ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

রোজা যে কারণে স্বাস্থ্যের জন্য ভালো  

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:১৩, ২১ এপ্রিল ২০২১   আপডেট: ১৭:৪০, ২২ এপ্রিল ২০২১
রোজা যে কারণে স্বাস্থ্যের জন্য ভালো  

সুস্বাস্থ্যের জন্য রোজা বলতে কী বোঝায়, তা সচেতন পাঠকমাত্রই জানেন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- তোমরা রোজা রাখো সুস্থ থাকবে। মহানবীর এই বাণী স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ রোজা, তথা রমজান মাসের রোজা। এটি শুধু একটি ইবাদতই নয় বরং সুস্বাস্থ্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ টনিকও। কীভাবে? সে বিষয়টিই আজ সংক্ষেপে বলবো।

প্রথমত রোজা পরিমিত খাবারের সুযোগ করে দেয়। এই পরিমিত খাবারের পর, কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা অভুক্ত থাকার সুযোগও করে দেয়। এ বছর যারা আমরা রোজা শুরু করেছি, তারা লক্ষ্য করেছি যে, এবারের পূর্ণাঙ্গ একটি রোজায় কমপক্ষে প্রায় ১৪ ঘণ্টা ২০ মিনিট বা এর কাছাকাছি একটি সময় আমরা পুরোপুরি না খেয়ে, না পান করে কাটাই।

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষা অটোফেজি বা সেলফ ইটিং অথবা আত্মভক্ষণ সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি। অটোফেজি নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন বা করছেন, সেসব চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইতোমধ্যেই স্বীকার করেছেন যে, অটোফেজি অথবা আত্মভক্ষণ প্রক্রিয়া শরীরের কোষের মধ্যে কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা পানাহার থেকে দূরে থাকলেই শুরু হয়। আবার কেউ কেউ বলেছেন ১৩ ঘণ্টা, কেউ বলেছেন ১৮ ঘণ্টা, কেউ বলেছেন ২৪ ঘণ্টা, কেউ বলেছেন ৪৮ ঘণ্টা, আবার অনেকে ৭২ ঘণ্টার কথাও বলেছেন। তবে যারা লম্বা সময়ের কথা বলেছেন, সেসব  প্রবক্তার বক্তব্য অনুসারে পানাহারের পর থেকে, শুধু পানি ছাড়া কিছুই আর গ্রহণ করা যাবে না।

অন্যদিকে একজন মুসলিম রোজা রেখে পানি এবং খাবার দু’টো থেকেই কিন্তু কমপক্ষে প্রায় ১৪ ঘণ্টা ২০ মিনিট সময় দূরে থাকছে। তাহলে অন্ততপক্ষে দু’ঘণ্টা বিশ মিনিট সময় তার আত্মভক্ষণ প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে। আর এটি স্বাস্থ্যের জন্য কতটা উপকারী সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

যারা ইসলামে বিশ্বাস করেন না, বা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ, তারা বলেন, ‘রোজা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, তাই রোজাদার আল্লাহর আদেশ মানার জন্যেই রোজা রাখে’। কথাটি সম্পূর্ণ সঠিক  নয়। রোজা একজন মুসলিম এবং তার স্রষ্টার মধ্যে বিশেষ একটি সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ। কেউ যদি রোজা না রাখে, অথবা রোজা রাখে, অথবা রোজা রেখে ভেঙে ফেলে, অন্য কোনো মানুষের পক্ষেই তা বোঝা বা জানা প্রায় অসম্ভব। একমাত্র আল্লাহ্ তার বান্দা সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন। তাই মুসলিমদের রোজা শুধু ইবাদত নয়, ইবাদত এর পাশাপাশি এটি স্বাস্থ্য সুরক্ষারও গুরুত্বপূর্ণ একটি  হাতিয়ার। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন কারীমে বলেছেন, “তোমাদের জন্য রোজা রাখা খুবই ভালো, যদি তোমরা জানতে।’’

রোজায় পানাহারের নিয়ম কী আর আমরা করছি কী? রাসূল সা. বলেছেন, ইফতার করতে খেজুর দিয়ে, পানি দিয়ে, তাহলে এই খেজুর এবং পানি রক্তের সাথে খুব দ্রুত মিশে যেতে পারে। লম্বা সময় অভুক্ত থাকার পর এই মিশে যাওয়া শরীরের জন্য খুব উপকারী। অন্যদিকে ইফতারের সময় ভারী খাবার খেলে, গোস্ত-রুটি অন্যান্য খাবার খেয়ে উদর পরিপূর্ণ করে নিলে, কখনোই এর সুফল সাথে সাথে তো পাওয়া যায়ই না, বরং তা স্বাস্থ্যের জন্য অপকারী হিসেবে প্রতীয়মান হয়। 
ইসলামের নির্দেশ, ইফতার করতে হবে কম পানাহারের মাধ্যমে। গ্রহণ করতে হবে সুষম খাদ্য। সেহরিতে খেতে হবে পরিমিত খাবার। কেউ সেহরিতে গলা পরিমাণ খেয়ে, তারপর যদি রোজা রাখে, সেই রোজার মূল্য রাসূলের বাণী অনুসারে সঠিকভাবে পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। কেউ যদি ইসলামের দীক্ষা অনুসারে ইফতার খায়, সেহরি গ্রহণ করে এবং রোজা রাখে, তাহলে অবশ্যই তা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভালো।

তাছাড়া রোজার স্বাস্থ্য বিষয়ক গুরুত্বের কয়েকটি দিক রয়েছে। একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানী বলেছেন, যদি কোনো একজন রোজাদার একটি রোজা রাখে, তাহলে একদিনের রোজার ফলে অটোফেজি বা আত্মভক্ষণ প্রক্রিয়ায় তার শরীরের যে উপকার হয়, সেটি দশ দিন পর্যন্ত কাজ করে। এভাবে তিন দিন রোজা রাখলে ৩০ দিনের সুস্থতার বিষয়টি নির্ধারিত হয়ে যায়।

এ প্রসঙ্গে রাসূল সা. আইয়ামে বীজ বা প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখার যে বিধানটি হাদিসের মাধ্যমে দিয়েছেন, সেটি পরবর্তী এক মাসের অর্থাৎ ৩০ দিনের স্বাস্থ্য সুরক্ষার একটি মহাকবচ হিসেবেই নির্দেশিত। 

আবার রাসূল সা. বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যদি রমজানের রোজা রাখে, এরপর ধারাবাহিকভাবে শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা রাখে, সে যেন সারা বছর রোজা রাখলো।’ অর্থাৎ এই ৩৬টি রোজায় পুরো বছর রোজা রাখার স্বাস্থ্যগত উপকার হবে, আবার আল্লাহর ঘোষিত প্রতিদান তো আছেই। ওই চিকিৎসা বিজ্ঞানীর বক্তব্য অনুসারে যদি ধরা হয় যে, একটি রোজা ১০ দিনের জন্য উপকারী হয়; সেই ক্ষেত্রে ৩৬টি রোজা ৩৬০ দিন বা প্রায় এক বছরের জন্য অবশ্যই উপকারী হবে। বারো মাসে তিনটি করে রোজা রাখলে যেমন ৩৬টি রোজা হয়, তেমনি আইয়ামে বীজের রোজাও ৩৬টি হয়। অর্থাৎ এই হাদীসের বাণী অনুসারে রাসূল সা. এর এই নির্দেশগুলো যদি পালন করা হয়, তাহলে একজন মুসলিমের জন্য এক বছর সুস্বাস্থ্যের সঙ্গে থাকা খুবই সহজ।

এ ক্ষেত্রে একটা কথা মনে রাখা দরকার, রোজা রেখে উদরপূর্তি করলে সবকিছুই ভেস্তে যেতে পারে। না স্বাস্থ্যগতভাবে ভালো থাকা যাবে, না রাতের বেলা ইবাদত করা যাবে, না সঠিকভাবে তারাবিহ আদায় করা যাবে, না রাত জেগে কুরআন তিলাওয়াত করা যাবে- কোনো কিছুই সঠিকভাবে করা সম্ভব হবে না।

আবার সেহরিতে প্রচুর পরিমাণে খেলে, নড়াচড়া করা যায় না- এমন অবস্থা হলে, লম্বাভাবে ঘুমাতে হয়, দিনটা অলস ভাবে কাটে, এতে তো কোনো কল্যাণ নেই। অতএব পরিমিতভাবে খেয়ে কেউ যদি রোজা রাখে, তাহলে এটা স্বাস্থ্যের জন্য অবশ্যই ভালো- এতে সন্দেহ নেই। অতএব ‘সুস্বাস্থ্যের জন্য রোজা’ হোক আমাদের প্রতিদিনের একটি অবলম্বন। আল্লাহ আমাদের সঠিকভাবে পরিমিত আহার করে রোজা আদায় করার তাওফিক দিন। আমিন!

লেখক: গবেষক, প্রবন্ধিক, কলাম লেখক ও সম্পাদক মাসিক পত্রিকা
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়