদলেছে এর কাঠামোগত দিক। তবে শুরু থেকেই গুণগত মান ঠিক রেখে লাচ্ছি তৈরি করছে তারা। এর স্বাদের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই ঢাকাবাসীর কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বিউটি লাচ্ছি। আজিজপুত্র আব্দুল গাফ্‌ফার মিয়া বাবার মৃত্যুর পর দায়িত্ব নেন। ২০০১ সালে আব্দুল গাফ্‌ফারের মৃত্যুর পর ব্যবসা দেখাশোনা করছেন তার দুই ছেলে মো. জাভেদ হোসেন ও মো. মানিক মিয়া। বর্তমানে তাঁদের হাতেই পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ধারণ করে টিকে আছে বিউটি লাচ্ছি।

বিউটি লাচ্ছির মূল কারিগর মো. আলাউদ্দিন। তিনি দেখেছেন প্রতিষ্ঠানের তিন প্রজন্মকে। আলাউদ্দিন বলেন, ‘স্বাধীনতার অনেক আগে থেকে একই গদিতে বসে দই, চিনি আর বরফ দিয়ে লাচ্ছি বানাচ্ছি। কখনও এর বদনাম শুনিনি। গ্রাহকের ভালোবাসা নিয়েই টিকে আছি আমরা।’ লাচ্ছির পাশাপাশি এখানে শরবত, ফালুদা বানানো হয়। দোকানের একদম শেষ মাথায় একমনে বসে ফালুদা বানাচ্ছিলেন এক যুবক। ২ মিনিটের মধ্যে ৮ বাটি ফালুদা বানিয়ে ফেললেন। জিজ্ঞেস করতেই বললেন, নাম জসিম। তিন বছর ধরে কাজ করছেন বিউটি লাচ্ছিতে। এখানে তিনি ফালুদা কারিগর। আপেল, আঙুর, আনার, শ্রীফল, খেজুর, কলা, দই, মালাই, আইসক্রিম, চিনির সিরা, নুডুলস, সাবুর দানা, পেস্তা বাদাম আর ঘি দিয়ে তিনি পরম যত্নে ফালুদা বানিয়ে চলেছেন।

ম্যানেজারের কাছ থেকে জানা গেল, রায়সাহেব বাজারে বিউটি লাচ্ছির আরো দুটি শাখা রয়েছে। সপ্তাহের সাত দিনই খোলা থাকে। শুক্রবার সকাল থেকে জুমার নামাজের আগ পর্যন্ত বন্ধ।

দনিয়া থেকে কোর্টের কাজে ঢাকায় এসেছেন পরিমল বালা। তিনি বলেন, ‘মামলার কাজের জন্য প্রায় প্রতি মাসেই কোর্টে আসতে হয়। এ নিয়ে ছয়বার এখানকার লাচ্ছি আর ফালুদা খেলাম। সত্যি বলতে প্রেমে পরে গিয়েছি। ফলে ঢাকা এলে এখানে লাচ্ছি খেতে ভুল হয় না। এখানকার লেবুর শরবতটাও ভালো!’

পুরনো ঢাকার স্থানীয় মাজেদ বলেন, ‘আমি অনেক দিন খেয়েছি এখানকার লাচ্ছি, ফালুদা, শরবত। কোনো ধরনের ক্ষতিকর মেডিসিন বা অন্য কিছু ব্যবহার না করেও যে ভালো কিছু তৈরি সম্ভব, তার উদাহরণ বিউটি লাচ্ছি।’ ফালুদা কিনতে আসা ফখরুল ইসলামের ভাষ্যমতে, তিনি পুরনো ঢাকায় বড় হয়েছেন। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে আসতেন লাচ্ছি খেতে। বড় হওয়ার পর এখন সন্তানকে নিয়ে আসেন।  বিউটির লাচ্ছি একেবারে আলাদা বলে জানান তিনি।

ম্যানেজারের সহযোগী মো.শহিদুল ইসলাম। তিনি প্রায় ৩৭ বছর থেকে বিউটি লাচ্ছিতে কাজ করছেন। শহিদুল জানান, দৈনিক ২০০ থেকে ৩০০ গ্লাস লাচ্ছি-শরবত বিক্রি হয়। গরমে গ্রাহক আরো বাড়ে। অনেক সময় চাপ সামলানো যায় না। শরবত ১৫ টাকা, লাচ্ছি ৩০ টাকা, স্পেশাল বিট লবণের লাচ্ছি ৪০ টাকা বিক্রি হয়। ডায়াবেটিস রোগীর জন্য বিট লবণের লাচ্ছি তৈরি করা হয়। এছাড়া স্পেশাল ফালুদা ৮০ টাকা, নরমাল ৬০ টাকা । দিনে ১৫০ থেকে ২৫০ বাটি ফালুদা নিয়মিত দোকানেই বিক্রি হয়। সেইসঙ্গে রয়েছে পার্সেল ব্যবস্থা।

দেশের অন্যান্য জেলাতেও বিউটি লাচ্ছির ভালো নাম-ডাক রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেকেই এখান থেকে লাচ্ছি-ফালুদা বানাতে লোক ভাড়া করে নিয়ে যান। মো. জাভেদ হোসেন বলেন, ‘বাপ-দাদার রেখে যাওয়া নাম করা বিউটি লাচ্ছি। কখনো যাতে নিজেদের নাম ও মান থেকে সরে না যায় সেই চেষ্টা করি। এখন পর্যন্ত মানের দিকটি ঠিক রাখতে পেরেছি বলেই বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রাহক আসে।’

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়