ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

রমজানে নিরাপদে রোজা রাখার উপায়

এস এম গল্প ইকবাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২৮, ১৯ এপ্রিল ২০২১   আপডেট: ১১:৩২, ১৯ এপ্রিল ২০২১
রমজানে নিরাপদে রোজা রাখার উপায়

রমজান মাসে সাধারণত সেহেরি ও ইফতারে যার যেটা ভালো লাগে সেটা খাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু এসময় অনেকেই যা খাচ্ছেন সেটা স্বাস্থ্যকর কিনা তা নিয়ে মোটেই ভাবেন না, তাদের কাছে খাবারটি মুখরোচক কিনা তা প্রাধান্য পায়। একারণে পেটের সমস্যায় ভোগার ঝুঁকি রয়েছে, যেমন- বদহজম, পেটফাঁপা, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। এর ফলে ইবাদত-বন্দেগিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

এছাড়া রমজানে অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসের কারণে কিছু বড় রোগের ঝুঁকিও বেড়ে যেতে পারে, যেমন- ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ। তাই এসময় সেহেরি, ইফতার ও রাতের খাবারে যা খাবেন তা স্বাস্থ্যকর কিনা যাচাই করার প্রয়োজন রয়েছে। এখানে কীভাবে রমজানে নিরাপদে রোজা রাখা যায় তা সম্পর্কে পরামর্শ দেয়া হলো।

* অবশ্যই সেহেরি খাবেন

রমজানে খাবার খাওয়ার দুটি সুযোগ রয়েছে: সকালে সূর্যোদয়ের পূর্বে সেহেরি এবং সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের পরে ইফতার। কেউ কেউ রাতের মধ্যভাগে খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন- তারা রাতের শেষভাগে সেহেরি খেতে ওঠেন না। এটা একপ্রকারের উদাসীনতা। তাদের মতে, রাতের শেষভাগে খাবার খেতে রুচি আসে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, টানা কয়েকদিন সেহেরি খেলে মুখে রুচি চলে আসে। দিনে দুর্বলতা এড়াতে চাইলে সেহেরি খেতেই হবে। উদাহরণস্বরূপ, কেউ রাতের এগারোটায় খাবার খেয়ে রোজা রাখলে তাড়াতাড়ি ক্লান্তিতে ভুগবেন এটা সহজেই অনুমান করা যায়।

‘দ্য হেলদি রামাদান গাইড’ বইয়ের লেখক ডা. নাজিমা কুরেশীর মতে, সেহেরি খাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এসময় যা খাবেন তার ভিত্তিতে শরীর কতক্ষণ সতেজ থাকবে অথবা কত দ্রুত দুর্বল হবে তা নির্ভর করে। তিনি বলেন, ‘অনেকেই সেহেরিতে সরল কার্বোহাইড্রেট খেয়ে থাকেন। কিন্তু সরল কার্বোহাইড্রেট শরীরে দীর্ঘক্ষণ শক্তি যোগাতে পারে না।’ এর পরিবর্তে ডা. নাজিমা সেহেরির খাদ্যতালিকায় গোটা শস্য, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট, প্রোটিন, শাকসবজি ও ফল রাখতে পরামর্শ দিয়েছেন। এসময় বাদামী চালের ভাত, গমের রুটি, বার্লি, ওটস, মসুর ডাল, তৈলাক্ত মাছ, ডিম, গাজর, আপেল ও নাশপাতি খেতে পারেন।

* পর্যাপ্ত পানি পান করুন

সেহেরিতে যথেষ্ট পরিমাণে পানি পানের গুরুত্বকে কোনোমতেই অস্বীকার করা যাবে না। এর বহুবিধ স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। শরীরে পানির ঘাটতি হলে মেজাজ খারাপ হতে পারে এবং পিপাসা বেড়ে যেতে পারে। এছাড়া শরীর পর্যাপ্ত পানি না পেলে ক্লান্তিতে ভুগতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, শারীরিক পানিশূন্যতা স্মৃতিশক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে।

সেহেরিতে পর্যাপ্ত পানি পান করলে দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং মাইগ্রেন বা অন্যান্য মাথাব্যথা, কিডনি পাথর, কোষ্ঠকাঠিন্য ও উচ্চ রক্তচাপ এড়ানো সম্ভব হয়। কিছু প্রমাণ রয়েছে যে, শরীর যথেষ্ট পানি পেলে ক্ষুধাও কমে যায়। এটা রোজাদারের জন্য বিশেষ সহায়ক। তাই সেহেরিতে কমপক্ষে তিন গ্লাস পানি পান করুন।

সেহেরিতে কোন ধরনের খাবার খাবেন তাতেও মনোযোগী হোন। এসময় মিষ্টি জাতীয় খাবারে প্রলুব্ধ হবেন না, বরং খাদ্যতালিকায় পানি সমৃদ্ধ ফল ও সবজি রাখুন। এটা ডা. নাজিমার পরামর্শ। আপনি সেহেরিতে তরমুজ, খরমুজ, কমলা, মোসাম্বি, ডাবের পানি, স্কিম মিল্ক, শসা, ক্ষীরা, ক্যাপসিকাম ও টমেটো খেতে পারেন।

* অতিভোজন করবেন না

রমজানে ঐতিহ্যবাহী খাবার খেতে নিষেধাজ্ঞা নেই, কিন্তু সচেতন থাকুন যে অতিভোজন করছেন না। অতিভোজন বলতে শরীরের জন্য যতটুকু খাবার দরকার তার চেয়ে বেশি খাওয়াকে বোঝানো হচ্ছে। আমাদের দেশে ইফতারের ঐতিহ্যবাহী একটি খাবার হলো ছোলা। এটা খুবই স্বাস্থ্যকর খাবার। অনেক পরিবারে সাধারণত এটাই ইফতারের প্রধান খাবার। এর পাশাপাশি অন্যান্য ভাজাপোড়া ও তৈলাক্ত খাবার এবং মিষ্টি জাতীয় খাবারও খাওয়া হয়। কিন্তু এসব খাবার অবশ্যই সীমিত পরিসরে খেতে হবে। সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে যতটা সম্ভব পরিহার করা উচিত, যেমন- গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বা ডায়াবেটিস থাকলে। কোন স্বাস্থ্য সমস্যাতে কোন খাবার এড়িয়ে যাওয়া উচিত তা সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন।

সারাদিন উপবাস থাকার পর পেটে তীব্র ক্ষুধা নিয়ে খাবারের ওপর হামলে পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এটা একটি বদাভ্যাস, বিশেষত স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করলে। ডা. নাজিমা খেজুর খেয়ে রোজা ভেঙে কিছু ফল খেতে ও পানি পান করতে পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ফলের প্রাকৃতিক চিনি শরীরকে জানাবে যে কিছু খাওয়া হয়েছে। তাই নিজেকে ক্ষুধার্ত মনে হবে না এবং অতিভোজনের সম্ভাবনা কমে যাবে।’ তিনি এরপর মাগরিবের নামাজ পড়ে ইফতারের প্রধান খাবার খেতে পরামর্শ দিয়েছেন। ডা. নাজিমার পরামর্শ মতে, প্লেটের অর্ধভাগে সালাদ, এক চতুর্থাংশে কার্বোহাইড্রেট এবং এক চতুর্থাংশে প্রোটিন রাখতে পারেন।

* নিজের স্বাস্থ্যকে জানুন

ইসলাম কিছু রোগীকে রোজা না রাখার অবকাশ দিয়েছে। রোজা রাখতে গিয়ে শারীরিক সমস্যা প্রকট হয়ে জীবনের ঝুঁকি বাড়লে রোজা না রাখা বৈধ। কোনো রোগে ভুগলে চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন যে রোজা রাখলে সমস্যা বাড়বে কিনা। কোনো ব্যক্তির দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যার মানে এটা নয় যে, তিনি রোজা রাখতে সক্ষম নন। সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বয়ে অসুস্থতায়ও রোজা রাখা সম্ভব। ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটারলু’র সহকারী অধ্যাপক ওয়াসিম আলসাবাগ বলেন, ‘রোজা রাখলেও ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে সেহেরি ও ইফতারকে বিবেচনায় রেখে ওষুধ গ্রহণের সময় সমন্বয় করতে হবে। ওষুধের সময় সমন্বয় করে রোজা রাখার পরেও শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকলে ওই রোগীর রোজা রাখা উচিত নয়।’

জরুরি বিভাগের সংকটাপন্ন রোগী, রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিনিয়ত খাবার ও পানির প্রয়োজন এমন ডায়াবেটিস রোগী, কিছু ক্যানসার ও জীবন সংশয় রয়েছে এমন অন্যান্য রোগে রোজা এড়িয়ে যাওয়ার শিথিলতা রয়েছে। তবে ডায়াবেটিস ও হাইপারটেনশনের মতো স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ন্ত্রণে থাকলে রোজা রাখতে পারবেন। এক্ষেত্রে রোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়াবলি পর্যবেক্ষণ করতে হবে, যেমন- রক্ত শর্করা, রক্তচাপ, পর্যাপ্ত পানি পান ও ওষুধ গ্রহণের সময় সমন্বয়। এসময় প্রয়োজনে তৎক্ষণাৎ পরামর্শ পেতে আপনার চিকিৎসকের যোগাযোগ নম্বর সংগ্রহে রাখুন। কোনো স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে রোজা রাখতে না পারলে দুশ্চিন্তা করবেন না- যে কয়টি রোজা রাখা সম্ভব হবে না তা পরবর্তীতে পূরণ করার বিধান রয়েছে, এমনকি অভাবগ্রস্তকে খাবার খাওয়ানোর মাধ্যমেও।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়